Pray for the world economy

মুয়াবিয়া(রা.) ও বিবস্ত্র দাসীর ঘটনা এবং ইসলামবিরোধীদের প্রচারণা

 

 বাংলাদেশি নাস্তিক্যবাদীদের ব্লগে এবং ফেসবুক লাইভে সম্মানিত সাহাবী মুয়াবিয়া(রা.) এর ব্যাপারে একটি ঘটনা উল্লেখ করে তাঁর ব্যাপারে বিষোদগার করা হয়। বিভিন্ন বিদেশি ব্লগেও এই ঘটনা উল্লেখ করে শিয়া ও অন্যান্য ইসলামবিরোধীরা মুয়াবিয়া(রা.) এর ব্যাপারে নানা অশালীন মন্তব্যের চেষ্টা করে। ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থ থেকে বর্ণনাটি নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ

 

ইবনে আসাকির হযরত মু’আবিয়ার আযাদকৃত গোলাম খোঁজা খাদীজের জীবনী আলোচনা প্রসঙ্গে তার উদ্ধৃতিতে উল্লেখ করেছেন,

(একবার) মু'আবিয়া (রা) একটি সুন্দরী ও ফর্সা বাঁদী খরিদ করলেন, এরপর আমি তাকে বিবস্ত্র অবস্থায় তার সামনে পেশ করলাম, এ সময় তার হাতে একটি দণ্ড ছিল৷ তিনি তা দ্বারা তার বিশেষ অঙ্গের প্রতি নির্দেশ করে বলেন, এই সম্ভোগ অঙ্গ যদি আমার হত! তুমি তাকে ইয়াযীদ বিন মু’আবিয়ার কাছে নিয়ে যাও৷

… রাবী'আ যখন তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করলেন, তখন তিনি তাকে বলেন, এই বাঁদীকে বিবস্ত্র অবস্থায় আমার সামনে আনা হয়েছে এবং আমি তার বিশেষ বিশেষ অঙ্গ দেখেছি, এখন আমি তাকে ইয়াযীদের কাছে পাঠাতে চাই৷ তিনি বললেন, না৷ আমীরুল মু’মিনীন ! আপনি তা করবেন না৷ কেননা, সে তার জন্য আর হালাল হবে না ৷ তিনি বলেন, তুমি অতি উত্তম রায় প্রদান করেছ৷

রাবী বলেন, এরপর তিনি হযরত ফতিমা (রা.) -এর আযাদকৃত গোলাম আবদুল্লাহ বিন মাসআদা আল ফাযারীকে বাঁদীটি দান করেন৷ আর সে ছিল কৃষ্ণাঙ্গ, তইি তিনি তাকে বলেন, এর মাধ্যমে তোমার সন্তানাদিকে ফর্সা করে নাও৷ এ ঘটনা হযরত মু'আবিয়ার ধর্মীয় বিচক্ষণতা ও অনুসন্ধিৎসার পরিচায়ক৷ যেহেতু তিনি কামভাবের সাথে বাঁদীটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন৷ কিন্তু তার ব্যাপারে নিজেকে দুর্বল গণ্য করেন (এবং তাকে গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন) তাই তিনি নিম্নের আয়াতের কারণে বাঁদীটি তার পুত্র ইয়াযীদকে দান করা থেকে বিরত থেকেছেন। …[1] 

 

আরো কোনো কোনো স্থানে এই বর্ণনাটি পাওয়া যায়, তবে সব স্থানেই ইবন আসাকির(র.) থেকেই বর্ণনাটি উল্লেখ করা হয়েছে; মূল উৎস একই। এই বর্ণনাটি উল্লেখ করে ইসলামবিরোধীরা ইসলামকে নারীবিদ্বেষী ও অমানবিক ধর্ম হিসেবে দাবি প্রমাণের চেষ্টা করে (নাউযুবিল্লাহ)।

 

প্রথমতঃ

কোনো বর্ণনা থেকে কিছু দাবি করতে হলে সর্বপ্রথম দেখতে হবে বর্ণনাটি কতোটুকু বিশুদ্ধ বা নির্ভরযোগ্য। উপরে আমরা দেখেছি ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে এই বর্ণনাটি ইবন আসাকির(র.) এর সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে (আন্ডারলাইনকৃত)। কাজেই ঘটনাটির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ইবন আসাকির(র.) এর মূল বর্ণনার সনদ যাচাই করতে হবে। তবে এর পূর্বেই লক্ষনীয় যে ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থের সকল নুসখায় এই বর্ণনাটি নেই। এটি কিছু  নুসখায় আছে [2] আবার কিছু নুসখায় অনুপস্থিত। [3]

 

সনদের রাবী (বর্ণনাকারী) সহ ইবন আসাকির(র.) মূল বর্ণনাটি নিম্নরূপঃ

 

1225 - حديج ووجدته في كتاب من كتب إسحاق بن إبراهيم الموصلي خديج وهو خصي (4) وكان لمعاوية بن أبي سفيان حكى عنه وعن أبي الاعور السلمي وربيعة الجرشي (5) وروى عنه عوانة بن الحكم وعبد الملك بن عمير وكان مع معاوية بالجابية اخبرنا أبو بكر محمد بن محمد بن محمد بن كرتيلا أنبأنا أبو بكر محمد بن علي بن محمد الخياط أنبأنا أبو الحسين احمد بن عبد الله السوسي أنبأنا أبو جعفر احمد بن أبي طالب علي بن محمد الكاتب نبأنا أبي نبأنا محمد بن مروان ابن عم الشعبي حدثني محمد بن احمد أبو بكر الخزاعي حدثني جدي يعني سليمان بن أبي شيخ نبأنا محمد بن الحكم عن عوانة حدثني حديج خصي لمعاوية رأيته زمن يزيد بن عبد الملك في ألفين من العطاء قال اشترى لمعاوية جارية (6) بيضاء جميلة فأدخلتها عليه مجردة وبيده قضيب فجعل يهوي به إلى متاعها ويقول هذا المتاع لو كان له متاع اذهب بها إلى يزيد بن معاوية ثم قال لا ادع لي ربيعة بن عمرو الجرشي وكان فقيها فلما دخل عليه قال أن هذه اتيت بها مجردة فرأيت فيها ذاك وذاك (7) واني اردت أن ابعث بها إلى يزيد قال لا تفعل يا أمير المؤمنين فإنها لا تصلح له

[4]

 

আমরা উপরে দেখতে পাচ্ছি বর্ণনাকারীদের মধ্যে আছেন মুহাম্মাদ বিন আহমাদ আবু বকর খাযাঈ (محمد بن احمد أبو بكر الخزاعي) [উপরে লাল রঙে চিহ্নিত]। তিনি হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে যঈফ বা দুর্বল ছিলেন। [5]

 

কাজেই আলোচ্য বর্ণনা যঈফ বা দুর্বল সাব্যস্ত হয়েছে। এককভাবে এই বর্ণনা থেকে কোনো কিছু প্রমাণ করা যাবে না।

 

দ্বিতীয়তঃ

এই বর্ণনা যদি সহীহও হয়ে থাকে, এখানে দেখা যাচ্ছে মুয়াবিয়া(রা.) নিজ অধিকারভুক্ত দাসীকে নগ্ন অবস্থায় দেখেছেন। আর নিজ স্ত্রী এবং দাসীর ক্ষেত্রে পোশাকহীন অবস্থায় দেখা গুনাহের কিছু নয়। নাস্তিক-মুক্তমনা কিংবা বিভিন্ন ধর্মের ইসলামবিরোধী এক্টিভিস্টরা যে নৈতিকতার মানদণ্ড অনুসরণ করে থাকে, আমরা মুসলিমরা তা অনুসরণ করি না। কুরআন ও সুন্নাহতে যা বৈধ করা হয়েছে আমাদের নিকট তা নৈতিক।

 

তবে আলোচ্য বর্ণনা যেহেতু সহীহ নয়, কাজেই এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা নিরর্থক। এককভাবে এই বর্ণনা থেকে মুয়াবিয়া(রা.) এর ব্যাপারে কিছু প্রমাণ করা যাবে না। বরং এটি প্রমাণিত যে মুয়াবিয়া(রা.) মহান সম্মানিত একজন সাহাবী। তাঁর মর্যাদার ব্যাপারে স্বয়ং নবী() এর হাদিসের সাক্ষ্য পাওয়া যায়। এই মর্যাদাবান সাহাবীর ব্যাপারে কটূ মন্তব্য করা থেকে যে কোনো মুসলিমের বিরত থাকতে হবে।

 

عَنِ الْعِرْبَاضِ بْنِ سَارِيَةَ السُّلَمِيِّ قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم اَللّٰهُمَّ عَلِّمْ مُعَاوِيَةَ الْكِتَابَ وَالْـحِسَابَ وَقِهِ الْعَذَابَ

অর্থঃ ইরবায বিন সারিয়াহ সুলামী (রাঃ) বলেন, আমি শুনেছি, রাসূলুল্লাহ() বলেছেন, "হে আল্লাহ! তুমি মুআবিয়াকে কিতাব ও হিসাব শিক্ষা দাও এবং আযাব থেকে রক্ষা কর।" [6]

 

عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّهُ قَالَ لِمُعَاوِيَةَ " اللَّهُمَّ اجْعَلْهُ هَادِيًا مَهْدِيًّا وَاهْدِ بِهِ " . قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ .

অর্থঃ  নবী() মু’আবিয়া (রাযিঃ)-এর জন্য দু’আ করেনঃ “হে আল্লাহ! তুমি তাকে পথপ্রদর্শক ও হেদায়াতপ্রাপ্ত বানাও এবং তার মাধ্যমে (মানুষকে) সৎপথ দেখাও।” [7]

 

উপসংহারঃ

একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে প্রাচীন তারিখ (ইতিহাস) গ্রন্থগুলোতে এমনকি তাফসির গ্রন্থগুলোতেও কোনো বর্ণনা থাকলেই সেটি বিশুদ্ধ নয়। তারিখ গ্রন্থগুলোতে সহীহ, দুর্বল, জাল সব ধরণের বর্ণনাই রয়েছে। তারিখ গ্রন্থগুলোতে বর্ণনা উল্লেখের ক্ষেত্রে ইমামগণ হাদিস গ্রন্থের চেয়ে কম সতর্কতা অবলম্বন করতেন। অনেক সময়ে তাফসির গ্রন্থগুলোতেও ইমামগণ সহীহ বর্ণনার সাথে সাথে কিছু দুর্বল বর্ণনাও উল্লেখ করেছেন। ইমামগণ সাধারণভাবে এই বর্ণনাগুলো উল্লেখ করে যেতেন এবং মন্তব্য করতেন। তাঁরা নিজেরাও কখনো দাবি করেননি যে এই বর্ণনাগুলোর সবগুলোই সহীহ। এই প্রাথমিক বিষয়গুলো মাথায় রাখলে আর বিভ্রান্ত হবার সুযোগ থাকে না। ইসলামবিরোধীরা এখানে যে বর্ণনাটি উল্লেখ করে মুয়াবিয়া(রা.) এর ব্যাপারে নানা খারাপ জিনিস বলবার চেষ্টা করে সেটি দুর্বল বর্ণনার অন্তর্গত। কাজেই তাদের প্রচারণায় আমরা কেউ যেন বিভ্রান্ত না হই। 

 

 

তথ্যসূত্রঃ


[1] আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ – ইবন কাসির, ৮ম খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), পৃষ্ঠা ২৬৬-২৬৭

[2] মূল আরবিঃ

وروى ابن عساكر في ترجمة خديج الخصي مولى معاوية قال: اشترى معاوية جارية بيضاء جميلة فأدخلتها عليه مجردة، وبيده قضيب، فجعل يهوي به إلى متاعها - يعني فرجها - ويقول: هذا المتاع لو كان لي متاع، اذهب بها إلى يزيد بن معاوية، ثم قال: لا ! ادع لي ربيعة بن عمرو الجرشي - وكان فقيها - فلما دخل عليه قال: إن هذه أتيت بها مجردة فرأيت منها ذاك وذاك، وإني أردت أن أبعث بها إلى يزيد، قال: لا تفعل يا أمير المؤمنين ! فإنها لا تصلح له، فقال: نعم ما رأيت، قال: ثم وهبها لعبد الله بن مسعدة الفزاري مولى فاطمة بنت رسول الله صلى الله عليه وسلم، وكان أسود فقال له: بيض بها ولدك،

http://islamport.com/w/tkh/Web/927/3000.htm

অথবা https://archive.is/1Nqhh (আর্কাইভকৃত)

আরো দেখুনঃ https://al-maktaba.org/book/8376/3001#p6

[3] এখানে যে নুসখা থেকে উল্লেখ আছে, সেখানে বর্ণনাটি নেই।

https://islamweb.net/ar/library/index.php?page=bookcontents&idfrom=916&idto=918&bk_no=59&ID=1017

অথবা https://archive.is/GkJUH (আর্কাইভকৃত)

[4]তারিখ দিমাশক’ – ইবন আসাকির

https://al-maktaba.org/book/71/5390#p2

অথবা https://archive.is/wip/xNq5k (আর্কাইভকৃত)

[5]

محمد بن أحمد بن مزيد بن محمود، أبو بكر الخزاعي البوشنجي، المعروف بابن أبي الأزهر: إخباري أديب، من أهل بغداد. كان المبرّد يملي عليه ما يكتب. وكان ضعيفا في روايته للحديث. 

--------

الأعلام للزركلي - المجلد 5 - الصفحة 309 - جامع الكتب الإسلامية

https://ketabonline.com/ar/books/1282/read?page=4890&part=5#p-1282-4890-5

অথবা https://archive.is/GBrzq (আর্কাইভকৃত)

আরো দেখুনঃ https://archive.is/wip/t3JX0

[6] আহমাদ ১৭১৫২, ত্বাবারানীর কাবীর ৬২৮, সিঃ সহীহাহ ৩২২৭; হাদীস সম্ভার ২৮৯২

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=66640

[7] মিশকাত (৬২৪৪), সহীহাহ (১৯৬৯); সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), হাদিস নং : ৩৮৪২

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=42178