অনেক ইসলাম বিদ্বেষী এই হাদীসটি উপস্থাপন করে বলতে চান যে, খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাঁর বাবাকে মদ খাইয়ে মাতাল বানিয়ে ধোঁকা-প্রতারণার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ(ﷺ)কে বিয়ে করেছেন। আজকে আমরা এই হাদীসটির বিশুদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করবো ইন শা আল্লাহ্।
حَدَّثَنَا أَبُو كَامِلٍ، حَدَّثَنَا حَمَّادُ بْنُ سَلَمَةَ، عَنْ عَمَّارِ بْنِ أَبِى عَمَّارٍ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ:
فِيمَا يَحْسَبُ حَمَّادٌ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ذَكَرَ خَدِيجَةَ، وَكَانَ أَبُوهَا يَرْغَبُ أَنْ يُزَوِّجَهُ، فَصَنَعَتْ طَعَامًا وَشَرَابًا، فَدَعَتْ أَبَاهَا وَزُمَرًا مِنْ قُرَيْشٍ، فَطَعِمُوا وَشَرِبُوا، حَتَّى ثَمِلُوا، فَقَالَتْ خَدِيجَةُ لأَبِيهَا: إِنَّ مُحَمَّدَ بْنَ عَبْدِ اللَّهِ يَخْطُبُنِى، فَزَوِّجْنِى إِيَّاهُ، فَزَوَّجَهَا إِيَّاهُ، فَخَلَعَتْهُ وَأَلْبَسَتْهُ حُلَّةً، وَكَذَلِكَ كَانُوا يَفْعَلُونَ بِالآبَاءِ، فَلَمَّا سُرِّىَ عَنْهُ سُكْرُهُ، نَظَرَ فَإِذَا هُوَ مُخَلَّقٌ وَعَلَيْهِ حُلَّةٌ، فَقَالَ: مَا شَأْنِى؟ مَا هَذَا؟ قَالَتْ: زَوَّجْتَنِى مُحَمَّدَ بْنَ عَبْدِ اللَّهِ، قَالَ: أَنَا أُزَوِّجُ يَتِيمَ أَبِى طَالِبٍ لَا لَعَمْرِى، فَقَالَتْ خَدِيجَةُ: أَمَا تَسْتَحِى تُرِيدُ أَنْ تُسَفِّهَ نَفْسَكَ عِنْدَ قُرَيْشٍ، تُخْبِرُ النَّاسَ أَنَّكَ كُنْتَ سَكْرَانَ؟ فَلَمْ تَزَلْ بِهِ حَتَّى رَضِىَ.
হাম্মাদের ধারণানুপাতে ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ(ﷺ) খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন যে, তার পিতা তাকে বিবাহ করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করতেন। তাই তিনি কিছু খাবার ও পানীয় তৈরি করে তার পিতা ও কুরাইশের কিছু লোককে দাওয়াত করলেন। তারা খাওয়া-দাওয়া করলেন এবং মাতাল হওয়া পর্যন্ত (মদ) পান করলেন।
তারপর খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা তার বাবাকে বললেন: মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ আমাকে বিয়ে করতে চান তাই আমাকে তার সাথে বিয়ে দিয়ে দিন। তার বাবা তাকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বিবাহ দিয়ে দেন। তারপর খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা তার বাবার গায়ে কিছু সুগন্ধি লাগিয়ে দেন এবং তাকে একটি হুল্লা (জামা) পরিয়ে দেন, কারণ প্রথা অনুযায়ী বিয়েতে তারা তাদের বাবাদের জন্য এটিই করত।
যখন সে নেশা থেকে সেরে উঠল, তখন সে দেখতে পেল যে সে সুগন্ধি এবং একটি হুল্লা পরে আছে। সে বললো: আমার কি হয়েছে, এটা কি? খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন: তুমি আমাকে মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহর সাথে বিবাহ দিয়েছ। সে বলল: আমি তোমাকে আবু তালিবের ইয়াতীমের সাথে বিয়ে দিয়েছি? কখনো না!
খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন: কুরাইশদের সামনে বোকা সাজতে এবং একথা বলতে তোমার লজ্জা করবে না যে তুমি মাতাল ছিলে? খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা তার বাবা রাজি হওয়া পর্যন্ত তার বাবাকে বুঝাতে থাকলেন। [1]
শাইখ আহমাদ শাকের বলেন: “এই হাদীসের সনদে সমস্যা আছে। সত্যের কাছাকাছি কথা হচ্ছে যে সনদটি যঈফ (দুর্বল) কারণ হাম্মাদ বিন সালামাহ হাদীসটি অনুমানের ভিত্তিতে বর্ণনা করেছেন, তিনি নিশ্চিত ছিলেন না।” [2]
শাইখ শুআইব আল আরনাউত্ব বলেন: “এই হাদীসের সনদ যঈফ। হাম্মাদ বিন সালামাহ হাদীসটি ধারণানুপাতে বর্ণনা করেছেন এবং তিনি নিশ্চিত ছিলেন না। তিনি এখানে তাদলীসও করেছেন, তিনি আলী বিন যায়েদ বিন জুদআনকে সনদ থেকে গায়েব করে দিয়েছেন এবং সে একজন যঈফ বর্ণনাকারী।” [3]
হাদীস বর্ণনা করার সময় বর্ণনাকারী তার শাইখ বা অন্য কোনো এক বা একাধিক বর্ণনাকারীর নাম সনদ থেকে গোপন করে ফেলাকে তাদলীস বলে।
ইমাম বাইহাকি যখন হাদীসটি তার দালাইলুন নুবুয়াহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, তিনি এই সনদে বর্ণনা করেছেন:
حَدَّثَنَا إِبْرَاهِيمُ بْنُ إِسْحَاقَ الْبَغَوِيُّ، قَالَ: حَدَّثَنَا مُسْلِمٌ، قَالَ: حَدَّثَنَا حَمَّادُ بْنُ سَلَمَةَ، عَنْ عَلِيِّ بْنِ زَيْدٍ، عَنْ عَمَّارِ بْنِ أَبِي عَمَّارٍ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ.
হাম্মাদ বিন সালামাহ – আলী বিন যায়েদ থেকে। আলী বিন যায়েদ – আম্মার বিন আবি আম্মার থেকে। আম্মার বিন আবি আম্মার – ইবন আব্বাস থেকে।
আর মুসনাদ আহমাদের সনদ হচ্ছে:
حَدَّثَنَا أَبُو كَامِلٍ، حَدَّثَنَا حَمَّادُ بْنُ سَلَمَةَ، عَنْ عَمَّارِ بْنِ أَبِى عَمَّارٍ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ.
হাম্মাদ বিন সালামাহ – আম্মার বিন আবি আম্মার থেকে। আম্মার বিন আবি আম্মার – ইবন আব্বাস থেকে।
আমরা যখন মুসনাদ আহমাদের সনদকে দালাইকুন নুবুয়াহর সনদের সাথে মিলিয়ে দেখি, তখন আমরা দেখতে পাই যে, দালাইকুন নুবুয়াহতে হাম্মাদ বিন সালামাহ হাদীসটি আলী বিন যায়েদ থেকে বর্ণনা করেছেন। আর মুসনাদ আহমাদে হাম্মাদ বিন সালামাহ হাদীসটি আম্মার বিন আবি আম্মার থেকে বর্ণনা করেছেন।
এর থেকেই স্পষ্ট ভাবে বুঝা যায় যে, হাম্মাদ বিন সালামাহ মুসনাদ আহমাদে আলী বিন যায়েদ (বিন জুদআন)-কে সনদের মধ্য থেকে গায়েব (গোপন) করে দিয়েছেন।
এই একই হাদীসটি ইমাম বাইহাকি তার দালাইলুন নুবুয়াহ গ্রন্থে সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণনা করেছেন। ওখানে বর্ণনাকারী নিশ্চয়তার সাথেই বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সেই বর্ণনার সনদে আলী বিন যায়েদ (বিন জুদআন) নামক একজন দুর্বল বর্ণনাকারী আছে।
শাইখ শুআইব আল আরনাউত্ব বলেন: “এই হাদীসের সনদে আলী বিন যায়েদ বিন জুদআন নামক এক বর্ণনাকারী আছে, সে একজন যঈফ বর্ণনাকারী।” [4]
ড. আবু ইয়াহইয়া নুরপুরী বলেন: “এই একই হাদীসটি দালাইলুন নুবুয়াহ লিল বাইহাকি এবং আল মুজামুল কাবীর লিত তাবরানীতে নিশ্চয়তার সাথে হাম্মাদ বিন সালামাহ থেকে বর্ণিত আছে। কিন্তু সেই সনদে আলী বিন যায়েদ বিন জুদআন নামক একজন রাফেযি (শিয়া), মুনকারুল হাদীস (প্রত্যাখ্যাত) বর্ণনাকারী আছে। যার কারণে হাদীসটি অত্যন্তই দুর্বল।” [5]
শাইখ শুআইব আল আরনাউত্ব আরও বলেন: “এই হাদীসটি এদিক থেকেও ত্রুটিপূর্ণ যে, খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে তার চাচা বিয়ে দেন কারণ তার বাবা খুওয়াইলিদ বিন আসাদ ফিজার যুদ্ধের পূর্বে মৃত্যুবরণ করেন।” [6]
ড. যিয়াউর রাহমান আযমী বলেন: “ইবন আব্বাস থেকে যা বর্ণিত হয়েছে তা সহীহ নয়। হাম্মাদ বিন সালামাহ তা সন্দেহের সাথে বর্ণনা করেছেন। সঠিক কথা হচ্ছে যে, তার চাচা তাকে বিবাহ দেন কারণ তার বাবা ফিজার যুদ্ধের পূর্বেই মারা যান। ইমাম বাইহাকি এটি তার দালাইলুন নুবুয়াহতে আলী বিন যায়েদের সূত্রে বর্ণনা করেন, সে হচ্ছে ইবন জুদআন - একজন যঈফ বর্ণনাকারী।” [7]
ড. আবু ইয়াহইয়া নুরপুরী আরও বলেন: “আমরা যদি তর্কের খাতিরে এই হাদীসটিকে সহীহ হিসেবেও ধরে নেই, তাহলেও কোনো সমস্যা নেই কারণ এটি নবুয়তের পূর্বের ঘটনা এবং তখন মদ খাওয়া হারাম ছিলোনা। বিয়ের জন্য মেয়ের অভিভাবকের অনুমতিও বাধ্যতামূলক ছিল না।” [8]
আলহামদুলিল্লাহ্ আমরা দেখতে পারলাম যে এই হাদীসটি বিভিন্ন দিক থেকে ত্রুটিপূর্ণ। সুতরাং হাদীসটি সহীহ নয়।
তথ্যসূত্রঃ
[1] মুসনাদ আহমাদ, ২৮৪৯ (১/৩১২); দালাইলুন নুবুয়াহ লিল বাইহাকি, ২/৭৩; আল মুজামুল কাবীর লিত তাবরানী, ১২ : ১৮৬ : ১২৮৩৮
[2] মুসনাদ আহমাদ, ৩ : ২৬২ : ২৮৫১
[3] মুসনাদ আহমাদ, ৫ : ৪৭ : ২৮৪৯
[4] মুসনাদ আহমাদ, ৫ : ৪৭ : ২৮৪৯
[5] www.facebook.com/100001753136118/posts/5135441183190935
অথবা https://drive.google.com/file/d/1C3jFysd1oIS83DsjssDgnMv_1nAvt59s/view?usp=sharing
(স্ক্রিনশট)
[6] মুসনাদ আহমাদ, ৫ : ৪৭ : ২৮৪৯
[7] আল জামিউল কামিল, ৮/৩৫-৩৬