মক্কার লোকগুলো প্রচণ্ড অতিষ্ঠ। আব্দুল্লাহর ছেলে মুহাম্মদ ﷺ কি এক নতুন ধর্ম নিয়ে এসেছে, বলছে সব দেব-দেবী ছেড়ে এক আল্লাহর ইবাদত করতে। শত অত্যাচার করেও তাঁকে একটুও দমানো গেলো না। কুরাইশরা তখন একটা মাস্টারপ্ল্যান হাতে নিলো। তারা ভেবে দেখল, সাধারণত সম্পদ,নারী আর রাজত্ব-এই তিনটি বিষয়ের জন্যই মানুষ এতো হাঙ্গামা করে পৃথিবীতে। তাই কুরাইশদের প্রতিনিধি হয়ে উতবাহ ইবনে রাবীআহ , মুহাম্মদ ﷺ কে বললঃ
“যদি তুমি তোমার দারিদ্র্যের কারণে এমনটা করছো, আমাদের বলো তাহলে।আমরা টাকা তুলে তোমাকে সমগ্র কুরাইশদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী বানিয়ে দিবো। যদি তুমি রাজত্ব চাও, আমরা তোমাকে আমাদের রাজা বানিয়ে দিব। যদি তুমি নারী চাও, কুরাইশদের মধ্যে যাকে খুশি পছন্দ করো। আমরা দশজন নারীকে তোমার হাতে তুলে দিবো।”
বর্তমান ইসলাম বিদ্বেষী প্রচারণার একটা অন্যতম মুখ্য হাতিয়ার রাসূল ﷺ কে নারীলোভী হিসেবে উপস্থাপন করা। কারণ, তাঁর ঘোর বিরুদ্ধচারীরাও জানে মুহম্মদ ﷺ এর সম্পদের প্রতি কোনো আসক্তি ছিল না। মৃত্যুর সময় তিনি একটা দিরহাম ও রেখে যাননি[১]। রাসূল ﷺ যদি সত্যিই নারীলোভী হতেন তবে কুরাইশের সেরা সেরা দশ নারীকে বিয়ে করার জন্য এর চেয়ে মোক্ষম সুযোগ আর ছিলো না। কিন্তু তিনি এই সুযোগ গ্রহণ করেননি।
মক্কার মুশরিকরা তাঁকে পাগল বলেছে, বলেছে জাদুকর। কিন্তু কখনোই নারীলোভী কিংবা শিশুকামী বলেনি। কারণ, তারা তাঁকে ছোট থেকে বড় হতে দেখেছে। যখন তাদের সংস্কৃতিতে অবৈধ যৌনাচার একদম স্বাভাবিক ব্যাপার ছিলো তখনো তিনি কোন নারীর নিকট কখনো গমন করেননি। মক্কার সবচেয়ে সুদর্শন পুরষ হয়েও মাত্র ২৫ বছর বয়সে বিয়ে করেন ৪০ বছর বয়সী খাদিজা(রাঃ) কে। খাদিজা(রাঃ) এর মৃত্যু পর্যন্ত তার সাথে ঘর করেছেন একটানা ২৫ বছর। এরপর বিয়ে করেন পঞ্চাশ বছর বয়সী সওদা(রাঃ) কে। তারপর আল্লাহর নির্দেশেই বিয়ে করেন ছয় বছর বয়সী আয়েশা(রাঃ) কে। তারপরেও তার ঘোর শত্রুরা তাঁকে কখনো নারীলোভী কিংবা শিশুকামী বলেনি। আর তার শত্রুরা হয়তো ভুলেও কল্পনা করেনি যে, প্রায় চৌদ্দশ বছর পর তাদেরই মত কিছু ইসলামের শত্রুরা এটা নিয়ে এতো জল ঘোলা করবে।
সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, কিছু তথাকথিত মুসলিমরা বলার চেষ্টা করে যে, রাসূল ﷺ আয়েশা(রাঃ) কে বিয়ে করে ঠিক কাজ করেননি। এই হাদীসটি লক্ষ্য করুন-
আয়েশা (রাঃ) নিজেই বর্ণনা করে গিয়েছেন রাসূলﷺ বলেছেন-“তোমাকে বিয়ে করার আগে আমাকে ২ বার স্বপ্ন দেখান হয়েছিলো। আমি দেখেছি একজন ফেরেশতা তোমাকে এক টুকরো রেশমি কাপড়ে জড়িয়ে আমার কাছে নিয়ে আসছেন। আমি বললাম- আপনি নিকাব উন্মোচন করুন! যখন তিনি নিকাব উন্মোচন করলেন তখন আমি দেখতে পেলাম যে ঐ মহিলা তুমিই। আমি তখন বললাম –এটি যদি আল্লাহর তরফ থেকে হয়ে থাকে তাহলে তিনি তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করবেন। তারপর আবার আমাকে দেখানো হলো যে, একজন ফেরেশতা তোমাকে এক টুকরো রেশমি কাপড়ে জড়িয়ে আমার কাছে নিয়ে আসছেন। আমি বললাম- আপনি নিকাব উন্মোচন করুন! যখন তিনি নিকাব উন্মোচন করলেন তখন আমি দেখতে পেলাম যে ঐ মহিলা তুমিই। আমি তখন বললাম –এটি যদি আল্লাহর তরফ থেকে হয়ে থাকে তাহলে তিনি তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করবেন।[২]
আমরা জানি নবীদের স্বপ্ন হচ্ছে ওহীর মত। তাই আল্লাহতায়ালাই এই বিয়ে ঘটিয়েছিলেন। তাই এই বিয়ের পেছনে অবশ্যই একটা হিকমাহ ছিলো। এরপরেও কোন মুসলিম যদি এই বিয়ে নিয়ে আপত্তি তুলেন তবে অবশ্যই ঈমান হারা হবেন। রাসূল ﷺ কে নিয়ে ইসলাম বিদ্বেষীদের একটি প্রধান অভিযোগ হলোঃ
মুহাম্মদ ﷺ pedophile বা শিশুকামী ছিলেন (নাউযুবিল্লাহ)
যারা pedophilia তে ভোগেন তাদের IQ লেভেল এবং স্মৃতিশক্তি অনেক কম থাকে[৩]। যিনি পুরো কুরআন মুখস্থ বলে যেতে পারতেন তাঁকে আমরা অবশ্যই স্মৃতিশক্তির দোষে দুষ্ট বলতে পারি না। আর মেধার প্রয়োগ এবং সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তিনি যে জিনিয়াস ছিলেন তা পাশ্চাত্যের অনেক লেখকই স্বীকার করেছেন[৪][৫]। Pedophilia তে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রধান যেসব উপসর্গে ভোগেন তার কোনোটাই তাঁর মধ্যে প্রকট ছিল না। আসুন দেখি উইকিপিডিয়াতে pedophilia এর সংজ্ঞা হিসেবে কি বলা হয়েছেঃ
“Pedophilia or paedophilia is a psychiatric disorder in which an adult or older adolescent experiences a primary or exclusive sexual attraction to prepubescent children. the manual defines it as a paraphilia involving intense and recurrent sexual urges towards and fantasies about prepubescent children.” [৬]
এখানে pubescent বা বয়ঃপ্রাপ্তির বিষয়টা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ভৌগোলিক অবস্থা বিবেচনায় একেক অঞ্চলের মেয়েরা একেকসময় বয়ঃপ্রাপ্ত হয়। যেমনঃ মরুভূমি অঞ্চলের মেয়েরা শীতপ্রধান অঞ্চলের মেয়েদের চেয়ে দ্রুত বয়ঃপ্রাপ্ত হয়। মরুভূমির মেয়েরা যেখানে ১০ বছর বয়সে বয়ঃপ্রাপ্তি লাভ করে সেখানে অনেক শীতপ্রধান অঞ্চলের মেয়েরা ১৩-১৫ বছর হয়ে গেলেও বয়ঃপ্রাপ্ত হয় না। ফ্রেঞ্চ ফিলোসফার Montesqueu তার ‘Spirit of Laws’ বইটিতে[৭] উল্লেখ করেছেন, উষ্ণ অঞ্চলে মেয়েরা ৮-৯-১০ বছর বয়সেই বিয়ের উপযুক্ত হয়ে যায়। বিশ বছর বয়সে তাদেরকে বিয়ের জন্য বৃদ্ধ ভাবা হয়। ‘Spirit of Laws’ বইটি আমেরিকার সংবিধান তৈরীতে ব্যবহৃত হয়েছে।
আয়েশা(রাঃ) নিজেই মেয়েদের জন্য বিয়ের বয়স নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “মেয়ে যখন নয় বছরে উপনীত হয়ে যায়, তখন সে মহিলা হয়ে যায়।” [৮] তাই সে সময়কার আরব মেয়েদের জন্য নয় বছর বিয়ের জন্য উপযুক্ত ছিল তার প্রমাণ ছিলেন স্বয়ং আয়েশা(রাঃ)।
নিচের তালিকাটি [৯] ভালোভাবে লক্ষ্য করুন- তালিকাটাতে তিনটা ভিন্ন শতকে মেয়েদের বিয়ের জন্য অনুমোদিত বয়স কত ছিলো সেটা উল্লেখ করা হয়েছেঃ
ভালোভাবে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাবো, ১৮৮০ সালের দিকে অধিকাংশ জায়গায় বিয়ের জন্য অনুমোদিত বয়স ছিলো ১০-১২ এর মধ্যে। আমরা যদি ইতিহাসে আরো পেছনে যেতে পারি তাহলে আরো কম বয়স লক্ষ্য করতে পারব। আবার যত সামনে এগুবো লক্ষ্য করলে দেখা যাবে অনুমোদিত বয়সের সীমা ক্রমাগত বাড়ছে। এর পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হলো মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।
Pedophilia এর সংজ্ঞায় আরো গুরুত্বপূর্ণ দিক উল্লেখ করা হয়েছে- “intense and recurrent sexual urges towards and fantasies about prepubescent children”। অর্থাৎ, একজন pedophile বয়ঃপ্রাপ্ত হয়নি এমন শিশুদের প্রতি বারবার প্রবল আকর্ষণ বোধ করে। মুহম্মদ ﷺ কি এমন কিছু প্রদর্শন করেছিলেন? তিনি কি বাছাই করে শুধু শিশুদের বিয়ে করেছিলেন? নিচের তালিকাটি লক্ষ্য করুন। এখানে আমি মুহাম্মদ ﷺ এর বিভিন্ন বিয়ের সময় তাঁর স্ত্রীদের বয়স উল্লেখ করেছিঃ
অর্থাৎ, তাঁর স্ত্রীদের যখন বিয়ে করেছিলেন তাদের মধ্যে ৯০ ভাগেরই বয়স ছিলো ১৭ কিংবা তার চেয়েও বেশী। একমাত্র আয়েশা(রাঃ) এর বয়স ছিলো দশের নিচে । যারা আয়েশা(রাঃ) এর বয়স দেখে খুশিতে-“Yes, we got it. All moslems are pedophile” বলে চিৎকার করে উঠেন তারা অবশ্য খাদিজা(রাঃ), উম্মে হাবীবাহ(রাঃ) ও সওদা(রাঃ) এর বয়স দেখলে যথাক্রমে বোবা, বধির ও অন্ধ হয়ে যান।
তারপরেও ছয় বছর বয়স স্বামী সংসারের জন্য উপযুক্ত না :
যারা ৬ বছর বয়সে[১০] আয়েশা(রাঃ) এর বিয়ে নিয়ে আপত্তি তুলেন তারা অবশ্য ইতিহাসের একটা সত্য এড়িয়ে যান। সেটা হচ্ছে রাসূল ﷺ এর পূর্বেই আয়েশা(রাঃ), জুবাইর ইবনে মুতিম এর সাথে engaged ছিলেন[১১]। পরবর্তীতে, আবু বকর(রাঃ)[১২] ইসলাম গ্রহণ করলে এ বিয়ে ভেংগে যায়। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি, সে সময় এই বয়সেই বিয়ে করা আরবে একেবারেই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। পরবর্তীতে আল্লাহর নির্দেশে মুহাম্মদ ﷺ তাঁকে বিয়ে করেন। ৬ বছর স্বামী সংসারের জন্য উপযুক্ত নয় বলেই তিনি ৯ বছর বয়সে স্বামীগৃহে উঠেন। Pedophile- এ আক্রান্তরা যেমন শিশুদের পাবার জন্য আকুল হয়ে উঠে, মুহাম্মদ ﷺ কখনোই এমন কিছু প্রদর্শন করেননি। তাই ৯ বছর বয়সে আয়েশা(রাঃ) উপযুক্ত হলে আয়েশা(রাঃ) এর পরিবারই তাকে স্বপ্রণোদিত স্বামীগৃহে উঠিয়ে দেন।
আজ থেকে ২০০ বছর আগে মেয়েরা ১০ বছর বয়সে বিয়ের জন্য উপযুক্ত হলে তা মেনে নিতে যদি আমাদের আপত্তি না থাকে তাহলে ১৪০০ বছর আগে একজন নারীর নয় বছর বয়সে সংসার করা নিয়ে অভিযোগ তোলা কি ডাবল- স্ট্যান্ডার্ড এর মধ্যে পড়ে না? কমনসেন্স,পরিসংখ্যান আর বিজ্ঞান এই তিনটাই সাক্ষ্য দেয় যে, স্বামীগৃহে উঠার সময় আয়েশা(রাঃ) “Pre-pubescent” স্টেজে ছিলেন না। [১৪] মজার ব্যাপার হচ্ছে, ১৯০৫ সালের আগ পর্যন্ত মুহাম্মদ ﷺ এর সাথে আয়েশা(রাঃ) এর বিয়ে কোন ইস্যুই ছিলো না। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ লেখক David Samuel Margoliouth তার "Mohammed and the Rise of Islam" বইতে সর্বপ্রথম এটা নিয়ে জল ঘোলা করেন। কারণ, এর আগে এটা সবার কাছে একদম স্বাভাবিক ব্যাপার ছিলো।
যাদের এরপরেও ব্যাপারটা হজম করতে কষ্ট হয় তাদের ছোট্ট একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে বলবো। আপনার দাদী কিংবা নানী বেঁচে থাকলে তাদের জিজ্ঞেস করুন তাদের কত বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিলো, সম্ভব হলে তাদের কাছ থেকে জেনে নিন আপনার বড়-দাদী এবং বড়-নানীর বিয়ে কত বছর বয়সে হয়েছিলো। দেখবেন বয়সটা ৯-১৫ এর বেশি না। এখন পারবেন কি নিজেদের পূর্বপুরুষদের শিশুকামী বলতে? আল্লাহ-তায়ালা এভাবেই মানুষের মিথ্যাগুলোকে মানুষের দিকেই ফিরিয়ে দেন।
এবার 'সভ্য' দেশগুলোর দিকে তাকাই। মেক্সিকোতে ছেলে মেয়ের দৈহিক সম্পর্কের জন্য এই আধুনিক সময়ে নূন্যতম বয়স মাত্র ১৩। খোদ ইউ.এস স্টেটে মেয়েদের বিয়ের বয়সের ভিন্নতা আছে।যেমনঃ New Hampshire এ বয়স ১৩, New York এ ১৪, South Carlonia তে বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫। আপনি কোন বয়সটাকে সঠিক বলবেন?
তবে এটা ঠিক যে, অপরিপক্ক বয়সে বিয়ে হলে, মেয়েরা আত্মগ্লানিতে ভোগেন এবং স্বামীর প্রতি এতোটা অনুরক্ত হন না। আয়েশা(রাঃ) এর সাথে কি এমনটা হয়েছিলো?
কেমন ছিলো আয়েশা(রাঃ) ও রাসূল ﷺ এর দাম্পত্য জীবন?
- রাসূলুল্লাহ ﷺ এর অন্তরে আয়েশা (রাঃ) এর প্রতি যে মহত্ত্ব ও মর্যাদা ছিলো, তা অন্য কোন স্ত্রীর জন্য ছিলো না। তাঁর প্রতি এ ভালবাসা তিনি কারো থেকে গোপন পর্যন্ত করতে পারেননি, তিনি তাকে এমন ভালবাসতেন যে, আয়েশা (রাঃ) যেখান থেকে পানি পান করতেন, তিনিও সেখান থেকে পানি পান করতেন। আয়েশা (রাঃ) যেই হাড় মুখে নিতেন, তিনিও সেই হাড় মুখে নিতেন। [১৫]
তাঁর মানে এই না যে, রাসূল ﷺ স্ত্রীদের সাথে সমতা পালন করতেন না। তিনি অবশ্যই ভারসাম্য বজায় রাখতেন। তবে, হৃদয় তো আর ভারসাম্য মানে না। রাসূল ﷺ এই বলে আল্লাহর কাছে দু‘আ করতেন,
“ হে আল্লাহ! যা আমার নিয়ন্ত্রণে (অর্থাৎ স্ত্রীগণের প্রতি আচার-ব্যবহার ও লেনদেন) তাতে অবশ্যই সমতা বিধান করি; কিন্তু যা আমার নিয়ন্ত্রণে নয় (অর্থাৎ আয়েশা(রাঃ) এর প্রতি ভালোবাসা) তার জন্য আমাকে ক্ষমা করো।”[১৬]
- আমর ইবনুল আস (রাঃ) একবার জিজ্ঞাসা করেন : “হে আল্লাহর রাসূল, আপনার নিকট সবচেয়ে প্রিয় কে ?” তিনি বললেন : “আয়েশা”। আমর (রাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন : পুরুষদের থেকে ? তিনি বললেন : “তাঁর পিতা”।[১৭]
- রাসূলুল্লাহ ﷺ তার সাথে খেলা-ধুলা, হাসি-ঠাট্টা ইত্যাদিতে অংশ গ্রহণ করতেন। কোন এক সফরে রাসূল ﷺ তার সাথে দৌড় প্রতিযোগিতায়ও অংশ নেন।[১৮]
- আয়েশা (রাঃ) আরো বর্ণনা করেন, যার দ্বারা তার প্রতি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর স্নেহ, মমতার প্রকাশ পায়। তিনি বলেন :“আল্লাহর শপথ, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ কে দেখেছি, তিনি আমার ঘরের দরজায় দাঁড়াতেন, হাবশিরা যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে খেলা-ধুলা করতো, আর রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে তাঁর চাদর দিয়ে ঢেকে নিতেন, যেন আমি তাদের খেলা উপভোগ করি তার কাঁধ ও কানের মধ্য দিয়ে। অতঃপর তিনি আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতেন, যতক্ষণ না আমিই প্রস্থান করতাম”।[১৯]
- তাঁর প্রতি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ভালোবাসার আরেকটি আলামত হচ্ছে, মৃত্যু শয্যায় তিনি অন্যান্য স্ত্রীদের নিকট অনুমতি নিয়ে আয়েশা(রাঃ) এর কক্ষে অবস্থান করেন। আর আয়েশা(রাঃ) এর কোলে মাথা রেখেই তিনি আপন প্রভুর সমীপে আত্মনিবেদন করেন।[২০]
- “আয়েশা(রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ﷺ আমাকে বলেন : তুমি কখন আমার উপর সন্তুষ্ট থাকো আর কখন রাগ করো, আমি তা বুঝতে পারি। তিনি বলেন, আমি বললাম : কিভাবে আপনি তা বুঝেন ? তিনি বললেন : তুমি যখন আমার উপর সন্তুষ্ট থাকো, তখন বলোঃ এমন নয়- মুহাম্মদের রবের কসম, আর যখন আমার উপর রাগ করো, তখন বলো, এমন নয়- ইবরাহিমের রবের কসম। তিনি বলেন, আমি বললাম : অবশ্যই হে আল্লাহর রাসূল, তবে আমি শুধু আপনার নামটাই ত্যাগ করি।’’[২১]
- কোনো এক সফরে আয়েশা(রাঃ) এর সওয়ারি অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। এটা দেখে, রাসূল ﷺ এতোটাই অস্থির হয়ে পড়েন যে, তাঁর পবিত্র জবান থেকে বের হয়ে গেলো-
“ হায় হায়! আমার স্ত্রীর কি হবে!”[২২]
- এক শ্রেণীর মানুষ রাসূল ﷺ কে নারীলোভী আর সম্পদলোভী হিসাবে উপস্থাপন করতে চায়। অথচ আয়েশা(রাঃ) এর ভাষায়- টানা তিনদিন নবী পরিবারে খাবার জুটেছে কখনো এমনটা হয়নি[২৩]। তিনি আরো বলেছেন- মাসের পর মাস চুলোয় আগুন জ্বলতো না[২৪]। শুকনো খেজুর আর পানিতেই দিন কাটতো।[২৫]
উম্মুল মুমিনীনরা সবসময় দুনিয়ার চেয়ে আখিরাতকেই বেশী প্রাধান্য দিতেন। কিন্তু তারাও মানুষ ছিলেন। তাই সংসারের খরচ বাড়াতে তাঁরা বারবার রাসূল ﷺ কে বারবার পীড়াপীড়ি করতেন। এ নিয়ে কিছুটা মনমালিন্যের প্রেক্ষিতে রাসূল ﷺ এক মাস স্ত্রীদের সাথে দেখা করবেন না বলে শপথ করেন। ইতিহাসে এটি “ঈলার ঘটনা” নামে পরিচিত। এ সময়ে রাসূল ﷺ কে দেখতে না পাবার বিরহের কথা বলতে গিয়ে আয়েশা(রাঃ) বলেন, “আমি শুধু দিন গুনতাম।” বিরহের পালা শেষ করে রাসূল ﷺ সর্বপ্রথম আয়েশা(রাঃ) এর সাথে দেখা করেন। আয়েশা(রাঃ) অভিমান করে বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! আপনি তো এক মাসের শপথ করেছিলেন। অথচ সবে ঊনত্রিশ দিন হয়েছে।” রাসূল ﷺ জবাবে বলেন, “আয়েশা! মাস তো ঊনত্রিশ দিনেও হয়।”[২৬]
- আয়েশা(রাঃ), রাসূল ﷺ এর প্রতি এতোটা আত্মসম্মান বোধ করতেন যে তিনি মুহাম্মদ ﷺ কে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “কেনো আমার মতো একজন নারী, আপনার মত একজন পুরুষকে নিয়ে আত্মসম্মান বোধ করবে না ?” [২৭]
এরপরেও যারা এই বিয়ে নিয়ে জলঘোলা করে তাদের বলব, “If Ayesha (R) was happy and satisfied with her marriage, who are you to point your finger at her marriage?”
বিয়ের পেছনে হিকমাহ
- মুহাম্মদ ﷺ ও আয়েশা(রাঃ) এর বিয়ের কারণে মুসলিম উম্মাহ নানাদিক থেকে লাভবান হয়েছিল। আয়েশা(রাঃ), মুহাম্মদ ﷺ এর স্ত্রীদের মধ্যে থেকে সবচেয়ে বেশী হাদীস বর্ণনা করেছিলেন।[২৮]
-সবচেয়ে বেশী হাদীস বর্ণনাকারীদের মাঝে তিনি ছিলেন সপ্তম, নারীদের মধ্যে থেকে প্রথম।
-হাদীস এবং তাফসীরের এমন কোন বই নেই যাতে, আয়েশা(রাঃ) নামটি জ্বলজ্বল করে না।
-রাসূল ﷺ এর মৃত্যুর পর লম্বা একটা সময় তাঁর জ্ঞান আয়েশা(রাঃ) সাহাবী ও তাবেয়ীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। তিরমিযীতে আবু মুসা আশআরি(রাঃ) থেকে বর্ণিত, “আমাদের, সাহাবীগণের কাছে কোনো হাদীস অস্পষ্ট লাগলে, আমরা আয়েশা(রাঃ) এর নিকট শরণাপন্ন হতাম। তাঁর কাছে অবশ্যই কোনো না কোনো ধারণা পাওয়া যেতো।[২৯]
ইমাম যুহরী(রহঃ) তাবিঈদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন। অনেক সাহাবীর সাহচর্যে ধন্য হয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, “সবচেয়ে ভালো জ্ঞান ছিলো আয়েশা(রাঃ) এর। বড়ো বড়ো সাহাবীগণ তাঁর কাছে জানতে চাইতেন।”[৩০]
ইমাম যুহরী আরো বলেন, “যদি সকল মানুষের জ্ঞান এবং পবিত্র স্ত্রীগণের জ্ঞান একত্রিত করা হয়, তারপরেও আয়েশা(রাঃ) এর জ্ঞান বেশী হবে।”[৩১]
---
আবার মক্কার মুশরিক কুরাইশদের কাছে ফিরে যাই। নানাভাবে মুহাম্মদ ﷺ কে প্রলোভন দেখিয়েও তারা মুহাম্মদ ﷺ এর সাথে কোন সমঝোতা করতে পারেনি। মুহাম্মদ ﷺ যদি নারীলোভী হতেন তবে তখনকার পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আরবের সবচেয়ে সুন্দরী নারীদের বিয়ে করতে পারতেন, শিশুকামী হলে পারতেন বেছে বেছে শিশুদের ভোগ করতে। তিনি তার কিছুই করেননি। কারণ, তাঁর মিশন ছিলো সত্যের পথে আজন্ম সংগ্রামের। তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো মানুষকে ‘সৃষ্টির দাসত্ব থেকে স্রষ্টার দাসত্ব’ এর দিকে নিয়ে যাওয়া। তাই তো সত্য প্রচারের জন্য অনমনীয় থেকে তিনি বলেছিলেন,
“আমার এক হাতে সূর্য আরেক হাতে চন্দ্র এনে দিলেও আমার ধর্ম থেকে আমি বিরত হবো না। হয় আল্লাহ আমাকে জয়ী করবেন, নতুবা আমি শেষ হয়ে যাবো। কিন্তু এ কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হবো না। ” [৩২]
তথ্যসূত্রঃ
[১] সিরাতুর রাসূল-মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, পৃষ্ঠা-৭৪৮
[২] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৪১৮
[৩] Cantor JM, Blanchard R, Christensen BK, Dickey R, Klassen PE, Beckstead AL, Blak T, Kuban ME (2004). "Intelligence, memory, and handedness in pedophilia". Neuropsychology 18 (1): 3–14.
[৪] Michael Hart in 'The 100, A Ranking of the Most Influential Persons In History,' New York, 1978.
[৫] Sir George Bernard Shaw in 'The Genuine Islam,' Vol. 1, No. 8, 1936.
[৬] "Diagnostic and Statistical Manual of Mental Disorders, 5th Edition". American Psychiatric Publishing. 2013
[৭] Montesqueu-The spirit of Laws- Book-16,page 264
[৮] তিরমিযী, কিতাবুল নিকাহ
[১০] অনেক মুসলিমই ছয় বছর বয়সে যে আয়েশা(রাঃ) এর বিয়ে হয়েছিলো, তা স্বীকার করেন না। তারা বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করে প্রমাণের চেষ্টা করেন যে, বিয়ের সময় আয়েশা(রাঃ) এর বয়স ছিল বারো বছর অথবা ষোল বছর কিংবা তার চেয়েও বেশী। এই দাবী মেনে নিলে বেশ কয়েকটি সহীহ হাদীসকে অস্বীকার করতে হয়। ‘বিয়ের সময় আয়েশা(রাঃ) এর বয়স ষোল বছর ছিল’- এ সংক্রান্ত দাবীগুলো খণ্ডন করেছেন সাইয়্যেদ সুলাইমান নদভী(রহঃ)। আগ্রহীরা তার বিখ্যাত বই “সীরাতে আয়েশা” পড়লে সেগুলো জানতে পারবেন(পৃষ্ঠাঃ৪০৪-৪৪৬)।
[১১] মুসনাদে আহমাদ, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠাঃ ২১১
[১২] আয়েশা(রাঃ) ছিলেন রাসূল ﷺ এর একমাত্র কুমারী স্ত্রী। অনেক ইউরোপীয় প্রাচ্যবিদ আর খ্রিষ্টান গবেষকদের দাবী হচ্ছে , যেহেতু আরবীতে بكر বলতে কুমারী মেয়েদের বুঝানো হয়, তাই সেই সম্মানের খাতিরেই তাঁর পিতা ইসলামে “আবু বকর” উপনামে খ্যাত হন। একই ভুল করেছেন ভারতবর্ষে আধুনিক শিক্ষার অন্যতম পথিকৃৎ- স্যার সৈয়দ আমির আলি তার “লাইফ অফ মুহাম্মাদ” গ্রন্থের ১৪ নং অধ্যায়ে। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, আয়েশা(রাঃ) এর জন্মের বহু পূর্বেই তাঁর পিতা “আবু বকর” উপাধিতে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। আর এই পন্ডিতদের কে জানাবেন যে, আরবী ভাষায় কুমারীকে بَكْر (ফাতহা দিয়ে-বকর) বলা হয় না; বরং بِكْر (কাসরা দিয়ে-বিকর) পড়া হয়?
[১৩] তাবাকাত, ইবনে সা‘দ, পৃষ্ঠাঃ ৪৩
[১৪] Al-Dawoodi said: ‘Aa’ishah (may Allaah be pleased with her) was reached physical maturity (at the time when her marriage was consummated).
(Sharh Muslim, 9/206 )
https://islamqa.info/en/22442
(Sharh Muslim, 9/206 )
https://islamqa.info/en/22442
[১৫] মুসনাদে আহমদঃ ৬/৬৪
[১৬] আবু দাউদ
[১৭] সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম।
[১৮] সুনানে আবু দাউদ
[১৯] সহীহ বুখারী
[২০] সহীহ বুখারী, পৃষ্ঠাঃ ৬৪০
[২১] সহীহ বুখারী, পৃষ্ঠাঃ ৮৯৭
[২২] মুসনাদে আহমাদ, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠাঃ ২৫৮
[২৩] মুসনাদে আহমাদ, পৃষ্ঠাঃ ২৫৫
[২৪] মুসনাদে আহমাদ, পৃষ্ঠাঃ ২১৭
[২৫] সহীহ বুখারী
[২৬] সীরাতে আয়েশা-সাইয়্যেদ সুলাইমান নদভী(রহঃ), পৃষ্ঠা-১৪৯
[২৭] সহীহ মুসলিম
[২৮] সিরাতুর রাসূল-মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, পৃষ্ঠা- ৭৬৮
[২৯] জামে তিরমিযীঃ মানাকেব আয়েশা(রাঃ)
[৩০] তাবাকাত ইবনে সা‘দ
[৩১] মুসতারাকে হাকেম
[৩২] সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৩১৪