একই গল্প একটু অন্যভাবে বললে পুরো গল্পটাই বদলে যায়। আবার মাঝে মাঝে অন্যভাবে বলার ও প্রয়োজন নেই। শুধু প্রসঙ্গটা গোপন রাখতে পারলেই হলো- প্রসঙ্গবিহীন গল্প পড়ে একেবারে ঝানু পাঠক ও বোকা বনে যেতে পারে। এজন্য যখন আমরা ইতিহাস পড়ি তখন অবশ্যই উচিৎ প্রসঙ্গসহ পুরো ঘটনাটা পড়া। পড়ার পর যদি কোন কিছু গ্রহণযোগ্য মনে না হয় সেখানে আমাদের দেখতে হবে সমালোচকরা ব্যাপারটা নিয়ে কি বলেন, তারপর দেখা উচিৎ অপরপক্ষ ব্যাপারটা নিয়ে কি বলে। এভাবে যদি আমরা ইতিহাস না পড়ি তবে আমরা কেবল তাই ই দেখতে পাব যা আমাদের মন দেখতে চায় কিংবা সমালোচকরা আমাদের দেখাতে চায়। একটা উদাহারণ দেই। ধরা যাক, কেউ এসে আপনাকে বলল-
“আনিস সাহেব রাতের বেলায় এক যুবতী নারীর বাসায় গেলেন। নারীটি তখন বাড়িতে একা ছিল।”
এই দুই লাইন পড়ে প্রায় সবাই ই মনে করবে আনিস সাহেব খুবই বাজে লোক। সে রাতের বেলায় যুবতী মেয়ের সাথে মজা লুটে। কিন্তু কেউ ভালোমত খোঁজখবর নিয়ে গল্পের প্রসঙ্গটা জানতে পারল। গল্পটা তখন এমন হলো-
“আনিস সাহেব একজন দয়ালু লোক। পাশের বাড়ীর এক যুবতী মেয়ে সদ্যই বিধবা হয়েছে। তাকে দেখাশুনার কেউ নেই। আনিস সাহেব তাই রাতের বেলায় মেয়েটিকে কিছু অর্থ দান করতে গেলেন।”
দেখলেন তো! প্রসঙ্গটা জানার পর পুরো গল্পটাই কেমন বদলে গেল! এখন এই গল্প পড়ে সমালোচকরা হয়তো বলতে পারে, ‘আনিস সাহেব কেন রাতের বেলায় যাবেন? তিনি কি দিনের বেলায় যেতে পারতেন না?’ আপনি দেখলেন অপরপক্ষ বলছে, ‘আনিস সাহেব সপ্তাহে সাত দিনই ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করেন। তার নিশ্বাস ফেলার ও সময় থাকে না। তাই রাতে যাওয়া ছাড়া তার উপায় নেই।
আপনি দুই পক্ষের মত আর প্রসঙ্গসহ আনিস সাহেবের গল্প পড়ে ফেললেন। এখন তাকে বিচার করার দায়িত্ব আপনার! আজ আমরা ঠিক এই কাজটাই করব। দুইজন মানুষের গল্প জানব দুইপক্ষের মতসহ, প্রসঙ্গসহ। তাঁরা হলেন মুহম্মাদ(ﷺ) ও সাফিয়া(রাঃ)।
কে ছিলেন সাফিয়া(রাঃ)?
সাফিয়া(রাঃ) ছিলেন ইহুদী গোত্র বনু নাদীরের প্রধান হুয়াই বিন আখতারের কন্যা। বাবার বেশ আদরের মেয়ে ছিলেন উনি। তাঁর বর্ণনায়ঃ
“আমি ছিলাম আমার বাবা এবং আমার চাচাদের প্রিয় সন্তান। যখন আল্লাহর রাসূল ﷺ মদীনাতে আসলেন এবং কুবাতে অবস্থান করলেন, আমার বাবা তাঁকে রাতের বেলায় দেখতে যান। যখন তাঁরা ফেরত আসে তাদেরকে খুব চিন্তিত আর ক্লান্ত লাগছিল। আমি আনন্দের সাথে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানালাম কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম তাদের কেউই আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। তারা এতোটাই চিন্তিত ছিলেন যে তারা আমার উপস্থিতিই অনুভব করল না। আমি শুনতে পারলাম আমার কাকা,আবু ইয়াসির, আমার আব্বাকে বলছেন, ‘উনিই কি সেই ব্যক্তি?’ আব্বা জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ।” আমার কাকা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি সত্যিই তাকে চিনতে পেরেছেন এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারেন?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তখন আমার কাকা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তার ব্যাপারে এখন আপনার চিন্তা-ভাবনা কি?’ তিনি বললেন, “আমি যতদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকব তাঁর শত্রু হবো।” [1]
আরবের ইহুদিরা তখন একজন নবীর অপেক্ষা করছিল। । ‘উনি কি সেই ব্যক্তি বলতে’ তাদের সেই নবীর কথাই বলা হয়েছে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যেত, যখনই কোন আরব গোত্রের সাথে ইহুদিদের ঝগড়া হতো তখন তারা আরবদের এই বলে হুমকি দিত, “যখন আমাদের প্রতিশ্রুত নবী আসবে তখন আমরা তোমাদের দেখে নিব।”
>>তাওরাতে সেই নবীর কিছু চিহ্ন বলে দেয়া ছিলঃ-
‘তিনি জেন্টাইলদের(যারা ইহুদী নয়) মাঝে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেন। তিনি কখনো চিৎকার করবেন না, তাঁর স্বরও উঁচু করবেন না, আর কখনো রাস্তাঘাটে তাঁর কন্ঠস্বর শোনাবেন ও না।’ [2] সীরাত গ্রন্থ পড়লে জানা যায়, রাসূল(ﷺ) বেশ নরম প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তিনি কখনো চিৎকার করে কথা বলতেন না। বাজারে তাঁর স্বর উঁচু করতেন না। [3]
আবার সরাসরি সেই নবীর নামও বলে দেয়া হয়েছেঃ
חִכּוֹ, מַמְתַקִּים, וְכֻלּוֹ, מַחֲמַדִּים; זֶה דוֹדִי וְזֶה רֵעִי, בְּנוֹת יְרוּשָׁלִָם.
- ‘তাঁর মুখের ভাষা বড়ই মিষ্টি, হ্যাঁ! সে বড়ই প্রেমময়। হে জেরুজালেমের কন্যারা! সে হচ্ছে আমার প্রিয়জন, সে হচ্ছে আমার বন্ধু(হাবীব)।” [4] এখানে বড়ই প্রেমময় কথাটার হিব্রু “מחמד” উচ্চারণ করলে হবে ‘Mahammad-im’। হিব্রুতে ‘im’ ব্যবহৃত হয় ‘Plural of respect’ হিসেবে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ইহুদিদের কিতাবে বেশ ভালোভাবেই মুহম্মদ ﷺ এর নাম ও বৈশিষ্ট্য লিখিত ছিল। কিন্তু ইহুদিরা আশা করেছিল তাদের মধ্যে থেকেই সেই নবীর আবির্ভাব ঘটবে। তাই যখন আরবদের মধ্যে থেকে সে নবীর আবির্ভাব ঘটল তখন তারা সেটা মেনে নিতে পারল না। অনেকের কাছে এটা অবাক লাগতে পারে কিন্তু ইহুদিদের ইতিহাসই এমন। যাকে তারা প্রায় সবাই নবী বলে মেনেছিল সেই মূসা(আঃ) এর ঈশ্বরের বিরুদ্ধেই তারা বিদ্রোহ করেছিল। মুসা(আঃ) বেশ আক্ষেপ নিয়ে বলেছিলেন,
“যতদিন ধরে আমি তোমাদেরকে চিনি ততদিনই তোমরা ঈশ্বরের সাথে বিদ্রোহ করে এসেছ।” [5]
তাই সাফিয়া(রাঃ) এর বাবা মুহাম্মদ ﷺ কে নবী হিসেবে চিনতে পারলেও তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অটল রইলেন। তবে সাফিয়া(রাঃ) এর কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, তিনিই সেই প্রতিক্ষীত নবী। এদিকে খন্দকের যুদ্ধে ইহুদিরা কুরাইশদের সহযোগিতা করে চূড়ান্ত বিশ্বাস-ঘাতকতা করল এবং রাসূল ﷺ এর সাথে চুক্তি ভঙ্গ করল। মক্কার মুশরিকদের সাথে হাত মিলিয়ে বনু কোরাইজা আর খায়বারের ইহুদিরা মুসলিমদের বেশ ভুগিয়েছিল। তাই রাসূল ﷺ খন্দকের যুদ্ধের পর খায়বারে অভিযান প্রেরণ করলেন। যুদ্ধে ইহুদিরা চূড়ান্তভাবে পরাজিত হলো। সাফিয়া (রাঃ) এর স্বামী মুসলিমদের হাতে মারা গেলেন, তিনি নিজে বন্দী হলেন। ইসলামে অবশ্যই ঢালাওভাবে যুদ্ধবন্দী করার উপায় নেই, এর কিছু নিয়ম আছে। এখানে এতো বিস্তারিতভাবে আলোচনা সম্ভব না। যারা ইসলামে দাসপ্রথা নিয়ে জানতে ইচ্ছুক তারা এই লেখাটি পড়তে পারেন [6]। আমরা এখন যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থা প্রসঙ্গসহ সমালোচকদের দৃষ্টিতে দেখব, এরপর যুক্তিগুলো খন্ডনের চেষ্টা করবঃ
রাসূল ﷺ সাফিয়া(রাঃ) কে বিয়ে করলেনঃ
সাফিয়া(রাঃ) কে নিয়ে মিথ্যাচারের জন্য ইসলাম-বিদ্বেষীরা বুখারী শরীফের একটি হাদীস প্রায়ই ব্যবহার করে থাকে। হাদীসটিতে সামান্য কিছু কথা যোগ করলে আর প্রসঙ্গ বাদ দিলে রাসূল ﷺ খুব সহজেই একজন নিষ্ঠুর মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা যায় বলে এটি ইসলাম-বিদ্বেষী মহলে খুব জনপ্রিয় একটি হাদীসঃ
আনাস ইবনে মালিক(রাঃ) থেকে বর্ণিত, “আমরা খায়বার জয় করলাম। তখন যুদ্ধবন্দীদের সমবেত করা হল। দিহয়া এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর নবী ﷺ! বন্দীদের মধ্যে থেকে আমাকে একটি দাসী দিন।’ তিনি বললেন, ‘যাও তুমি একটি দাসী নিয়ে যাও।’ তিনি সাফিয়া বিনত হুয়াই(রাঃ) কে নিলেন।তখন এক ব্যক্তি নবী(ﷺ) এর কাছে এসে বললঃ ইয়া নবী! বনু কোরাইজা ও বনু নাযীরের অন্যতম নেত্রী সাফিয়্যা বিনত হুয়াইকে আপনি দিহয়াকে দিচ্ছেন? তিনি তো একমাত্র আপনারই যোগ্য। তিনি বললেনঃ দিহয়াকে সাফিয়াসহ ডেকে আন। তিনি সাফিয়াসহ উপস্থিত হলেন। যখন নবী ﷺ সাফিয়াকে দেখলেন তিনি (দিহয়াকে)বললেনঃ তুমি বন্দীদের মধ্যে অন্য একজন দাসীকে বেছে নাও। রাবী বলেনঃ নবী ﷺ সাফিয়া(রাঃ) কে আযাদ করে দিলেন এবং তাঁকে বিয়ে করলেন। রাবী সাবিত(রাঃ) আনাস(রা:) কে জিজ্ঞেস করলেনঃ তিনি তাঁকে কি মোহর দিয়েছিলেন? আনাস(রাঃ) জবাব দিলেনঃ তাঁকে আযাদ করাই তাঁর মাহর। এর বিনিময়ে তিনি তাঁকে বিয়ে করেছেন। [7]
মুহম্মাদ ﷺ কি সাফিয়া(রাঃ) এর রুপে আসক্ত হয়ে তাঁকে বিয়ে করেছিলেন?
অনেকে বলতে চান যে, হাদিসটিতে বলা আছে, রাসূল ﷺ সাফিয়া(রাঃ) কে দেখে নিজের জন্য পছন্দ করেছেন, অর্থাৎ রূপ দেখে পাগল হয়েছেন। কিন্তু আরেকটু পিছনে পড়লেই আমরা দেখতে পারি এটা কোন কারণই ছিল না। এক ব্যক্তি যখন রাসূল ﷺ এর কাছে এসে বলল, ‘বনূ কুরাইযা ও বনূ নাযীরের অন্যতম নেত্রী সাফিয়্যা বিনত হুয়াইকে আপনি দিহয়াকে দিচ্ছেন’-তখন রাসূল ﷺ সাফিয়া(রাঃ) কে ডেকে পাঠান। গোত্র প্রধানের মেয়ে এবং নেত্রী হিসেবে তিনি মুসলিমদের নেতার সাথেই বিয়ের জন্য সবচেয়ে বেশী উপযুক্ত। তাই রাসূল(ﷺ) তাকে বিয়ে করেন। যদি এই ব্যক্তিটি এসে এমনটা বলত, ‘বনূ কুরাইযা ও বনূ নাযীরের সবচেয়ে সুন্দরী নারীকে আপনি দিহয়াকে দিচ্ছেন’ আর এরপর রাসূল ﷺ সাফিয়া(রাঃ) কে ডেকে নিয়ে এসে বিয়ে করতেন, তাহলে মুহাম্মদ ﷺ এর দিকে এই অভিযোগ তোলা যেত। এছাড়া আরবে একটি রীতি ছিল শত্রু যদি গোত্রের কোন মেয়েকে বিয়ে করত তবে তার সাথে তারা শত্রুতা শেষ করে ফেলত। এ কারণেই আবু সুফিয়ানের মেয়ে উম্মে হাবীবাহ(রাঃ) কে রাসূল ﷺ বিয়ে করার কারণে তাঁর সাথে আবু সুফিয়ানের শত্রুতা শেষ হয়ে যায়। রাসূল ﷺ এই বিয়ের মাধ্যমে ইহুদীদের সাথে শত্রুতা শেষ করার জন্য একটি হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
সাফিয়া(রাঃ) কে তার সাথী এক মহিলা সহ বিলাল(রাঃ) রাসূল ﷺ এর কাছে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে, স্বজাতি ইহুদিদের লাশ দেখে তাঁর সাথী মহিলা চিৎকার জুড়ে দিল। সাফিয়া(রাঃ) এসে রাসূল ﷺ এর পিছনে নিজেকে অত্যন্ত গুটিয়ে নিয়ে দাঁড়ালেন। রাসূল ﷺ তাঁর উপর নিজের চাদর বিছিয়ে দিলেন। তখন উপস্থিত মুসলিমরা বুঝে নিল যে, রাসূল(ﷺ) তাঁকে তাঁর নিজের জন্য পছন্দ করেছেন। রাসূল ﷺ এরপর বিলাল(রাঃ) কে তিরষ্কার করে বললেন, ‘তোমার হৃদয় থেকে কি দয়া-মায়া উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল হে বিলাল! তুমি এই দুই মহিলাকে তাদের আত্নীয়-স্বজনের দেহ মাড়িয়ে নিয়ে এলে?’ [8] । আর বিয়ের আগে সব মুসলিমই তার হবু বধূকে দেখে। এটা রাসূল ﷺ এর নির্দেশ। এর ফলে পুরুষের হৃদয়ে স্ত্রীর জন্য ভালবাসা সৃষ্টি হয়। শুধু ইসলাম না বরং সব ধর্ম আর সংস্কৃতিতে এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। এটা নিয়ে এতো লাফালাফি করার কারণ আমার নিকট পরিষ্কার না।
সাফিয়া(রাঃ) এর স্বামীকে কেন হত্যা করা হয়েছিল?
প্রথমত, খায়বারবাসীর সঙ্গে মুসলিমদের যুদ্ধ পরিস্থিতি ছিল। শুধু শুধু কাউকে হত্যা করা হয়নি বা শাস্তি দেয়া হয়নি। খায়বারবাসী খন্দক যুদ্ধে মুশরিক শক্তিগুলোকে সংগঠিত করে মুসলিমগণের বিরুদ্ধে লিপ্ত হতে সাহায্য এবং উৎসাহিত করেছিল। মুসলিমগণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও বিশ্বাসঘাতকতার জন্য এরাই বনু কুরাইযাকে সর্বতোভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এরাই মুনাফিকদের সঙ্গে, আহযাব যুদ্ধের তৃতীয় শক্তি বনু গাত্বাফান এবং বেদুঈনদের সঙ্গে অনবরত যোগাযোগ রেখে চলছিল এবং নিজেরাও যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল। তাঁরা তাদের এ সমস্ত কার্যকলাপের মাধ্যমে মুসলিমগণের একটা চরম অস্বস্তিকর অবস্থা ও অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে নিপতিত করেছিল। এমন কি নবী(ﷺ)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র তারা করেছিল। এ সমস্ত অস্বস্তিকর অবস্থার প্রেক্ষাপটে অন্যন্যোপায় হয়ে মুসলিমগণ বার বার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ সকল যুদ্ধের মাধ্যমে কোন্দল সৃষ্টিকারী ও ষড়যন্ত্রকারীদের নেতা ও পরিচালকদেরকে দমন করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। [8.5]
দ্বিতীয়ত, মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা(রাঃ) এর ভাই মাহমুদ ইবন মাসলামা(রাঃ)কে হত্যা করার জন্য কিসাস হিসেবে সাফিয়া(রাঃ) এর স্বামী কিনানা ইবন রবী' (কিনানা বিন আবুল হুকাইক নামেও পরিচিত)কে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। [8.75]
পিতা ও স্বামীর হত্যাকারীকে কেউই বিয়ে করতে চাইবে না। তাই সাফিয়া(রাঃ) কি বিয়েতে রাজী ছিলেন?
পিতা এবং চাচার কথা-বার্তায় সাফিয়া(রাঃ) এর কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, মুহাম্মদ ﷺ তাদের প্রতীক্ষিত নবী। এছাড়া সাফিয়া(রাঃ) খায়বার বিজয়ের পূর্বে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখেন। সাফিয়া(রাঃ) এর চোখের উপর ভাগে আঘাতের চিহ্ন ছিল। প্রথমবার যখন সাফিয়া(রাঃ) রাসূল ﷺএর সামনে উপস্থিত হন তখন নবী ﷺ তাঁকে এই আঘাতের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন। সাফিয়া(রাঃ) তখন তাঁর স্বপ্নের কথা বর্ণনা করেন-
‘একবার আমি স্বপ্ন দেখলাম আকাশ থেকে উজ্জ্বল এক নক্ষত্র এসে আমার কোলে পড়ল। আমি এর তাৎপর্য বুঝতে না পেরে আমার স্বামীকে স্বপ্নের কথা বললাম। শুনে তিনি ক্ষুদ্ধ হলেন, ক্রুদ্ধ হলেন আর বললেন, ‘কি! হিজাজের বাদশাহকে স্বামীরূপে পেতে তোর কামনা!’ আর তাই তিনি স্বপ্নে তোর কোলে এসে পড়ে। এই না বলে তিনি আমার মুখে কষে দিলেন এক থাপ্পড়। আঘাতের সেই চিহ্নটি রয়ে গেছে মুখের উপর। [9]
সাফিয়া(রাঃ) এর মানসিক অবস্থা তখন বেশ নাজুক ছিল। একদিক থেকে তিনি জানতেন মুহাম্মদই ﷺ সত্য নবী, অন্যদিকে নিজের পিতা এবং স্বামীকে হারনোর কারণে তিনি মুহাম্মদ ﷺ কে দায়ী করছিলেন। এ কারণে তার অন্তরে তৈরী হয়েছিল মুহাম্মদ(ﷺ) এর প্রতি তীব্র ঘৃণাবোধ। সাফিয়া(রাঃ) নিজেই তাঁর সেই অবস্থার কথা বর্ণনা করেছেনঃ
‘আমার নিকট রাসূল ﷺ অপেক্ষা ঘৃণ্য আর কেউই ছিল না। কারণ উনি আমার পিতা ও স্বামীকে হত্যা করেছিলেন। কিন্তু নবী(ﷺ) তাকে বোঝালেন, ‘হে সাফিয়া! তোমার পিতা পুরো আরবকে আমার বিরুদ্ধে উসকে দিয়েছিল এবং সে এটা এবং এটা করেছিল......।’ এভাবে তিনি বোঝাতে থাকলেন এবং (ঘৃণার) সেই অনুভূতিটা আমার মাঝ থেকে দূর হয়ে গেল।’ [10]
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত 'সীরাত বিশ্বকোষ' এ উল্লেখ আছেঃ
"পিতা, ভ্রাতা, আত্মীয়-স্বজনের নিহত হওয়ার ফলে হিংসা ও ঘৃণায় সাফিয়্যার মন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি অতিশয় বিরুপ হইয়া উঠিয়াছিল। তাই মনের গতি পরিবর্তনের জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাহাকে আনাসের মাতার তত্ত্বাবধানে রাখিয়াছিলেন। বিশেষ আদর-যত্নে থাকায় তাহার মনের পরিবর্তন ঘটিলে তিনি এক শুভ মুহূর্তে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। ... হযরত সাফিয়্যা স্বয়ং বর্ণনা করিয়াছেন, বন্দিনী অবস্থায় আমাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট উপস্থিত করা হইল। পিতা, ভ্রাতা ও কওমকে কতল করার দরুন তিনি আমার নিকট ঘৃণ্যতম মনে হইতেছিলেন। কিন্তু তাহার অমায়িক ব্যবহারে আমি বিমােহিত হইয়া পড়িলাম। আমার অন্তর হইতে হিংসা চিরতরে মুছিয়া গেল। এক্ষণে তিনি আমার নিকট সারা জাহানের মধ্যে সর্বাধিক প্রিয় (দ্র. সাইয়েদুল মুরসালীন, ২খ., পৃ. ৮২৭)।" [10.1]
এই বর্ণনাগুলোর মাধ্যমে এটা পরিষ্কার যে, পিতা ও স্বামীকে হারানোর কারণে তার মাঝে যে সহজাত ঘৃণার সৃষ্টি হয়েছিল তা মুহাম্মদ ﷺ যথাযথ কারণ ব্যাখ্যা করে দূর করে দেন। ধরা যাক, আপনি জানতে পারলেন বিচারক আপনার পিতাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। আপনার প্রথমে প্রচণ্ড রাগ লাগবে। কারণ, প্রত্যেকটা মানুষই তাদের কাছের মানুষদের নিরপরাধ ভাবতে ভালবাসে। কিন্তু যখন আপনি জানতে পারবেন যে, আপনার পিতা এক ব্যক্তিকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছে আর এর জন্য তার মৃত্যুদণ্ডই প্রাপ্য, তখন আর আপনার আগের মত ক্রোধ কাজ করবে না।
বন্দী হিসেবে কি তাঁর প্রস্তাব গ্রহণ করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল?
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বন্দীদের নিজেদের মতামতের কোন মূল্য থাকে না। সাফিয়া(রাঃ)কে কি জোর করেই বিয়েতে বাধ্য করা হয়েছিল? ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলে-
রাসুলুল্লাহ ﷺ সাফিয়া বিন হুয়াইকে নিজের জন্য বেছে নেন। এবং তাঁকে স্বাধীন হয়ে তাঁর স্ত্রী হবার অথবা তাঁর পরিবারের কাছে চলে যাবার এই যে কোনোটি করার সুযোগ দেন। তিনি স্বাধীন হয়ে তাঁর স্ত্রী হওয়াকে বেছে নেন। [10.5]
“যখন সাফিয়া(রাঃ) রাসূল ﷺ এর সামনে আসলেন তখন নবী(ﷺ) তাঁকে বললেন, ‘ইহুদিদের মধ্যে তোমার পিতা ততক্ষণ পর্যন্ত আমার সাথে শত্রুতা বন্ধ করেনি যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহ তাকে ধ্বংস করেছেন।’ সাফিয়া(রাঃ) জবাবে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর কিতাবে বলেছেন, ‘কেউই অপরজনের পাপের ভার বহন করবে না [তিনি মূলত বাইবেলের একটা verse উদ্ধৃত করলেন- Ezekiel 18:20]’। তখন রাসূল ﷺ তাঁকে বললেন, ‘ সিদ্ধান্ত তোমার ! তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ কর তবে আমি তোমাকে নিজের জন্য বেছে নিব। আর যদি তুমি ইহুদি থাকাটাকেই বেছে নাও তবে হয়তো আমি তোমাকে মুক্ত করে দিব এবং তোমাকে তোমার লোকজনের নিকট পাঠিয়ে দিব। সাফিয়া(রাঃ) জবাবে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনার কাছে আসার পর আপনি আমাকে দাওয়াত দেবার আগেই আমি ইসলামকে গ্রহণ করেছি আর আপনাকে সত্য বলে মেনেছি। ইহুদিদের মাঝে আমার কোন অভিভাবক নেই, বাবা নেই, কোন ভাই ও নেই। আমি ইসলামকে কুফরের উপর প্রাধান্য দিলাম। মুক্ত হয়ে আমার লোকজনের নিকট যাবার চেয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই আমার নিকট অধিক প্রিয়।’ [11]
মুহাম্মদ ﷺ যদি সত্যিই নারীলোভী না হয়ে থাকেন তবে ইদ্দত পর্যন্ত অপেক্ষা করেননি কেন?
এটা খুব জনপ্রিয় একটা মিথ্যা অভিযোগ। যুদ্ধবন্দীনির ক্ষেত্রে ইদ্দত পালনের বিধানটুকু নবী(ﷺ) অবশ্যই পালন করেছিলেন। আবু সাঈদ খুদরী(রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল ﷺ আওতাস গোত্রের যুদ্ধবন্দীনির ব্যাপারে বলেন, “গর্ভবতী নারীরা যতক্ষণ পর্যন্ত না সন্তান প্রসব করে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের সাথে মিলিত হওয়া যাবে না আর যারা গর্ভবতী নয় তাদের একটি মাসিক না হওয়া পর্যন্ত মিলিত হওয়া যাবে না।” [12] অর্থাৎ যুদ্ধবন্দীনিদের ক্ষেত্রে তাদের একটি মাসিক পর্যন্ত সময়টুকুই হচ্ছে ইদ্দত।
সাফিয়া(রাঃ) কিন্তু প্রথমে যুদ্ধবন্দিনীই ছিলেন অতঃপর রাসূল ﷺ তাঁকে মুক্ত করে বিয়ে করেন। বুখারী শরীফের হাদিসের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি রাসূল ﷺ ইদ্দতের সময়টুকু অপেক্ষা করেছিলেনঃ আনাস ইবনে মালিক(রাঃ) থেকে বর্ণিত, ‘রাসূল ﷺ সাফিয়া(রাঃ)কে নিজের জন্য পছন্দ করলেন এবং তাঁকে নিয়ে রওনা দিলেন। একসময় আমরা সাদ-আস-সাহবা নামক স্থানে পৌঁছালাম। এসময় সাফিয়া(রাঃ) তাঁর মাসিক অবস্থা থেকে পবিত্র হলেন। অতঃপর রাসূল(ﷺ) তাঁকে বিয়ে করলেন।’ [13]
কেমন ছিল সাফিয়া(রাঃ) ও রাসূল ﷺ এর দাম্পত্যজীবন?
সাফিয়া(রাঃ) যদি সত্যিই মন থেকে ইসলাম কবুল করে থাকেন তবে তা তাঁর পরবর্তী আচরণেই প্রকাশ পাবার কথা। দেখা যাক, এ ব্যাপারে হাদীস ও সীরাতগ্রন্থগুলো কি বলছেঃ
- ‘রাসূল ﷺ যখন প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে মৃত্যু শয্যায় ছিলেন, তাঁর স্ত্রীরা তাঁর চারপাশে জড় হলেন। তখন সাফিয়া(রাঃ)বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর শপথ! আপনার জায়গায় যদি আমি থাকতে পারতাম ।’ তাঁর কথা শুনে অন্য নবী পত্নীরা মুখটিপে হাসলেন। রাসূল ﷺ তাঁদের দেখে ফেললেন এবং বললেন, ‘তোমাদের মুখ ধুয়ে ফেল।’ তাঁরা বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! কেন?’ তিনি জবাবে বললেন,‘কারণ তোমরা তাঁকে বিদ্রুপ করেছ। আল্লাহর শপথ সে সত্য বলছে।’ [14]
- ভ্রমণে যাবার সময় রাসূল ﷺ তাঁর হাঁটু সাফিয়া(রাঃ) এর জন্য বিছিয়ে দিতেন যাতে তিনি তাতে পা দিয়ে (উটের পিঠে) চড়তে পারেন। [15]
-সাফিয়া(রাঃ) বলেন, ‘একবার ভ্রমণের সময় নবী ﷺ আমার প্রতি সীমাহীন মায়া মমতা দেখিয়েছিলেন। সে সময় আমার বয়স কম ছিল তাই প্রায় সময়ই হাওদাতে বসে থাকতে থাকতে আমার তন্দ্রা এসে যেত আর আমার মাথা কাঠের হাওদাতে বাড়ি খেত। নবী ﷺ অনেক ভালবাসা আর মমতার সাথে আমার মাথা ধরে রাখতেন আর বলতেন, ‘ওহে হুয়ায়ের কন্যা! নিজের দিকে খেয়াল রাখ, না হয় ঘুমিয়ে কিংবা ঝিমিয়ে পড়ে ব্যাথা পাবে।’ [16]
-একবার ভ্রমণের সময় সাফিয়া(রাঃ) আর রাসূল ﷺ উট থেকে পড়ে যান। আবু তালহা(রাঃ) দৌড়ে রাসূল ﷺ এর কাছে গেলে তিনি তাঁকে প্রথমে সাফিয়া(রাঃ) এর খোঁজ নিতে বলেন। [17]
-সাফিয়া(রাঃ) বলেন, “একবার রাসূল ﷺ ঘরে এসে দেখতে পান আমি কাঁদছি। রাসূল ﷺ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে তোমার?’ আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনার কিছু স্ত্রী আপনার পরিবার আর কুরাইশদের সাথে সম্পর্কযুক্ত। তাঁরা বলে যে,তাঁরা কুরাইশদের সাথে সম্পর্কযুক্ত আর আমি একজন ইহুদির কন্যা। রাসূল ﷺ বললেন, ‘ওহে হুয়ায়ের কন্যা! এতে কান্নার কি আছে? তোমার তাদেরকে জবাব দেয়া উচিৎ ছিল, ‘কিভাবে তোমরা আমার থেকে উত্তম হতে পারো? যখন হারুন আমার পিতা, মুসা আমার চাচা আর মুহাম্মদ আমার স্বামী!’ [18]
-সাফিয়া(রাঃ) বলেন, ‘একবার রাসূল ﷺ তাঁর স্ত্রীদের সাথে হজ্বে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে আমার উট বসে পড়ল কারণ ওটা ছিল সবচেয়ে দুর্বল উট, আর তাই আমি কেঁদে ফেললাম। নবী ﷺ আমার কাছে আসলেন আর আমার চোখের জল নিজের জামা ও হাত দিয়ে মুছে দিলেন। তিনি আমাকে যতই আমাকে কাঁদতে নিষেধ করলেন, আমি ততই কাঁদতে থাকলাম।’ [19]
- একবার আয়েশা(রাঃ), সাফিয়া(রাঃ) এর খাটো অবয়ব সম্পর্কে ইংগিত করলে রাসূল ﷺ বললেন, ‘তুমি এমন একটা কথা বলেছ যেটা সমুদ্রে নিক্ষেপ করলে তা পুরো সমুদ্রের পানি দুর্গন্ধময় করার জন্য যথেষ্ট।’ [20]
- মুহাম্মদ ﷺ আজীবন সাফিয়া(রাঃ) এর প্রতি ভালোবাসা ও মমতা দেখিয়েছেন। তাইতো সাফিয়া(রাঃ) বলতেন, ‘আমি রাসূল ﷺ থেকে উত্তম ব্যক্তি কখনো দেখিনি।’[21]
কারো অবস্থা বর্ণনার সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এটা দেখা যার সম্পর্কে বলা হচ্ছে সে নিজে এই পরিস্থিতি সম্পর্কে বলে। সাফিয়া(রাঃ) কে নিপীড়িত প্রমাণ করতে ইসলাম বিদ্বেষীরা যে বিশাল বিশাল লেখা লিখে, তাঁর নিজের কথায় কিন্তু একেবারে বিপরীত চিত্র ফুটে উঠে।
রাসূল ﷺ এর মৃত্যুর পর কেমন ছিল সাফিয়া(রাঃ) এর জীবন ?
অনেকে বলতে পারে, যে মুহাম্মদ ﷺ এর ভয়েই সাফিয়া(রাঃ) অনুগত থেকেছেন। তাদের হতাশ করে বলতে হয় মহানবী ﷺ এর মৃত্যুর পর সাফিয়া(রাঃ) একই আনুগত্য দেখিয়ে গিয়েছেন। কারণ, তাঁর আনুগত্য ছিল ইসলামের প্রতি। আল্লাহর প্রতি।
- “একবার কিছু লোক রাসূল ﷺ এর স্ত্রী সাফিয়া(রা:) এর ঘরে জড় হয়েছিল। তারা আল্লাহকে স্মরণ করে কুরআন তিলওয়াত করছিল এবং সিজদা করছিল। সাফিয়া(রাঃ) তাদের ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা সিজদা করলে আর কুরআন তিলওয়াত করলে। কিন্তু (আল্লাহর ভয়ে) তোমাদের (চোখে) অশ্রু কোথায়?” [22] -
“ সাফিয়া(রাঃ) নবী পরিবারের সাথে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। তিনি ফাতেমা(রাঃ) কে তাঁর প্রতি স্নেহের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গয়না উপহার দেন। এছাড়া তিনি খায়বার থেকে যে গয়না এনেছিলেন তা নবীপত্নীদের উপহার দেন।” [23]
-“সাফিয়া(রাঃ) খুবই দানশীল ও উদার রমণী ছিলেন। তিনি আল্লাহর জন্য তাঁর যা আছে তাঁর সবই দান করতেন, অবস্থা এমন হয়েছিল যে তিনি জীবিত থাকা অবস্থাতেই তাঁর বাড়ি দান করে যান।” [24]
- প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ইবনে কাসির(রহ:) তাঁর সম্পর্কে বলেন, “ইবাদত, ধার্মিকতা, দুনিয়াবিমুখীতা এবং দানশীলতায় তিনি ছিলেন অন্যতম সেরা নারী।” [25]
প্রায় সব ইসলাম-বিদ্বেষীরাই সাফিয়া(রাঃ) এর সাথে রাসূল এর বিয়ে নিয়ে নিজেদের কল্পনার রং ছড়িয়ে গল্প বলার চেষ্টা করে। তাদের গল্পটা এমন- ‘যুদ্ধবাজ মুহাম্মদ ﷺ বিনা কারণে খায়বার দখল করেন আর সাফিয়া(রাঃ) এর নিরাপরাধ পিতা ও স্বামীকে হত্যা করেন। অতঃপর সাফিয়া(রাঃ) কে নিজের পিতার লাশ মাড়িয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। নারীলোভী হবার কারণে ইদ্দতের সময়টুকু অপেক্ষা না করেই সাফিয়া(রাঃ)কে ধর্ষণ করেন।’[নাউজুবিল্লাহ]
তাদের বলা গল্প অনেকটা-‘আনিস সাহেব রাতের বেলায় এক যুবতী নারীর বাসায় গেলেন। নারীটি তখন বাসায় একা ছিল।’ এই টাইপের হয়ে যায়। অধিকাংশ সময়েই নিজেদের কথা ঢুকিয়ে তারা গল্পটিকে বিকৃত করে ফেলে। এ কারণে প্রসঙ্গসহ দুই পক্ষের বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইতিহাস জানাটা জরুরী। সকল প্রশংসা আল্লাহতায়ালার যিনি মুসলিমদের এমন কিছু স্কলার দান করেছেন যারা বিশুদ্ধতার ক্ষেত্রে খুবই খুঁতখুঁতে ছিলেন। যার কারণে ইসলামের ইতিহাসের ক্ষেত্রে জালিয়াতির সুযোগ খুব কম, বড়জোর সম্ভব ইতিহাসটিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা।
অধিকাংশ নাস্তিক ও ইসলাম-বিদ্বেষীরা নিজেদের ট্রুথ-সিকার হিসেবে উপস্থাপন করে। তাদের দাবী হচ্ছে, তারা সত্য খুঁজে খুঁজে আজকের অবস্থানে এসেছে, যেখানে আস্তিকরা কেবল অন্ধ-অনুসরণ করে। ট্রুথ-সিকার তো সে যে নিরেপক্ষ থেকে সকল উৎস থেকে সত্য জানার চেষ্টা করে। একপেশে তথ্য তো কেবল প্রবঞ্চনাই নিয়ে আসে যদি না তাতে সত্য থাকে।
অবশ্য আলোর জানালা বন্ধ করে যারা সত্য খোঁজে তাদের প্রবঞ্চনা ছাড়া কিছু পাওয়াও উচিৎ না।
তথ্যসূত্রঃ
[1] Ibn Hisham, As-Sirah an-Nabawiyyah, vol. 2, pp. 257-258
এই হাদিসের সনদ বলিষ্ঠ (سنده قوي)
- সহীহি মিন আহাদিসিস সিরাতিন নাবাবিয়্যাহ - মুহাম্মাদ আস সওইয়ানি, পৃষ্ঠা ১৭০
https://shamela.ws/book/123669/170
https://islamhouse.com/ar/books/2824356/
[2] Holy Bible, Isaiah, 42 :1-2
[3] When the Moon split-Shafiur Rahman Mubarakpuri,page-319
[4] Holy Bible, Song of Solomon 5:16
[5] Holy Bible, Deuteronomy 9:24
[6] http://www.quraneralo.com/islam-and-slavery/
[7] সহীহ বুখারী, খন্ড ১ অধ্যায় ৮ হাদীস নং ৭৬৩
[8] সীরাত ইবনে হিশাম, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৫৩
[8.5] রাহিকুল মাখতুম - শফিউর রহমান মুবারকপুরী (তাওহিদ পাবলিকেশন্স), পৃষ্ঠা ৪২০
https://www.hadithbd.com/books/detail/?book=43&chapter=6334
[8.75] সীরাত বিশ্বকোষ - ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫১
[9] যাদুল মা’আদ-হাফিজ ইবনুল কাইয়্যুম,পৃষ্ঠা-৩১৫
[10] সিলসিলা সহীহাহ-আলবানী, হাদীস নং-২৭৯৩
মূল আরবিঃ
قالت : و ما كان أبغض إلي من رسول الله ، قتل أبي و زوجي ، فما زال يعتذر إلي ، فقال : فذكره ، [ قالت : ] حتى ذهب ذاك من نفسي .
https://carihadis.com/Silsilah_Shahihah_Albani/2793
অথবা আর্কাইভকৃতঃ https://archive.is/wip/TSgPS
[10.1] সীরাত বিশ্বকোষ - ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮৪
[10.5] সুনানুল কুবরা নাসাঈ ৮৬৪৬, মুসনাদ আহমাদ ১২৪০৯ (সহীহ)
হাদিসের মূল আরবিঃ
واصْطَفى رسولُ اللهِ صلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ صَفيَّةَ بنتَ حُيَيٍّ فاتَّخذَها لنفْسِه، وخيَّرَها أنْ يُعتِقَها وتكونَ زوجتَه، أو تَلحَقَ بأهلِها، فاختارَتْ أنْ يُعتِقَها وتكونَ زوجتَه،
https://dorar.net/h/376ce8bf0c76affdfd5c1db7087f52d5
অথবা আর্কাইভকৃতঃ https://archive.is/wip/ZZK6p
আরো দেখুনঃ সীরাত বিশ্বকোষ - ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৪৮
[11] ইবনে সা’আদ, ৮/৯৭
মূল আরবিঃ
أَخْبَرَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عُمَرَ. حَدَّثَنِي إِبْرَاهِيمُ بْنُ جَعْفَرٍ عَنْ أَبِيهِ قَالَ: [لَمَّا دَخَلَتْ صَفِيَّةُ عَلَى النَّبِيَّ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - قَالَ لَهَا: لَمْ يَزَلْ أَبُوكِ مِنْ أَشَدِّ يَهُودَ لِي عَدَاوَةً حَتَّى قَتَلَهُ اللَّهُ.
فَقَالَتْ: يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَقُولُ فِي كِتَابِهِ: «ولا تزر وازرة وزر أخرى» . فَقَالَ لَهَا رَسُولُ اللَّهِ: اخْتَارِي. فَإِنِ اخْتَرْتِ الإِسْلامَ أَمْسَكْتُكِ لِنَفْسِي وَإِنِ اخْتَرْتِ الْيَهُودِيَّةَ فَعَسَى أَنْ أُعْتِقَكِ فَتَلْحَقِي بِقَوْمِكِ] . فَقَالَتْ: يَا رَسُولَ اللَّهِ لَقَدْ هَوَيْتُ الإِسْلامَ وَصَدَّقْتُ بِكَ قَبْلَ أَنْ تَدْعُوَنِي حَيْثُ صِرْتُ إِلَى رَحْلِكَ وَمَا لِي فِي الْيَهُودِيَّةِ أَرَبٌ وَمَا لِي فِيهَا وَالِدٌ وَلا أَخٌ. وَخَيَّرْتَنِي الْكُفْرَ وَالإِسْلامَ فَاللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِنَ الْعِتْقِ وَأَنْ أَرْجِعَ إِلَى قَوْمِي.
https://al-maktaba.org/book/1686/2749#p6
অথবা আর্কাইভকৃতঃ https://archive.is/wip/iiGXO
যদিও মুহাম্মাদ বিন উমারের (ওয়াকিদি) বর্ণনার জন্য এটি যঈফ বা দুর্বল বর্ণনা। কিন্তু পূর্বের সহীহ হাদিসের সমর্থক হিসেবে একে উল্লেখ করা হয়েছে।
[12] আবু দাউদ, হাদীস নং-২১৫৭
[13] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৮৮৯
[14] ইবনে সা’আদ, তাবাকাত। খন্ড ৮, পৃষ্ঠা ১০১
[15] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪২১১
[16] মাজমা আল জাওয়া’ইদ-আলী ইবনে আবু বকর, খন্ড ৮
[17] সহীহ বুখারী, কিতাবুল জিহাদ
[18] Muhammad ibn’ Isa at Tirmidhi, “Kitabul Manaaqib Bab Fadhlu Azwaajin Nabi,” in Al-Jami’ As-Sahih
[19] আহমাদ, খন্ড-৬,পৃষ্ঠা-৩৩৭
[20] সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৮৭৫
[21] মুসনাদ, খন্ড-১৩, পৃষ্ঠা-৩৮
[22] Abu Nu’aym al Asbahani, Hilyat al-Awliya, Vol-2, page-55
[23] ইবনে সা’আদ-তাবাকাত, খন্ড-৮, পৃষ্ঠা-১০০
[24] ইবনে সা’আদ-তাবাকাত, খন্ড-৮, পৃষ্ঠা-১০২
[25] ইবনে কাসির-আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খন্ড-৮, পৃষ্ঠা-৪৭