Pray for the world economy

সূর্যের আরশের নিচে সিজদা করা সংক্রান্ত হাদিসের পর্যালোচনা

 

অভিযোগঃ

সূর্যের আরশের নিচে সিজদা করা সংক্রান্ত হাদিসটি ইসলামবিরোধী মহলে বহুল চর্চিত। এই হাদিসটি দেখিয়ে তারা দাবি করতে চায় হাদিসের মাঝে ‘বৈজ্ঞানিক ভুল’ আছে। হাদিস বলা হয়েছে সূর্য ডোবার পর তা আল্লাহর আরশের নিচে সিজদা করে। পুনরায় উদিত হবার জন্য আল্লাহর নিকট অনুমতি চায়। ইসলামবিরোধীরা দাবি করে, আধুনিক বিজ্ঞান থেকে আমরা জানি সূর্যের চারদিকে পৃথিবী ঘোরে, “সূর্য ডোবা” বা “সূর্য উদিত হওয়া” বলে কিছু নেই। তাদের দাবিমতে সূর্য কর্তৃক নিজ কক্ষপথ ছেড়ে কোনো ঈশ্বরের আরশের নিচে চলে গিয়ে মানুষের মতো সিজদা করা এবং পুনরায় উদিত হবার জন্য অনুমতি প্রার্থনার তথ্য চরম অবৈজ্ঞানিক এবং রূপকথার গল্পের বেশি কিছু নয় (নাউযুবিল্লাহ)।   

 

জবাবঃ

ইসলামবিরোধীদের অভিযোগ পর্যালোচনার জন্য শুরুতেই আমরা হাদিসটি দেখে নিই। এই সংক্রান্ত হাদিস বুখারী, মুসলিম সহ বিভিন্ন গ্রন্থে আছে। সন্দেহাতীতভাবে এই হাদিস সহীহ।

 

عَنْ أَبِي ذَرٍّ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم لأَبِي ذَرٍّ حِينَ غَرَبَتِ الشَّمْسُ " تَدْرِي أَيْنَ تَذْهَبُ "‏‏. قُلْتُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ‏. قَالَ " فَإِنَّهَا تَذْهَبُ حَتَّى تَسْجُدَ تَحْتَ الْعَرْشِ، فَتَسْتَأْذِنَ فَيُؤْذَنَ لَهَا، وَيُوشِكُ أَنْ تَسْجُدَ فَلاَ يُقْبَلَ مِنْهَا، وَتَسْتَأْذِنَ فَلاَ يُؤْذَنَ لَهَا، يُقَالُ لَهَا ارْجِعِي مِنْ حَيْثُ جِئْتِ‏. فَتَطْلُعُ مِنْ مَغْرِبِهَا، فَذَلِكَ قَوْلُهُ تَعَالَى (‏وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَهَا ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ )‏‏"‏‏.

অর্থঃ আবূ যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী() সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় আবূ যার (রাঃ) কে বললেন, তুমি কি জানো, সূর্য কোথায় যায়? আমি বললাম, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তিনি বললেন, তা যেতে যেতে আরশের নীচে গিয়ে সিজদায় পড়ে যায়। এরপর সে পুনঃ উদিত হওয়ার অনুমতি চায় এবং তাকে অনুমতি দেওয়া হয়। আর অচিরেই এমন সময় আসবে যে, সিজদা করবে তা কবূল করা হবে না এবং সে অনুমতি চাইবে কিন্তু অনুমতি দেওয়া হবে না। তাকে বলা হবে যে পথে এসেছ, সে পথে ফিরে যাও। তখন সে পশ্চিম দিক হতে উদিত হবে--এটাই মর্ম হল আল্লাহ তাআলার বাণীঃ আর সূর্য গমন করে তার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে, এটাই পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞের নিয়ন্ত্রণ। (৩৬ : ৩৮) [1]

 

সূর্য কী করে ‘সিজদা’ করে বা অনুমতি চায়?

কুরআন ও হাদিসে ‘সিজদা’ কথাটি দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে, এর অর্থ ঠিকভাবে না বুঝেই অনেকে বৈজ্ঞানিক ভুলের অভিযোগ করে। ইসলামবিরোধীরা সূর্যের ব্যাপারে ‘সিজদা’, ‘অনুমতি প্রার্থনা’ এই কথাগুলো দেখেই দাবি করে এখানে মানুষের ন্যায় মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে সিজদা করা কিংবা মানুষের ন্যায় কথা বলে অনুমতির কথা বোঝানো হচ্ছে, অথচ সূর্য তো একটি নক্ষত্র। আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে আমরা জানি যে নক্ষত্র কখনো মানুষের ন্যায় এসব কাজ করে না, অতএব হাদিসে রূপকথা আছে (নাউযুবিল্লাহ)! মূলত ইসলামের এসব সমালোচকরা কুরআন ও হাদিসে ব্যবহৃত পরিভাষাগুলো সম্পর্কে অজ্ঞ। আল কুরআন অনুযায়ী আসমান ও যমীনের সব কিছুই আল্লাহ তা’আলাকে ‘সিজদা’ করছে। এই সিজদাকারীদের মাঝে জীব, জড় সবকিছুই আছে।

 

وَلِلَّهِ يَسْجُدُ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ طَوْعًا وَكَرْهًا وَظِلَالُهُم بِالْغُدُوِّ وَالْآصَا

অর্থঃ “আর আল্লাহর জন্যই আসমানসমূহ ও যমীনের সবকিছু অনুগত ও বাধ্য হয়ে সিজদা করে এবং সকাল ও সন্ধ্যায় তাদের ছায়াগুলোও।” [2]

 

أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ يَسْجُدُ لَهُ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَمَن فِي الْأَرْضِ وَالشَّمْسُ وَالْقَمَرُ وَالنُّجُومُ وَالْجِبَالُ وَالشَّجَرُ وَالدَّوَابُّ وَكَثِيرٌ مِّنَ النَّاسِ ۖ وَكَثِيرٌ حَقَّ عَلَيْهِ الْعَذَابُ ۗ وَمَن يُهِنِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِن مُّكْرِمٍ ۚ إِنَّ اللَّهَ يَفْعَلُ مَا يَشَاءُ

অর্থঃ “তুমি কি দেখ না যে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদা করে যা কিছু রয়েছে আসমানসমূহে এবং যা কিছু রয়েছে যমীনে, সূর্য, চাঁদ, তারকারাজী, পর্বতমালা, বৃক্ষলতা, জীবজন্তু ও মানুষের মধ্যে অনেকে। আবার অনেকের উপর শাস্তি অবধারিত হয়ে আছে। আল্লাহ যাকে অপমানিত করেন তার সম্মানদাতা কেউ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ যা ইচ্ছা তাই করেন।[3]

 

( 48 )   أَوَلَمْ يَرَوْا إِلَىٰ مَا خَلَقَ اللَّهُ مِن شَيْءٍ يَتَفَيَّأُ ظِلَالُهُ عَنِ الْيَمِينِ وَالشَّمَائِلِ سُجَّدًا لِّلَّهِ وَهُمْ دَاخِرُونَ

( 49 )   وَلِلَّهِ يَسْجُدُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ مِن دَابَّةٍ وَالْمَلَائِكَةُ وَهُمْ لَا يَسْتَكْبِرُونَ

অর্থঃ "তারা কি লক্ষ্য করে না আল্লাহর সৃষ্ট বস্তুর প্রতি, যার ছায়া ডানে ও বামে ঢলে পড়ে একান্ত অনুগত হয়ে আল্লাহর প্রতি সিজদাবনত হয়? আর আল্লাহকেই সিজদা করে যা কিছু আছে আসমানসমূহে ও যমীনে, যত জীবজন্তু আছে সেসব এবং ফিরিশতাগণও, তারা অহংকার করে না।[4]

 

وَالنَّجْمُ وَالشَّجَرُ يَسْجُدَانِ

অর্থঃ “আর তারকা ও গাছ-পালা সিজদা করে।[5]

 

আয়াতগুলোতে বলা হচ্ছে শুধু মানবজাতিই না বরং চাঁদ, সূর্য, তারকারাজি, পর্বতমালা, গাছ-পালা, জীবজন্তু, ফেরেশতা তথা আসমান ও জমিনের সবকিছু এমনকি তাদের ছায়াও আল্লাহ তা’আলাকে ‘সিজদা’ করছে। আয়াতগুলোর সরল অনুবাদ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ‘সিজদা’ শব্দ দ্বারা সবসময়ে মানুষ যেভাবে সিজদা করে সেটিকে বোঝানো হচ্ছে না। এই সরল অনুবাদ থেকেই ইসলামবিরোধীদের আনিত ‘বৈজ্ঞানিক ভুল’ (!) এর অভিযোগের অসারতা বোঝা যাচ্ছে। ইসলামবিরোধীরা অভিযোগ করে নবী() এর যুগে মানুষ সূর্য বা অন্যান্য নক্ষত্রের ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক ধারণা রাখতো না বিধায় তিনি সূর্যের ব্যাপারে ভুলভাল কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছেন (নাউযুবিল্লাহ)। কিন্তু সে যুগে মানুষ সূর্যের ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান না রাখলেও না রাখলেও গাছপালার ব্যাপারে অন্তত এটা জানতো যে এগুলো নড়াচড়া করে না বা মানুষের ন্যায় ঝুঁকে সিজদা করে না। কিন্তু আল কুরআনে স্পষ্টত বলা হয়েছে যে গাছপালাও ‘সিজদা’ করে! এ থেকে বোঝা গেল কুরআন-হাদিসে ‘সিজদা’ পরিভাষার দ্বারা সর্বদা মানুষের ন্যায় কপাল ঠেকিয়ে সিজদাকে বোঝানো হয় না বরং এর ব্যাপক অন্য কোনো অর্থ আছে।

 

‘সিজদা’ দ্বারা তবে কী বোঝানো হচ্ছে?

“সিজদা মানে আনুগত্য প্রকাশ করার জন্য ঝুঁকে পড়া, আদেশ পালন করা এবং পুরোপুরি মেনে নিয়ে মাথা নত করা। পৃথিবী ও আকাশের প্রত্যেকটি সৃষ্টি আল্লাহর আইনের অনুগত এবং তাঁর ইচ্ছার চুল পরিমাণও বিরোধিতা করতে পারে না -এ অর্থে তারা প্রত্যেকেই আল্লাহকে সিজদা করছে।“ [6]

 

সুরা হজের ১৮ নং আয়াতের তাফসিরে ইমাম ইবন কাসির(র.) উল্লেখ করেছেন,

 

আল্লাহ্ তা'আলা ইরশাদ করেন : কেবলমাত্র তিনিই যাবতীয় ইবাদতের উপযোগী অন্য কেহ নহে। তাঁহারই আযমত ও বড়ত্বের কারণে সকল বস্তু তাঁহার সম্মুখে সিজদাবনত। তবে সকলের সিজদার ধরণ এক নহে। প্রত্যেক বস্তুর সিজদা তাহার অবস্থানুসারে হইয়া থাকে। ... আল্লাহ্ তা'আলা এই আয়াতে বিশেষ কয়েকটি জিনিসের উল্লেখ করিয়াছেন, কারণ উল্লিখিত জিনিসগুলোর কেবল ইবাদত করা হইত। এইগুলির সিজদার কথা উল্লেখ করিয়া আল্লাহ্ তা'আলা ইহা বুঝাইয়াছেন যে, যেই চন্দ্র, সূর্য ইত্যাদির তোমরা উপাসনা কর, প্রকৃত প্রস্তাবে উহারা আল্লাহর ইবাদত করে এবং তাঁহার হুকুম পালন করে[7]

এই আলোচনার পর ইবন কাসির(র.) সূর্যের আরশের নিচে সিজদার হাদিসটিও উল্লেখ করেছেন।

 

‘সিজদা’ বলতে কী বোঝায়? সৃষ্টিজগতে মানুষ বাদে অন্য কারো ‘সিজদা’র কথা উল্লেখ থাকার অর্থ কি এই যে তাদের ব্যাপারে মানুষের ন্যায় মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে সিজদা করা বোঝানো হচ্ছে? এ ব্যাপারে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবন তাইমিয়া(র.) বলেছেন,

 

وَمَعْلُومٌ أَنَّ سُجُودَ كُلِّ شَيْءٍ بِحَسَبِهِ لَيْسَ سُجُودُ هَذِهِ الْمَخْلُوقَاتِ وَضْعَ جِبَاهِهَا عَلَى الْأَرْضِ

অর্থঃ “এটি তো জানা বিষয় যে প্রতিটি বস্তু এর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুসারে ‘সিজদা’ করে। আর সৃষ্টিজগতের এসব সিজদার অর্থ এই নয় যে এরা (মানুষের মতো) মাটিতে কপাল ঠেকায়।[8]

 

তিনি এ প্রসঙ্গে আরো বলেন,

 

সিজদা হচ্ছে বিনয়ের একটি প্রকরণ। কাজেই সকল সৃষ্টির ক্ষেত্রে যে ‘সিজদা’র কথা বলা হয়, সেখানে এদের চূড়ান্ত ধরণের বিনয় এবং আনুগত্যের কথা বোঝানো হয়। কেননা প্রতিটি সৃষ্ট বস্তুই তাঁর [আল্লাহর] বড়ত্বের নিকট আত্মসমর্পণ করে, তাঁর মহান শক্তি ও ক্ষমতার সামনে আত্মসমর্পণ করে। তবে এর অর্থ এই নয় যে সকল বস্তুই মানুষ যেভাবে দেহের ৭টা অংশের সহযোগে মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে সিজদা করে, ঠিক ওভাবে সিজদা করে। বরং এই ধরণের (মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে) সিজদা তো শুধু মানবজাতির জন্য প্রযোজ্য। এমনকি কিছু (পূর্বের) উম্মত ছিল যারা নত হতো, কিন্তু (এই উম্মতের মতো) সিজদা করতো না। কিন্তু তাদের জন্য সেটিই ছিল ‘সিজদা’। যেমনটি আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,

“এবং দরজা দিয়ে নতশিরে প্রবেশ কর। আর বলঃ ‘ক্ষমা চাই।” (সুরা বাকারাহ ৫৮)

এখানে মূলত তাদেরকে (বনী ইস্রাঈল) মাথা নত করে প্রবেশ করতে বলা হয়েছিল। আর তাদের মাঝে কেউ কেউ এক পাশে সিজদা করে, যেভাবে ইহুদিরা করে থাকে। কাজেই ‘সিজদা’ কথাটি একটি শ্রেণীগত পরিভাষা (generic term)। মুসলিমদের সিজদা খুবই সুপরিচিত একটি জিনিস এবং এ কারণে অনেকেই (এই শব্দটি শুনলেই) মনে করে সব কিছু বুঝি এভাবেই ‘সিজদা’ করে![9]

 

আল কুরআনে আরো উল্লেখ আছে যে, আসমান, যমীন আর এগুলোর মাঝে যা আছে সব কিছুই আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করে। যদিও মানুষ এদের মহিমা ঘোষণা অনুধাবন করতে পারে না। এই মহিমা ঘোষণা মোটেও মানুষের মতো নয়।

 

تُسَبِّحُ لَهُ السَّمٰوٰتُ السَّبۡعُ وَ الۡاَرۡضُ وَ مَنۡ فِیۡهِنَّ ؕ وَ اِنۡ مِّنۡ شَیۡءٍ اِلَّا یُسَبِّحُ بِحَمۡدِهٖ وَ لٰکِنۡ لَّا تَفۡقَهُوۡنَ تَسۡبِیۡحَهُمۡ ؕ اِنَّهٗ کَانَ حَلِیۡمًا غَفُوۡرًا

অর্থঃ “সাত আসমান ও যমীন এবং এগুলোর অন্তর্বর্তী সব কিছু তারই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং এমন কিছু নেই যা তাঁর সপ্ৰশংস পবিত্ৰতা ও মহিমা ঘোষণা করে না; কিন্তু তাদের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা তোমরা বুঝতে পার না; নিশ্চয় তিনি সহনশীল, ক্ষমাপরায়ণ।[10]

 

কাজেই যারা হাদিসে সূর্যের সিজদা, আল্লাহর নিকট অনুমতি প্রার্থনা এগুলো দেখিয়ে দাবি করে যে এখানে মানুষের মতই এসব কাজের কথা বলা হচ্ছে, কাজেই এখানে বৈজ্ঞানিক ভুল আছে – তাদের দাবির সম্পূর্ণ ভ্রান্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত। কুরআন-হাদিসের পরিভাষা সম্পর্কে চরম অজ্ঞতার জন্যই এহেন অভিযোগের সূত্রপাত।

 

সূর্য কী করে আল্লাহর আরশের নিচে যায়? আরশের নিচে সিজদার জন্য সূর্যকে কি তার আবর্তন থামিয়ে দিতে হয় বা কক্ষপথ ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হয়?

ইতিমধ্যেই এটি আলোচনা করা হয়েছে যে সূর্যের ‘সিজদা’ মোটেও মানুষের সিজদার মতো কিছু নয়। মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু আল্লাহর হুকুমে বিভিন্ন কার্যাবলি সম্পাদন করে যাচ্ছে, তারা তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুসারে ‘সিজদা’ করছে। সূর্যও এর ব্যতিক্রম নয়। এই বিষয়টি অনুধাবন করলেই আরশের নিচে সূর্যের সিজদার হাদিস থেকে কারো বৈজ্ঞানিক ভুলের অভিযোগ আনার কথা নয়। কিন্তু এরপরেও ইসলামবিরোধীরা এই বিষয়ে সম্পূরক কিছু প্রশ্ন এনে অভিযোগ উত্থাপন করতে পারে। ইসলামবিরোধীরা বারংবার এই অভিযোগ করে থাকে যে এই হাদিস অনুযায়ী সূর্যকে সিজদা করার জন্য “স্থির হতে হয়”, “কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে অন্যত্র চলে যেতে হয়” যা বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আধুনিক বিজ্ঞান থেকে আমরা জানি সূর্য অবিরাম কক্ষপথে আবর্তন করে যাচ্ছে। - ইসলামবিরোধীদের এই অভিযোগগুলো মূলত চরম অজ্ঞতা এবং অপব্যাখ্যার কারণে হয়ে থাকে।

 

হাদিস থেকে আমরা জানি যে আল্লাহ তা’আলার আরশ আসমানসমূহের উপরে। নবী() বলেছেন,

 

إنَّ اللَّهَ فوقَ عرشِهِ، وعرشُهُ فوقَ سماواتِهِ،

অর্থঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহ আরশের উপরে এবং তাঁর আরশ আসমানসমূহের উপরে[11]

 

আল্লাহর আরশ আকাশমণ্ডলীকে বেষ্টন করে আছে, আসমান থেকে আরশ উপরে। যেহেতু আরশের অবস্থান আসমানের উপরে, কাজেই আসমান বা আকাশমণ্ডলীর অভ্যন্তরের সবকিছুই আরশের নিচে। অতএব সূর্য এভাবে আরশের নিচে আছে। আরশের নিচে সিজদার জন্য সূর্যকে এর কক্ষপথে আবর্তন থামিয়ে আলাদা করে আকাশমণ্ডলীর সীমা ছাড়িয়ে কোনো জায়গায় চলে যেতে হয় না। কক্ষপথে আবর্তনরত অবস্থাতেই সূর্য এই কাজগুলো করে। এ ব্যাপারে সালাফদের যুগ থেকে এবং পূর্বযুগের ইমামদের থেকে ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

 

আলোচ্য হাদিসের মধ্যেই এ প্রসঙ্গে সুরা ইয়াসিনের ৩৮ নং আয়াত উদ্ধৃত করা হয়েছে। আর এই আয়াতের ব্যাপারে সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা.) এবং ইবন আব্বাস(রা.) থেকে বর্ণিত আছে--

 

হযরত ইবন মাসউদ ও হযরত ইব্‌ন আব্বাস (রা) والشمس تجري لا مستقر لها পাঠ করেন । অর্থ হইল, সূর্য প্রদক্ষিণ করে, উহা স্থির হয় না, বরং দিবা রাত ভ্রমণ করিতে থাকে। উহা কখনও থামে না, উহার ক্লান্তিও আসে না। যেমন ইরশাদ হইয়াছে—وَسَخَّرَ لَكُمُ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ دَائِبَيْنِ আল্লাহ্ তা'আলা তোমাদের কল্যাণে চন্দ্র সূর্যকে নিয়োজিত করিয়াছেন, যাহা অবিরাম চলিতে থাকে (১৪ : ৩৩)। ذَٰلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ ইহা পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞের নিয়ন্ত্রণ। যাহার হুকুমকে কেহ বাধা দিতে পারে না। কেহ তাহার বিরোধিতা করিবার ক্ষমতা রাখে না। যিনি সমস্ত বস্তুর নড়াচড়া থামিয়া যাওয়া সম্পর্কে অবগত আছেন। সূর্যের প্রতি মুহূর্তের প্রদক্ষিণ ও উহার স্থিরতা সম্পর্কেও তিনি জানেন । তিনি উহার একটি নির্দিষ্ট গতি নির্ধারণ করিয়াছেন, যাহার বিপরীত হইতে পারে না[12]

 

ইবন আব্বাস(রা.) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে তিনি وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَّهَا (৩৬ : ৩৮) তিলাওয়াত করে এর ব্যাখ্যায় বলেন, অর্থাৎ সূর্য অবিরাম ভ্রমণ করে কখনো ক্লান্ত হয় না। এ অর্থে সূর্য চলন্ত অবস্থায়ই সিজদা করে নেয়। আর এ জন্য আল্লাহ বলেন,

لَا الشَّمْسُ يَنبَغِي لَهَا أَن تُدْرِكَ الْقَمَرَ وَلَا اللَّيْلُ سَابِقُ النَّهَارِ ۚ وَكُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ

অর্থাৎ - সূর্যের পক্ষে সম্ভব নয় চন্দ্রের নাগাল পাওয়া এবং রাতের পক্ষে সম্ভব নয় দিনকে অতিক্রম করা; এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ কক্ষপথে সন্তরণ করে। (৩৬ : ৪০) [13]

 

সাহাবীগণ থেকে আমরা আলোচনা পেলাম যে সিজদা করার জন্য সূর্য কর্তৃক এর আবর্তন থামিয়ে দিতে হয় না, এটি স্থির হয় না এবং গতির কোনো বিপরীত হয় না। বরং এর ‘সিজদা’ হয় চলন্ত অবস্থাতেই। সূর্যের সিজদা প্রসঙ্গে ‘সহীহ বুখারীর’ অন্যতম প্রাচীন ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘আ’লামুল হাদিস’ এ ইমাম খাত্তাবী(র.) [মৃত্যু ৩৮৮ হিজরী (৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দ)] উল্লেখ করেছেন,

 

وليس في هذا إلا التصديق والتسليم وليس في سجودها لربها تحت العرش ما يعوقها عن الدأب في سيرها والتصرف لما سخرت له

অর্থঃ “এখানে (আল্লাহর হুকুমের) সত্যায়ন এবং আত্মসমর্পণ ব্যতিত আর কিছু নেই। আরশের নিচে প্রতিপালক (আল্লাহ)কে সিজদা করার দ্বারা মোটেও তার কক্ষপথে নিরবিচ্ছিন্ন চলাচল এবং তার উপর যে কাজ ন্যাস্ত করা হয়েছে তা পালন ব্যাহত হয় না।[14]

 

অর্থাৎ সূর্য আরশের নিচে অবশ্যই সিজদা করে, কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে এর জন্য তাকে স্থির হতে হয় বা নিজ কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যেতে হয়। সর্বক্ষণ আরশের নিচে থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ তা’আলার নিকট সিজদা ও অনুমতি প্রার্থনার জন্য সূর্যকে এর স্বকীয় বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ কক্ষপথে আবর্তিত হওয়ার কোনো পরিবর্তন ঘটাতে হয় না। এ প্রসঙ্গে শাইখুল ইমাম ইবন তাইমিয়া(র.) বলেছেন,

 

قال: فإنها تذهب تسجد تحت العرش فتستأذن فيؤذن لها، وكأنها قد قيل لها ارجعي من حيث جئت فتطلع من مغربها " فإذا كان النبي صلى الله عليه وسلم قد أخبر أنها تسجد كل ليلة تحت العرش، فقد علم اختلاف حالها بالليل والنهار مع كون سيرها في فلكها من جنس واحد، وأن كونها تحت العرش لا يختلف في نفسه، وإنما ذلك اختلاف بالنسبة والإضافة، علم أن تنوع النسب والإضافات لا يقدح فيما هو ثابت في نفسه لا مختلف.

অর্থঃ "তিনি বললেন- সূর্য আরশের নিচে গিয়ে সিজদা করে ও অনুমতি প্রার্থনা করে, অতঃপর তাকে আবারও অনুমতি দেওয়া হয়, ঠিক যেনো তাকে এটাই বলা হয় যে, তুমি যেখান থেকে এসেছো সেখানে ফিরে যাও, অতঃপর সে আবারও তার অস্তের জায়গা থেকে (পশ্চিম দিক থেকে) উদয় হয়।

সুতরাং নবী() এখানে সংবাদ দিলেন যে সূর্য প্রতি রাতেই আরশের নিচে সিজদা করে। এ থেকে এটিও বোঝা গেলো যে, দিন ও রাতে এর অবস্থানের পরিবর্তন হয়ে থাকে যদিও সে তার এক কক্ষপথেই আবর্তিত হয়, এবং একই সাথে সার্বক্ষণিক আরশের নিচে থাকাটা তার স্বকীয়তার মাঝে কোনো প্রভাব ফেলে না। এখানে শুধুই সূর্যের সাথে অন্য কোনো কিছুর সম্পৃক্ততার বৈচিত্র্য ঘটে, আর এটা তো জ্ঞাত বিষয় যে, কোনো কিছুর সাথে কোনো কিছুর সম্পৃক্ততার বৈচিত্র্যের কারণে তার মূল অবস্থান বা স্বকীয়তার মাঝে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না।[15]

 

আবু যার(রা.) বর্ণিত এই হাদিস প্রসঙ্গে ইমাম ইবন হাজার আসকালানী(র.) তাঁর সুবিখ্যাত ‘ফাতহুল বারী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,

 

ويحتمل أن يكون المراد بالسجود سجود من هو موكل بها من الملائكة، أو تسجد بصورة الحال فيكون عبارة عن الزيادة في الانقياد والخضوع في ذلك الحين.

অর্থঃ “এখানে সম্ভাবনা রয়েছে যে ‘সিজদা’ বলতে ফেরেশতাদের সিজদার কথা বোঝানো হচ্ছে যারা এর (সূর্যের) দায়িত্বে আছে। অথবা এর (সূর্যের) নিজেরই বিশেষ এক ধরনের সিজদা যা দ্বারা ঐ সময়ে এর থেকে (আল্লাহর প্রতি) অধিক বিনম্রতা ও আত্মসমর্পণ প্রকাশ পায়[16]

 

এখানে ব্যতিক্রম একটি অভিমতও আলোচিত হয়েছে। আর তা হচ্ছে, এখানে ‘সিজদা’ বলতে সূর্যের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতাদের সিজদার কথা বলা হচ্ছে। এই অভিমত গ্রহণ করা হলে হাদিসটি ব্যাখ্যা করা আরো সহজসাধ্য হয়ে যায়। ইমাম নববী(র.) তাঁর সুবিখ্যাত ‘শারহ মুসলিম’ গ্রন্থে আলোচ্য হাদিসের ব্যাখ্যায় সূর্যের সিজদা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন—

 

وأما سجود الشمس فهو بتمييز وإدراك يخلقه الله تعالى فيها .

অর্থঃ “আর সূর্যের সিজদা এমন স্বতন্ত্র প্রক্রিয়া ও স্বরূপ অনুযায়ী হয়, যেভাবে আল্লাহ একে সৃষ্টি করেছেন।[17]

 

মোট কথা, সূর্যের সিজদার সাথে মানুষের সিজদার মিল নেই। মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুসারে আল্লাহর আনুগত্য করে তথা সিজদা করে। সূর্যও তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুসারে আল্লাহর হুকুমে নিজ কাজ করে যাচ্ছে এবং সিজদা করছে। সালাফ এবং পূর্বযুগের ইমামদের ব্যাখ্যাগুলো থেকে এই বিষয়টি পরিষ্কার। এই ব্যাখ্যাগুলো আধুনিক বিজ্ঞান চর্চার যুগের বহুকাল আগে করা হয়েছে। যেসব ইসলামবিরোধী এক্টিভিস্ট সূর্যের সিজদাকে মানুষের সিজদার সাথে মিলিয়ে হাদিস থেকে ‘বৈজ্ঞানিক ভুল’ এর অভিযোগ তোলে, তাদের অভিযোগ সম্পূর্ণরূপে অসার ও ভিত্তিহীন।

 

সূর্য ‘অস্ত যাওয়া’ এবং ‘উদয় হওয়া’ সংক্রান্ত হাদিসের বক্তব্যঃ

আলোচ্য হাদিসে উল্লেখ আছে সূর্য ‘অস্ত যায়’, আবার ‘উদয় হওয়া’র জন্য অনুমতি চায়। ইসলামবিরোধীরা এই বিষয়গুলোর দিকে ইঙ্গিত করে দাবি করে এগুলো বৈজ্ঞানিক ভুল। কেননা আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে আমরা জানি যে পৃথিবী স্থির নয়, তা সূর্যের চতুর্দিকে ঘোরে। সূর্যের চতুর্দিকে পৃথিবীর আবর্তনের জন্য আমাদের দৃষ্টিতে মনে হয় সূর্য উদিত হচ্ছে বা অস্ত যাচ্ছে। সূর্য নিজে উদিত হয় না বা অস্ত যায় না। আলোচ্য হাদিসে পৃথিবীকে স্থির আর সূর্যকে উদয়-অস্তকারী গতিশীল বস্তু বলে ভুল তথ্য দেয়া হচ্ছে। - এই হচ্ছে তাদের দাবি। কিন্তু এহেন দাবিকারীরা ইসলামী পরিভাষা, বিজ্ঞান কোনোটির প্রতিই ইনসাফ করে না। সূর্য উদয় বা অস্ত যাওয়া (Sunrise, Sunset) এগুলো যে কোনো ভাষাতেই প্রচলিত সাধারণ কিছু শব্দ। এর দ্বারা সূর্য আমাদের দৃষ্টির মাঝে থাকা বা দৃষ্টির আঁড়ালে চলে যাওয়া বোঝায়। এ থেকে ‘বৈজ্ঞানিক ভুল’ খুঁজলে যে কোনো ভাষার বহু গ্রন্থ থেকেই অজস্র “বৈজ্ঞানিক ভুল” (!) বের করা যাবে।

 

আরবি ভাষায় এ সংক্রান্ত শব্দের ব্যবহার প্রসঙ্গে ইমাম খাত্তাবী(র.) [মৃত্যু ৩৮৮ হিজরী (৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দ)] বলেছেন,

 

ويُقالُ: للرَجُل اغرُب عنّي أي ابعُد وغرَبت الشَمْسُ إذَا غابَتْ فبَعُدَتْ عَنِ الأبْصار.

অর্থঃ “কোনো মানুষের ক্ষেত্রে যখন বলা হয় “اُغْرُبْ عَنّي” (উগরুব আন্নি) এ দ্বারা বোঝানো হয় “দূর হও”। আর “غَرَبَتِ الشَّمْسُ” (গারাবাতিশ শামস) বা সূর্য ডুবেছে তখন বলা হয় যখন এটি অনুপস্থিত থাকে, দৃষ্টি থেকে দূরে থাকে[18]

 

এরপরেও যদি ইসলামবিরোধীরা তর্ক করতে চায় তবে আমরা তাদেরকে পদার্থবিজ্ঞানের আলোকে উত্তর দেবো। পাঠকদের জন্য তাই এখন পদার্থবিজ্ঞানের গতিবিদ্যা থেকে প্রাথমিক কিছু জিনিস বলি। কোনো বস্তুর গতি বর্ণনার জন্য প্রথমেই আমাদেরকে একটি স্থানাঙ্কব্যবস্থা বা প্রসঙ্গ কাঠামো বেছে নিতে হয়। যে দৃঢ় বস্তুর সাপেক্ষে কোনো স্থানে কোনো বিন্দু বা বস্তুকে সুনির্দিষ্ট করা হয় তাকে প্রসঙ্গ কাঠামো (Reference Frame) বলা হয়। [19] পদার্থবিজ্ঞান বলে, কোনো বস্তু স্থিতিশীল না গতিশীল তা বোঝার জন্য বস্তুর আশপাশ থেকে আর একটা বস্তুকে নিতে হয় যাকে বলা হয় প্রসঙ্গ বস্তু। এ প্রসঙ্গ বস্তু ও আমাদের আলোচ্য বস্তুর অবস্থান যদি সময়ের সাথে অপরিবর্তিত থাকে তাহলে আলোচ্য বস্তুটি প্রসঙ্গ বস্তুর সাপেক্ষে ‘স্থির’ বলে ধরা হয়। আলোচ্য বস্তু ও প্রসঙ্গ বস্তু যদি একই দিকে একই বেগে চলতে থাকে তাহলেও কিন্তু সময়ের সাথে বস্তুদ্বয়ের মধ্যবর্তী দূরত্বের কোনো পরিবর্তন হবে না, যদিও প্রকৃতপক্ষে বস্তুটি গতিশীল। এ মহাবিশ্বে এমন কোনো প্রসঙ্গ বস্তু পাওয়া সম্ভব নয়, যা প্রকৃতপক্ষে স্থির রয়েছে। আমরা যখন কোনো বস্তুকে স্থিতিশীল বা গতিশীল বলি তা আমরা কোনো আপাত স্থিতিশীল বস্তুর সাপেক্ষে বলে থাকি। কোনো বস্তু স্থির না গতিশীল তা বোঝার জন্য আমরা কোনো স্থির বস্তুর সাথে তুলনা করে থাকি। যেহেতু মহাবিশ্বে পরম স্থিতিশীল কোনো বস্তু পাওয়া যায় না, তাই আমাদেরকে কোনো বস্তুর গতি অপর গতিশীল বস্তুর গতির সাথে তুলনা করে বুঝতে হয়। দুইটি চলমান বস্তুর একটির সাপেক্ষে অপরটির গতিকে আপেক্ষিক গতি বলে। [20]

 

আমরা যদি নিজেদেরকে যদি প্রসঙ্গ কাঠামো (Reference Frame) হিসেবে ধরি, তাহলে আমাদের সাপেক্ষে পৃথিবীও ‘স্থির’ কেননা পৃথিবী আমাদের সবাইকে নিয়ে সমান গতিতে গতিশীল। পৃথিবীকে যদি প্রসঙ্গ কাঠামো ধরা হয়, তাহলে পৃথিবীর সাপেক্ষে সুর্য ‘গতিশীল’, কেননা পৃথিবীর সাথে সুর্যের আপেক্ষিক গতি আছে। পৃথিবীর মানুষেরা পৃথিবীকে প্রসঙ্গ কাঠামো ধরে সহজেই এটি বলতে পারে যে পৃথিবীর সাপেক্ষে সূর্য ‘উদয় হয়’ বা ‘অস্ত যায়’। এই কথার মাঝে কোনো বৈজ্ঞানিক ভুল নেই। হাদিসে যখন কিয়ামতের পূর্বে পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদয়ের কথা বলা হয়, তখন পৃথিবীর সাপেক্ষে সুর্যের উদয় হবার কথাই বলা হয়। কুরআন এবং হাদিসের অনুসরণকারী হচ্ছে পৃথিবীর মানুষ। পৃথিবীর একজন মানুষ মুহাম্মাদ()কে আল্লাহ তা’আলা ওহী প্রদান করেছেন। পৃথিবীর মানুষের জন্য কুরআন বা হাদিসে এমন শব্দমালা যদি ব্যবহার করা হয়, এতে সমস্যার কিছুই নেই। এই স্বাভাবিক জিনিস থেকে যারা ‘বৈজ্ঞানিক ভুল’ (!) খোঁজে, তারা হয় অজ্ঞ নাহলে জ্ঞানপাপী।

 

আলোচ্য হাদিসে মানবজাতিকে কী বার্তা দেয়া হয়েছে?

ইসলামবিরোধীরা যেমন কুরআন-হাদিস থেকে অতিমাত্রায় ‘বৈজ্ঞানিক ভুল’ খোঁজে, তেমনি অনেক মুসলিম আছে যারা কুরআন-হাদিস থেকে অতিমাত্রায় ‘বৈজ্ঞানিক মিরাকল’ খোঁজে। এই কাজগুলো করতে গিয়ে কুরআন-হাদিসের মূল বার্তাটাই অনেকে বুঝতে পারে না। বিজ্ঞানের কাজ মূলত বস্তুজগত নিয়ে। বিজ্ঞান প্রকৃতির নানা রহস্যের উদঘাটন করে। কুরআন-হাদিস পৃথিবীর মানুষকে তার স্রষ্টার সন্ধান দেয়। মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুকে যে মহান স্রষ্টা আল্লাহ তা’আলাই সৃষ্টি করেছেন এবং এগুলোর মাঝে বিদ্যমান নিয়ম-কানুনগুলো যে আল্লাহ তা’আলারই সৃষ্টি, কুরআন-হাদিস এই বিষয়ের দিকে বারংবার মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মানুষকে মহান আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সূর্য এবং আর সব মহাজাগতিক বস্তু মহান আল্লাহ তা’আলার হুকুমে তাঁরই অনুগত হয়ে নিজ কার্যবলী পরিচালনা করে। এগুলো আল্লাহ তা’আলার বড়ত্বের প্রকাশ। মানুষের উচিত সেই আল্লাহরই ইবাদত করা।     

 

এ প্রসঙ্গে শায়খ আব্দুর রহমান মু’আল্লিমি আল ইয়ামানী(র.) বলেছেন,

 

ومهما يكن هذا السجود فإنه يدل على الانقياد التام، والشمس منقادة لأمر ربها بهذا، وانحطاطها في رأي العين إلى أسفل أجدر بأن يسمى سجوداً، والمأمور يعمل إذا انقاه، وشأنه الانقياد دائماً، فشأنه عند توقع أن يؤمر بتركه أن يستأذن

অর্থঃ “এই সিজদা যাই হোক, এর দ্বারা পরিপূর্ণ আনুগত্যকে বোঝানো হয়। সূর্য চিরকালই এর প্রতিপালকের আদেশের অনুগত। চোখের দৃষ্টি থেকে আঁড়ালে নিচে চলে যাওয়াকে ‘সিজদা’ বলে ডাকাই অধিক উপযোগী। ভৃত্যকে যখনই আদেশ দেয়া হয়, সে কাজ করে। চিরকালই আদেশ পালন করে যাওয়াই তার বৈশিষ্ট্য। তার অবস্থা হল, যখন বিরত হবার আদেশ প্রত্যাশা করা হয়, তখন সে অনুমতি প্রার্থনা করে।[21]

 

সুরা হজের ১৮ নং আয়াতে সূর্য সহ বহু কিছুর সিজদার কথা আলোচনা করা হয়েছে। এ স্থলে তাফসির আবু বকর যাকারিয়াতে উল্লেখ আছে,

 

“আসমান যমীনে যত কিছু আছে যেমন ফেরেশতা, যাবতীয় জীবজন্তু সবাই আল্লাহকে সিজদা করে বা তাঁর আনুগত্য করে। অনুরূপভাবে সূর্য, চন্দ্র ও তারকাসমূহও আল্লাহর আনুগত্য ও সিজদা করে। সূর্য, চন্দ্র ও তারকাসমূহকে আলাদাভাবে বর্ণনা করার কারণ হচ্ছে, আল্লাহ ব্যতীত এগুলোর ইবাদাত করা হয়েছিল, তাই জানিয়ে দেয়া হলো যে, তোমরা এদের পূজা কর, অথচ এরা আল্লাহর জন্য সিজদা করে। অন্য আয়াতে সেটা স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, “তোমরা সূর্যকে সিজদা করো না, চাঁদকেও নয় ; আর সিজদা কর আল্লাহকে, যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা কেবলমাত্র তাঁরই ইবাদাত কর। [সূরা ফুসসিলাত: ৩৭] [ইবন কাসীর] ” [22]

 

উপসংহারঃ

বস্তুবাদী মানুষ আল্লাহর স্মরণে গাফেল হয়, অথবা আল্লাহ তা’আলাকেই অস্বীকার করে। এরা এ কারণেই আল্লাহ তা’আলা তাঁর নবী মুহাম্মাদ()কে যে ওহী প্রদান করেছেন, সে ওহীকে অপব্যাখ্যা করে, তা থেকে ‘ভুল’ (!) বের করবার জন্য নানা অপচেষ্টা করে। কিন্তু বাস্তব সত্যের সামনে সেইসব অপব্যাখ্যার প্রাসাদ বালির ঘরের মতো ভেঙে যায়। সুর্য যেভাবে তার প্রতিপালকের আনুগত্যে কোনো অলসতা করে না, আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকেও তেমনি নিরলসভাবে তাঁর আনুগত্য করবার তাওফিক দিন।

 

আরো পড়ুনঃ

সূর্য ঘোরে নাকি পৃথিবী ঘোরে? সূর্য কি আরশের নিচে সিজদা করে?

 

 

তথ্যসূত্রঃ


[1] সহীহ বুখারী, হাদিস নং : ২৯৭২

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=3102

[2] আল কুরআন, রা'দ ১৩ : ১৫

[3] আল কুরআন, হজ ২২ : ১৮

[4] আল কুরআন, নাহল ১৬ : ৪৮-৪৯

[5] আল কুরআন, আর-রহমান ৫৫ : ৬

[6]তাফসির আবু বকর যাকারিয়া, সুরা রা'দের ১৫ নং আয়াতের তাফসির

https://www.hadithbd.com/quran/link/?id=1722

[7]তাফসির ইবন কাসির, ৭ম খণ্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, সুরা হজের ১৮ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ৪১০

[8]মাজমুউল ফাতাওয়া – ইবন তাইমিয়া, খণ্ড ২১, পৃষ্ঠা ২৮৪

https://shamela.ws/book/7289/10689

অথবা https://archive.is/wip/qofhn (আর্কাইভকৃত)

আরো দেখুনঃ "The prostration of everything in the universe to Allaah" (IslamQA - Shaykh Muhammad Saalih al-Munajjid)

https://islamqa.info/en/27036/

অথবা https://archive.is/wip/gsmYC  (আর্কাইভকৃত)

[9]জামিউর রাসাইল – ইবন তাইমিয়া, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২৭-২৮

https://shamela.ws/book/22653/27

https://shamela.ws/book/22653/28

আরো দেখুনঃ "The prostration of everything in the universe to Allaah" (IslamQA - Shaykh Muhammad Saalih al-Munajjid)

https://islamqa.info/en/27036/

অথবা https://archive.is/wip/gsmYC  (আর্কাইভকৃত)

[10] আল কুরআন, আল-ইসরা (বনী-ইসরাঈল) ১৭ : ৪৪

[11] মুখতাসার সওয়াইকুল মুরসালাহ - ইবনুল কাইয়িম জাওযিয়্যাহ, পৃষ্ঠা ৪৩৪ (হাসান)

https://dorar.net/h/eiQKqcPn

অথবা https://archive.is/wip/uEdtg  (আর্কাইভকৃত)

আরো দেখুনঃ https://dorar.net/h/k9VZMSvJ

https://dorar.net/h/cZww2VTl

[13] তাফসির ইবন কাসির, ৯ম খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), সুরা ইয়াসিনের ৩৮ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ৩৫৯

[14] আ’লামুল হাদিসআবু সুলায়মান হামদ ইবনে মুহাম্মদ আল-খাত্তাবী, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ১৮৯৪

https://shamela.ws/book/16946/1795

অথবা  https://archive.is/wip/zUDLr  (আর্কাইভকৃত)

[15]বায়ান তালবিসুল জাহমিয়্যাহ – ইবন তাইমিয়া, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৫৪

https://www.islamweb.net/ar/library/index.php?page=bookcontents&ID=617&bk_no=415&flag=1

অথবা https://archive.is/wip/LezyN (আর্কাইভকৃত)

[16]ফাতহুল বারী – ইবন হাজার আসকালানী, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ৩৪০

https://www.islamweb.net/ar/library/index.php?page=bookcontents&ID=5819&bk_no=52&flag=1

অথবা https://archive.is/wip/Y4Scr (আর্কাইভকৃত)

আরো দেখুনঃ The prostration of the sun before its Lord (Islamweb)

https://www.islamweb.net/en/fatwa/253912/

অথবা https://archive.is/wip/QDoJg (আর্কাইভকৃত)

[17] শারহে মুসলিম – আবু যাকারিয়া মুহিউদ্দিন ইয়াহইয়া নববী, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩৪৭

https://islamweb.net/ar/library/index.php?page=bookcontents&ID=466&bk_no=53&flag=1

অথবা  https://archive.is/DIzAE (আর্কাইভকৃত)

[18] গরিবুল হাদিসআবু সুলায়মান হামদ ইবনে মুহাম্মদ আল-খাত্তাবী, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৫২৯

https://shamela.ws/book/12042/750

অথবা  https://archive.is/wip/Jv1wK  (আর্কাইভকৃত)

[19] দেখুনঃ পদার্থবিজ্ঞান ১ম পত্র (একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি) – শাহজাহান তপন, পৃষ্ঠা ১৪২

https://mega.nz/folder/W5U2AQRT#qse0xujr85WG8JADIc15qQ

[20] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৩

[21] আল আনওয়ারুল কাশিফাহ লিমা ফি কিতাব ‘আদ্বওয়াউ আলাস সুন্নাহ’ আব্দুর রহমান মু'আল্লিমি আল ইয়ামানী

https://shamela.ws/book/9463/293

অথবা https://archive.is/wip/GiWf8 (আর্কাইভকৃত)

[22]তাফসির আবু বকর যাকারিয়া, সুরা হজের ১৮ নং আয়াতের তাফসির

https://www.hadithbd.com/quran/link/?id=2613