প্রায়ই ভাইয়েরা প্রশ্ন করেন, তাদের কোনো ভাই বা বন্ধু দীনের দিকে ঝুঁকছেন, কোন বই পড়তে দিবেন? অনেক ভাইবোন কমেন্টে কুরআনের নানান প্রকাশনীর তরজমা সাজেস্ট করেন। কিংবা অনেক ভাই-ই দীনের পথচলা শুরু করেন কুরআনের তরজমা দিয়ে। নিঃসন্দেহে কুরআন-ই তো আমাদের চিন্তাচেতনার মূল কেন্দ্র, মূলসূত্র। কিন্তু দীনের জ্ঞান অর্জন কুরআন দিয়ে শুরু করার ব্যাপারে আমার কিছু অভিজ্ঞতা আছে।
আমার একজন পরিচিত ব্যক্তি। হজ করে এসে দীনী জ্ঞান শুরু করলেন। কিছুদিন পর আমাকে কথায় কথায় বললেন: কুরআনের তরজমা পড়ছেন। মাহর আর যৌনকর্মীর পারিশ্রমিকের মধ্যে তিনি কোনো পার্থক্য খুঁজে পেলেন না। আরেকজন কাছের মানুষ। কুরআনের তরজমা দিয়ে শুরু। তার অনুভূতি হল: বর্তমান ইসলাম হল উগ্রবাদ, মোল্লাদের তৈরি। কুরআনের ইসলাম এতো কঠিন না। এরকম বহু নজির আপনার আশেপাশেই পাবেন। সব ভ্রান্ত ফিরকা নিজেদের মত করে কুরআন থেকেই দলিল দেয়। আবার শুধু কুরআনের উপর ভিত্তি করে ভ্রান্ত দলের অস্তিত্বও আমাদের অজানা নয়। আচ্ছা, কেন এমন হয়। সাহাবায়ে কেরামের প্রথম শিক্ষা তো কুরআনই ছিল, তারা তো বিভ্রান্ত হননি।
দুটো কারণ আছে এমন হবার—
কুরআন বুঝিয়ে দেবার কেউ থাকতে হবে। সাহাবাদের কুরআন বুঝিয়ে দিতেন খোদ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এভাবে প্রতি প্রজন্মে এই বুঝটা ট্রান্সফার হয়েছে। এই ধারাবাহিক কমন বুঝটার বাইরে নিজের মত করে বুঝতে গিয়েই সমস্যাগুলো হয়েছে। কেউ একজন থাকতে হবে যিনি আমাকে এই আদি ব্যাখ্যা (নবীজি ও সাহাবাদের বুঝটুকু) আমাকে বুঝিয়ে দেবেন। এটা সত্যি যে, ব্যস্ততার দরুণ এমন কারও কাছে বসে কুরআন পড়ে নেয়া আমাদের সম্ভব হয় না। এর একটা সমাধান হতে পারে কোনো সহজ তাফসীর (ব্যাখ্যাসহ তরজমা) নেয়া, এবং পড়ার সময় কোনো জায়গা না বুঝলে টুকে নেয়া। সেগুলো নিয়ে কোনো আলিমের কাছে সুবিধাজনক সময়ে বসে ক্লিয়ার হয়ে নেয়া। শুধুমাত্র তরজমা পড়াকে এজন্যই নিরুৎসাহিত করা হয়। কারণ প্র্যাকটিক্যাল অভিজ্ঞতা ভালো না। আর দীনের ‘পয়লা পাঠ’ হিসেবে তো আমি সরাসরি নিষেধই করব।
কেন? এটাই আমাদের দ্বিতীয় কারণ। সেটা হল, আমরা জেনারেল কারিকুলামে পড়াশুনা করেছি। যেটা বৃটিশ-প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষা-কাঠামো। এই উপমহাদেশের ট্র্যাডিশনাল শিক্ষাধারাকে পরিবর্তন করে নতুন শিক্ষা প্রবর্তন করার সময় তাদের লক্ষ্য ছিল তৈরি করা ‘এমন একটা শ্রেণী, যারা রক্তে-গায়ের রঙে তো ভারতীয়, কিন্তু রুচি-মতামত-নীতি-বিচারবুদ্ধিতে হবে ইংরেজ’ [1]। ঠিক এই শ্রেণীটাই ইংরেজ খেদানোর পর ক্ষমতায় বসেছে, পলিসি করেছে, দেশ চালিয়েছে, বই লিখেছে। শুধু এরাই শিক্ষিত শ্রেণী, বাকিসব যেন গণ্ডমূর্খ। ফলে ইংরেজ চলে গেলেও, ইংরেজের রুচি-মতামত-নীতি-বিচারবুদ্ধিতেই আমরা উঠছি-বসছি-চলছি-ফিরছি-শিখছি। জেনারেশনের পর জেনারেশন আমরা বেড়ে উঠছি ‘রঙে ভারতীয় ঢঙে ইংরেজ’ হয়ে। আর ইংরেজদের এবং ইউরোপীয়দের চিন্তাচেতনার উৎস হল— গ্রীকদের বিশ্বদর্শন আর রোমানদের সমাজ-রাষ্ট্রবোধ। ১৪শ শতকে রেনেসাঁর সময় থেকে শুরু হয় খৃষ্টধর্মের খোলস থেকে বেরিয়ে আসার এই প্রক্রিয়া, শেষ হয় ১৮শ শতকে এনলাইটেনমেন্টে এসে। স্বাধীনতা-সমতা-নৈতিকতা-নিরপেক্ষতা-প্রকৃতিবাদ এসব চিন্তাদর্শন সারা দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে তারা উপনিবেশের মওকায়। এগুলো শিখিয়ে তৈরি করেছে সেই শ্রেণী, যারা চিন্তামননে ইউরোপীয়। সেই শ্রেণীটাই আমাদের বাবাদের চিন্তাকে গড়ে তুলেছে, তারা আমাদের। প্রজন্মান্তরে আমরা সেই চিন্তাধারাই বহন করি, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়।
এই চশমা পরে যখন কেউ কুরআন পড়ে, তখন একের পর এক প্রশ্ন জাগতে থাকে মনে। কেন মেয়েরা আদ্ধেক সম্পত্তি পেল? কেন মেয়েদের সাক্ষীর দাম ছেলেদের অর্ধেক? কেন আল্লাহ যুদ্ধ করতে বললেন? কেন চার বিয়ের অনুমতি? কেন দাসদাসীর বিধান? কেন এই, কেন সেই? স্বাভাবিক। কেননা এই ইউরোপীয় মানদণ্ড প্রতি গিঁটে গিঁটে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। এই ইউরোপীয় মূল্যবোধ বা ধারণাগুলোকে ওরা আমাদের ‘চূড়ান্ত’ ‘ধ্রুব’ ‘সর্বৈব সত্য’ ‘নিপাতনে সিদ্ধ’ ভাবতে শিখিয়েছে [2]। ফলে আল্লাহর দেয়া দীন, আল্লাহর স্ট্যান্ডার্ডকে আমাদের কাছে বর্বর মনে হয়, মধ্যযুগীয় মনে হয়, সেকেলে মনে হয়। দুটো মাপকাঠির পার্থক্যটা দেখুন। একটা হল গ্রীক-রোমান প্যাগানদের চিন্তাদর্শন ‘নতুন বোতলে পুরোন মদ’। আর একটা হল স্বয়ং স্রষ্টা স্বয়ং অধিপতি পালনকর্তার প্রদত্ত, যিনি মানবমন-মানবসমাজ-মানবদেহের গতিপ্রকৃতি খোদ সৃষ্টি করেছেন। অথচ আজ আমরা মানবদর্শনের স্কেলে প্রশ্ন করছি আল্লাহর সিদ্ধান্তকে। আজ ইসলাম নিয়ে নাস্তিকদের যত প্রশ্ন, মডার্নিস্ট রিভিশনিস্ট মডারেট মুসলিমদের যত হীনম্মন্যতা সব কিছুরই উৎস এই পাশ্চাত্য মাপকাঠি ও পাশ্চাত্য ধারণাগুলোকে ‘চূড়ান্ত’ ঠাউরানোর প্রবণতা। এটাই সব প্রশ্নের, সব আপত্তির উৎস।
কুরআন থেকে হিদায়াত পেতে হলে সবার আগে এই বৃটিশ-ওয়াশ মগজখানি কাউন্টার ওয়াশ দিয়ে নিউট্রালে আনতে হবে। পশ্চিমা ভৌতবিজ্ঞান যেমন প্রমাণিত, তাদের সামাজিকবিজ্ঞান তেমন প্রমাণিত কোনো জিনিস না। নিউটনের বলবিদ্যার সূত্র যেমন, পশ্চিমী অর্থনীতি-রাষ্ট্রবিজ্ঞান-সমাজবিজ্ঞানের ধারণাগুলো এমন প্রশ্নাতীত বিষয় না। তাদের পুরো সামাজিক বিজ্ঞানগুলো দাঁড়িয়ে আছে একটা সংজ্ঞার উপর—ব্যক্তি, হিউম্যান। human, person, individual— এগুলোর দার্শনিক যে সংজ্ঞা, তার উপরেই পরিবারের সংজ্ঞা, সমাজের সংজ্ঞা, রাষ্ট্রের সংজ্ঞা, অর্থনীতির সংজ্ঞা, আইনের সংজ্ঞা, অধিকার-স্বাধীনতা-সমতা-নৈতিকতা সবকিছুর ধারণা। পুরো পশ্চিমা সভ্যতা এর উপর দাঁড়িয়ে আছে, তাই পশ্চিমা চিন্তামনন বুঝতে হলে এই human-এর সংজ্ঞাটা বুঝতে হবে। humanity আর humanism-এর পার্থক্যটা জানতে হবে। এই ধারণাটা বুঝে নিলেই ইসলাম নিয়ে এতো এতো প্রশ্ন কোত্থেকে আসে, চট করে ধরে ফেলা যাবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে যে সেকুলার লিবারেল মূল্যবোধকে ‘প্রশ্নাতীত’ হিসেবে, ধর্মীয় অনুশাসনের মত ‘প্রশ্ন উঠানো ট্যাবু’ হিসেবে মনমগজে গেঁথে দেয়া হয়েছে; বিভিন্নভাবে মেনে নিতে বাধ্য করা হচ্ছে— তা ধরা দেবে উপলব্ধিতে।
এক্ষেত্রে একজন বৃটিশ-ওয়াশ মুসলিমকে প্রথম দেবার জন্য আমি একটি বই সাজেস্ট করতে পারি। তা হল উস্তায ইফতেখার সিফাত (হাফিযাহুল্লাহ) লিখিত ‘হিউম্যান বিয়িং’ বইটি। যাতে তিনি নিজেকে চিনতে পারেন— আমি কি পশ্চিমা ‘হিউম্যান’, নাকি আল্লাহর ‘আবদ’? ‘কোনটা হিসেবে আমি কবরে যেতে চাই’— এটা তো সেই আত্মজ্ঞান, যা একজন মুসলিমের প্রয়োজন বালেগ হবার সাথে সাথে। আর একজন নওমুসলিমের প্রয়োজন এই সিদ্ধান্ত কলেমা পড়ার আগেই। আল্লাহর দেয়া নৈতিকতা অস্বীকারকারী ‘হিউম্যান’ হিসেবে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করতে চাই? নাকি আল্লাহর দেয়া নৈতিকতা মেনে তাঁর দাস হিসেবে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে চাই। এ সিদ্ধান্ত তো আমাকে কুরআন পড়ার আগেই নিতে হবে।
আর নাস্তিকদের প্রশ্নে আমরা শাখাগত জবাব দিয়ে দায়মুক্ত হই। ধরেন, একজন জিগ্যেস করল: নবীজী এতো বিবাহ করেছেন কেন...(খিস্তিখেউড়)। শুধু এই প্রশ্নের জবাব পেলেই সে মুসলিম হয়ে যাবে? তার ক’টা প্রশ্নের জবাব দেবেন আপনি? নাকি তার প্রশ্নের উৎসমুখে একটা পাথর বসিয়ে দিলে ভালো হয়?
পাদটিকা
[1] ১৮৩৪ সালে ভারতে শিক্ষা প্রসারের জন্য কমিটি করা হয়। এর প্রধান ছিলেন লর্ড মেকলে। স্কীমের রিপোর্ট
Minute on Indian Education, 2nd February, 1935; Thomas Babington Macaulay, point 12
[2] Perennialism দর্শন। ‘For Perennialists, the aim of education is to ensure that students acquire understandings about the great ideas of Western civilization. These ideas have the potential for solving problems in any era. The focus is to teach ideas that are everlasting, to seek enduring truths which are constant, not changing, as the natural and human worlds at their most essential level, do not change.’ [Philosophical Perspectives in Education, Oregon State University ওয়েবসাইট]