বঙ্গদেশীয় নাস্তিক-মুরতাদ ও খ্রিষ্টান মিশনারীদের নিকট একটি প্রোপাগান্ডা বেশ মুখরোচক যে - আবদুল্লাহ ইবন সাদ নাকি বুঝতে পেরেছিলেন কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে নয় (নাউযুবিল্লাহ) তাই আবদুল্লাহ ইবন সাদ ইসলাম ত্যাগ করেছিলো।
এখানে যার কথা বলা হচ্ছে তিনি হলেন আবু ইয়াহইয়া আবদুল্লাহ ইবন সাদ ইবন সারাহ আল আমিরি আল কুরাইশী (أبو يحيى عبد الله بن سعد بن أبي السرح العامري القرشي)। তিনি উসমান(রা.) এর দুধভাই ছিলেন।
ইমাম যাহাবী(র.) [মৃ. ৭৪৮হি] তাঁর ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’ (মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ-১৪২২/২০০১) ৩/৩৩-এ আবদুল্লাহ ইবনে সাদ ইবনে আবি সারাহ সম্পর্কে লিখেছেন,
ابن أبي سرح بن الحارث، لأمير ، قائد الجيوش ، أبو يحيى القرشي العامري، من عامر بن لؤي بن غالب. هو أخو عثمان من الرضاعة .
অর্থঃ তিনি ইবনে আবী সারাহ আল হারিছ, আমির, সেনাপতি, আবু ইয়াহইয়া আল কুরাশী আল আমিরী, আমির বিন লুওয়াই বিন গালিব থেকে, তিনি উসমানের দুধভাই।[1]
তিনি প্রথমে ইসলাম গ্রহন করলেও পরে ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে যান, পরবর্তীতে তিনি মক্কা বিজয়ের দিন আবার ইসলাম গ্রহন করেন এবং তিনি জীবনের শেষ পর্যন্ত ভালো মুসলিম হিসেবে জীবনযাপন করেন। তিনি আফ্রিকা বিজয়ের নেপথ্যে ছিলেন। আর তাঁর আখলাক ও ছিলেন অত্যন্ত চমৎকার তিনি কখনোই কারো ক্ষতি করেননি, তাঁর ইসলামের ব্যাপারে ও আর কখনোই কেউ সন্দেহ করেননি। তিনি সবসময়ই আল্লাহর কাছে দুয়া করতেন তাঁর ইন্তেকাল যেন ফজরের সময়ে হয়। সালাতরত অবস্থায়ই তিনি ইন্তেকাল করেন।(রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)
কিন্তু তাঁর ব্যাপারে একটি বর্ণনা খ্রিষ্টান মিশনারী, নাস্তিক-মুক্তমনারা উল্লেখ করে থাকেন যে, তিনি নাকি কুরআনের ভুল বুঝতে পেরে ইসলাম ত্যাগ করেন অথবা কুরআনে নাকি তার কথাও আছে (আস্তাগফিরুল্লাহ)।
নিম্নে বর্ণনাটি উল্লেখ করা হলোঃ
“আবদুল্লাহ ইবন সাদ ইসলাম গ্রহন করলে রাসুলুল্লাহ(ﷺ) তাকে কুরআন লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব দেন। সে কুরআনের বাণী এদিক সেদিক করত। “সামি’আম বাসিরান” কে লিখত “আলিমান হাকিমান”, আবার “আলিমান হাকিমান” কে লিখত “গফুরুর রহীম”। একদিন নাযিল হলো: “ وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ مِن سُلَالَةٍ مِّن طِينٍ“ [ আমি মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি।] (সূরা মুমিনূন ২৩ : ১২)। আয়াতগুলো তাকে খুব মুগ্ধ করেছিলো। তখন রাসুলুল্লাহ(ﷺ) তাকে এই আয়াত লিখতে বললে সে লিখল। রাসুলুল্লাহ(ﷺ) ১৪নং আয়াতে পৌছানোর পূর্বেই সে বলে উঠলো “تَبَارَكَ اللَّهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِينَ” [নিপুণতম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ কত কল্যাণময়।] তখন রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বললেন, এটিও লিখে ফেলো কেননা এটিও ওহীর অন্তর্ভুক্ত। তখন সে(ইবনে সাদ) ভাবলো: বাহ!! আমার উপরেও তাহলে ওহী হয়!!! এই চিন্তার ফলেই সে ইসলামত্যাগী হয়ে গেলো ও মুশরিকদের দলে মিশে গেলো”
এই বর্ণনাটি সাধারনত সূরা আনআম (৬:৯৩) এর তাফসীরে বর্ণনা করা হয়। [2]
আবার এই ঘটনাটি অন্যভাবেও বর্ণিত আছে ----
“রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এর ৪২ জন কাতিবে ওহী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলো আবদুল্লাহ ইবনে আবী সারাহ। সেই কুরাইশদের মধ্যে প্রথম ছিলো যে মক্কায় ওহী লিখেছে। সে বলা শুরু করলো যে, ““আমি মুহাম্মাদকে(ﷺ) ওহী লিখতে নির্দেশনা দেই। সে যখন আমাকে “আলিয়্যিল হাকিমান” লিখতে বলে তখন আমি শুধু “হাকিমান” লিখতাম, তখন সে আমাকে বলত সবই এক। কোনো একদিন সে আমাকে বলল “এটা এটা লেখ”, আমি শুধুমাত্র “লেখ” এইভাবে লিখলাম তখন সে আমাকে বললো যা খুশি তাই লিখো তুমি।”” তখন সেই কাতিবে ওহী ইবনে আবী সা(র.)মুহাম্মাদকে (ﷺ) মিথ্যার কথা প্রকাশ করে দিয়ে কুরআনে লিখে দিলো যে “তার থেকে বড় যালিম আর কে হতে পারে যে আল্লাহর নামে কোনো কিছু আরোপ করে” (সূরা আনআম ৬:৯৩)। এরপর মক্কা বিজয়ের দিন সেই কাতিবে ওহীকে রাসুলুল্লাহ(ﷺ) তাকে হত্যার নির্দেশ দেয়। উসমান(রা.) তার নিরাপত্তা চাইলে রাসুলুল্লাহ(ﷺ) দীর্ঘক্ষন চুপ থেকে নিরাপত্তা দান করেন। উসমান(রা.) চলে যাবার পরে তিনি(ﷺ) বললেন, আমি চুপ ছিলাম যাতে তোমরা কেউ তাকে হত্যা কর।“
দুইটি বর্ণনারই বিশ্লেষণ করা হবে ইনশাআল্লাহ।
◘ ১ম বর্ণনাটি গ্রহনযোগ্য না হবার কারণঃ
(১) যেই আয়াত সম্পর্কে এই কথাটি বলা হচ্ছে সেই আয়াতটি মক্কায় নাযিল হয়েছে।[3] আর আবদুল্লাহ ইবনে সাদ ইবনে আবী সা(র.)প্রথমবার ইসলাম গ্রহন করে হিজরাতের পরে।
أسلم عبد الله بن أبي السرح أول مرة قبل صلح الحديبية وهاجر إلى المدينة المنورة وكان حسِن الإسلام وموضع ثقة النبي, وأناله النبي مهمة كتابة الوحي مع عدد من الصحابة الكتاب
“ সে প্রথমে হুদায়িবিয়াহ সন্ধির পূর্বে ইসলাম গ্রহন করেছিলো, তার ইসলাম পালন ভালোই ছিলো তিনি রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এর বিশ্বস্ততা অর্জন করেন, তাই তিনি(ﷺ) অন্যান্য সাহাবীদের সাথে তাকে কাতিবে ওহীর দায়িত্ব অর্পন করেন।” [4]
তাহলে এটি কিভাবে সম্ভব যে সে এই আয়াত লেখার দায়িত্বে ছিলেন যখন এই আয়াত মক্কায় নাযিল হয়?
(২) উমার ফারুক(রা.) থেকে সূরা মুমিনুনের তাফসীরে বর্ণিত আছে যে, চারটি বিষয়ে আমি আমার রবের আনুকূল্য করেছি যখন (وَلَقَدْ خَلَقْنَا ٱلْإِنسَـٰنَ مِن سُلَـٰلَةٍۢ مِّن طِينٍ) আয়াতটি নাযিল হয় তখন আমার মুখ থেকে স্বতস্ফূর্তভাবেই বেরিয়ে আসে (فَتَبَارَكَ ٱللَّهُ أَحْسَنُ ٱلْخَـٰلِقِينَ), পরে আমার রব এটাই নাযিল করেন।[5]
এখানেও অনুরূপ একটি ব্যাপার দেখা গেল। কিন্তু এতে করে উমার(রা.) কি কখনোও নবুওয়াত দাবি করেছেন? কিংবা তিনি কি কখনো দাবি করেছেন যে তাঁর নিকটেও ওহী আসে(আস্তাগফিরুল্লাহ)? না, কখনোই নয় বরং এটা আল্লাহর তার এক বান্দার উপরে দয়া যে আল্লাহ তাঁর বান্দার কোনো কথাকে পছন্দ করেন আর তিনি কুরআন কারীমে তাকে স্থান দেন। যদি এই বর্ণনাটি সহীহ হয়েও, থাকে তবুও এই হাদিসটি কখনোই কুরআনের কোনো ত্রুটি বলে পরিগনিত হতে পারেনা।
◘ ২য় বর্ণনাটি গ্রহনযোগ্য না হবার কারণঃ
(১) এই বর্ণনাটি পেশ করা হয়ে থাকে হাফিজ ইরাকী (র.) এর বই “আলফিয়াতুস সিরাতুন নাবাওয়্যিয়্যাহ” যেখানে হাফিজ ইরাকী ১০০০টি কবিতা দ্বারা রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এর জীবনী লিখেছেন। আগে তাদের পেশ করা দলিলের স্ক্রীনশটটি দেখে নেওয়া যাক (ইসলাবিরোধী লেখকরা এক্ষেত্রে খ্রিষ্টান মিশনারী দ্বারা পরিচালিত answeringislam সাইটটি থেকে ধার নিয়ে থাকে : -
এটা তারা হাফিজ ইরাকীর “আলফিয়্যাহ” থেকে নিয়েছে। এটা আলফিয়্যাহ’র ৭৮০ নং কবিতা থেকে শুরু হয়েছে। আমরা যদি হাফিজ ইরাকীর মূল কিতাব থেকে ৭৮০ নং কবিতা দেখি তাহলে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে যাবে। নিম্নে হাফিজ ইরাকীর ৭৮০ থেকে ৭৯০ নং পংক্তি’র স্ক্রীনশট দেওয়া হলোঃ-
এগুলো শায়খ মুহাম্মাদ আলাওয়ী আল মালিকির তাহকীককৃত আলফিয়্যাহর (দারুল মিনহাজ থেকে প্রকাশিত) ১২৩-১২৫ নং পৃষ্ঠা।
এখানে হাফিজ ইরাকী তার ৭৮০-৭৯০ পংক্তিতে রাসুলুল্লাহর (ﷺ) কাতিবে ওহী বা ওহী লেখকদের বর্ণনা দিয়েছেন, তিনি শুরু করেছেন এভাবে: “…রাসুলুল্লাহর(ﷺ) ৪২ জন কাতিবে ওহী ছিলো” তারপর তিনি এক এক করে তাদের বর্ণনা দেন।
এখানে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, ” রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এর ৪২ জন কাতিব (লেখক) ছিলো” তারা শুধুমাত্র এই অংশটি নিয়েছে মূল কিতাব থেকে (যদিও মিশনারীদের/ কলাবিজ্ঞানীদের পেশ করা ইবারত (text) এর সাথে বিস্তর ফারাক রয়েছে মূল কিতাবের, আমার দেওয়া ১ম স্ক্রীনশটের আন্ডারলাইনকৃত অংশটির সাথে ওদের প্রথম লাইন পড়লেই বোঝা যাবে) এরপর আর কিছুই মিল নেই ইরাকীর মূল কিতাবের সাথে।
তাহলে কি হাফিজ ইরাকী তার কিতাবে ইবনে আবী সারাহ’র কোনো কথা বলেননি??
বলেছেন; তবে অন্যভাবে। তাঁর ভাষ্য অনেকটা এরকম “তিনজন প্রথমদিকে ওহী লিখলেও পরবর্তীতে মুরতাদ হয়ে যায়। তারা হলো ইবনে আবী সারাহ, ইবনে খাতাল ও আরেকজনের নাম অজ্ঞাত। ইবনে আবী সারাহ ছাড়া তাদের আর কেউই দ্বীনে ফিরে আসেনি, তারা পথভ্রষ্ট অবস্থাতেই ছিল”। নিম্নে এই অংশের স্ক্রীনশট দেওয়া হলোঃ-
(২) রাসুলুল্লাহর(ﷺ) ৪২ জন কাতিবের মধ্যে শুধুমাত্র ১ জনকেই কেন নিজের ইচ্ছামত যা খুশি তাই লিখার অনুমতি দিলেন? অন্য ৪১ জনকে কেন অনুমতি দিলেন না?
(৩) হাদিসে এসেছে যে, [6] ইবনে আবী সারাহ মক্কা বিজয়ের দিন সেই কয়েকজনের অন্তর্ভুক্ত ছিলো যাদেরকে “যেখানে পাওয়া যাবে সেখানে হত্যা করতে হবে” - এমন অপরাধী। পরবর্তীতে সে উসমান(রা.) এর কাছে এসে লুকিয়ে থাকে, পরে উসমান(রা.) এর অনুরোধে রাসুলুল্লাহ(ﷺ) তাকে মাফ করেন। আচ্ছা, তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে - রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এমন কাউকে কেন জীবিত রাখবেন যে তার “গোপন রহস্যের”(!) কথা ভালভাবেই জানে (নাউযুবিল্লাহ)!!!
(৪) কেউ কেউ বলবে ইবনে আবী সারাহ প্রাণের ভয়ে রাসুলুল্লাহর(ﷺ) কাছে এসে মাফ চেয়েছেন। তাহলে পরবর্তীতে তিনি এত ভালো মুসলিম কিভাবে হলেন?? এতটা আল্লাহভীরু কিভাবে হলেন?? যদি ইসলাম তিনি প্রাণরক্ষার্থেই গ্রহণ করে থাকেন, তবে পরবর্তীতে তিনি এতটা নির্মল আখলাকের অধিকারী কিভাবে হলেন? কিভাবে আল্লাহর কালেমা উচু করতে তিনি সূদুর আফ্রিকায় গেলেন সেনাপতি বেশে??
মূল কথা হলো এই অভিযোগটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।
এই কারনেই প্রখ্যাত আলিমে দ্বীন, www.islamqa.info এর কর্ণধার শায়খ সালিহ আল মুনাজ্জিদ এই সম্পর্কে লিখেছেন,
ولم نقف على رواية صحيحة الإسناد أن عبد الله بن أبي سرح كان يحرِّف الوحي ،
আমরা কোনো সহীহ রেওওয়ায়েতের (বর্ণনা) মাধ্যমে জানতে পারিনি যে আবদুল্লাহ ইবনে আবী সারাহ ওহীর বিকৃতি ঘটিয়েছিলেন।[7]
সুতরাং বলা যেতে পারে যে, "কুরআনে আবদুল্লাহ ইবনে আবী সারাহের কথা ঢুকে গেছে" বা “আবদুল্লাহ ইবনে আবী সারাহ বুঝতে পেরেছিলেন যে কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে নয়” - এ জাতীয় দাবি সম্পূর্ণ ভুল। এ সংক্রান্ত এমন কোনো সহীহ দলিল নেই যা দিয়ে কোনো যুক্তি বা প্রমাণ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।
কৃতজ্ঞতাঃ ( http://www.islamic-awareness.org )
তথ্যসূত্র:
[1].http://library.islamweb.net/newlibrary/display_book.php?ID=275&bk_no=60&flag=1
[2]. তাফসীর বাগাভী, তাফসীর ইবনে কাসির, ৮ম,৯ম,১০ম/১২২, তাফসীর মাযহারী, ৪/২৬০
[3]. তাফসীর ইবনে কাসির, ১৫/২১
[4]. https://ar.wikipedia.org/wiki/%D8%B9%D8%A8%D8%AF_%D8%A7%D9%84%D9%84%D9%87_%D8%A8%D9%86_%D8%B3%D8%B9%D8%AF_%D8%A8%D9%86_%D8%A3%D8%A8%D9%8A_%D8%A7%D9%84%D8%B3%D8%B1%D8%AD
[5]. তাফসীর ইবনে কাসির, ১৫/২১
[6]. সুনান আবু দাউদ,(ই.ফা.) হা-২৬৭৪; সুনান নাসাঈ,(ই.ফা.), হা-৪০৬৮