Pray for the world economy

বিজ্ঞান ও বিশ্বাস – আমরা যা জানিনি

 

ছোট বেলায় প্রথম বিজ্ঞানের যে বই আমি পেয়েছিলাম তা ছিলো সাইন্স ফিকশন; মজাই লাগত পড়তে। ভবিষ্যতের নায়ক বাইভার্বেল নামক এক অদ্ভূত বাহনে চড়ে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে, হাতে থাকা ক্রিস্টাল স্ক্যান করতেই মুহূর্তের মাঝে হলোগ্রাফিক মানুষ যান্ত্রিক কণ্ঠে ‘হ্যালো’ বলে উঠছে, মাথার পেছনে থাকা পোর্ট দিয়ে সরাসরি তাকে কম্পিউটারের সাথে যুক্ত করা হচ্ছে; ফলে সে প্রবেশ করছে পরাবাস্তব জগতে! এমন আরও কত কী! গাদা-গাদা সাইন্স ফিকশন পরার পর যখন বর্তমান বিজ্ঞানের বই হাতে এল পরে জেনেছি সেগুলো ছিলো পপুলার সাইন্সের বই; সংক্ষেপে এদের বলা হয় পপ সাইন্স। এগুলোতে দেখি বিজ্ঞানের জয়জয়কার; শুধু চমক লাগানো তথ্য আর ছবির সমাহার। পড়ালেখা বাদ দিয়ে গোগ্রাসে গিলতাম সেগুলো। বিজ্ঞান সম্পর্কে এমন ধারণা নিয়েই হয়তো চলতাম; যদি না বিজ্ঞানকে আমার আদর্শিক অবস্থানের বিপরীতে দাঁড় করানো হত।

 

ভার্সিটি লেভেলে উঠে যখন আরও বড় জগতের সাথে পরিচয় ঘটে, তখন আগের জীবনে শেখা অনেক কিছুতেই সংশয় আসা শুরু হয়। এই পথে একসময় প্রায় হারিয়ে ফেলি আমার পরিবার থেকে পাওয়া ইসলামের প্রতি বিশ্বাস (পরে জেনেছিলাম সেই বিশ্বাসটাও আসলে ফোক ইসলাম ছিলো, মুল ইসলাম না; যাই হোক)। এই হারিয়ে ফেলার পিছনে নাস্তিকদের প্রচার করা একটি ন্যারেটিভ ভূমিকা রেখেছিলো। আর তা হলো, বিজ্ঞান হলো কেবলই যুক্তি-প্রমাণসিদ্ধ সত্যের ঘনঘটা; অপরদিকে ধর্ম হলো কিছু অপ্রমাণিত বিশ্বাসের ডালা। বিশ্বাসের বালাই বিজ্ঞানের গণ্ডিতে নেই। বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় বিজ্ঞান প্রচারকের ভক্ত হওয়ার কারণে তার লেখা থেকেই বিজ্ঞান আর ধর্মের তফাৎটা চট করে শিখে ফেলি। তিনি বলেছেন :

 

ধর্মের ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস, কাজেই ধর্মগ্রন্থে যা লেখা থাকে সেটাকে কেউ কখনো প্রশ্ন করে না, গভীর বিশ্বাসে গ্রহণ করে নেয় । বিজ্ঞানে বিশ্বাসের কোনও স্থান নেই ।’ ([1])

 

অধিকাংশ মানুষ চিন্তা ছাড়াই সমাজের প্রচলিত ন্যারেটিভ মেনে নেয়, সেলিব্রেটিদের অনুসরণ করে; আমিও তাই করতাম হয়তো। কিন্তু কী যেন বাধ সেঁধে বসলো। ভাবলাম একটু বিদ্রোহী হই; মেনে নেওয়ার আগে পরখ করে দেখি। পরখ করতে গিয়ে দেখি, ওরে বাপস্‌, এ দেখছি কেঁচো খুঁড়তে সাপ! গল্পটা বলি একটু।

গরম চা রেডি তো? চায়ে চুমুক দিয়ে পড়ার মজাই আলাদা।

 

---

বিজ্ঞান পড়তে গিয়ে প্রথমেই আগ্রহ জাগে বিজ্ঞান কাকে বলে তা বুঝার। অন্তর্জাল ও ইউটিউব ঘুরে জানতে পারি বিজ্ঞান দর্শন (Philosophy of science) বলে একটা বিষয় আছে; আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হয়। বিজ্ঞানীরা বস্তুজগতের নানা বিষয় যেমন – মৌল বা যৌগ, কোনও প্রাণি, পদার্থের গতিবিধি ইত্যাদি গবেষণা করে সিদ্ধান্ত দেন; আর বিজ্ঞানের দার্শনিকেরা কীভাবে বিজ্ঞানীরা এসব সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন তা নিয়ে গবেষণা করেন। সোজা কথায় – বিজ্ঞানের কর্মপদ্ধতি, এর অনুমান, উপযোগীতা-সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি নিয়ে কলম চালান। এনিয়ে বেশকিছু বইও পড়ে ফেললাম। বিভিন্ন একাডেমিকের লেখা বই। আগ্রহ এতই চরমে উঠলো যে মেডিকেলের নাভিশ্বাস তোলা পড়াশোনার মাঝেও এডিনব্রা বিশ্ববিদ্যালয়, ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন কোর্সও করে ফেলি। এই পড়াশোনার মাঝেই বুঝতে পারি, অধিকাংশ বিজ্ঞানী বিজ্ঞানের দর্শন সম্পর্কে সামান্যই ধারণা রাখেন। বিজ্ঞানের সুফলই তাদের জন্য যথেষ্ট, আমাদের জন্যও তাই। আমি যে ফিল্ডে কাজ করি সেখানেও একই দশা। আপনি ১০০ জন মেডিসিনের প্রাজ্ঞ প্রফেসরকে যদি জিজ্ঞেস করেন⸺মেডিসিনের দর্শন পড়েছেন? আপনার কথা শুনে তারা আপনাকে পাগল ঠাউরাবে। অথচ আমি নিজেই বিজ্ঞানের দর্শনের পিছে ছুটতে ছুটতে মেডিকেলের দর্শন নিয়ে লেখা একাডেমিক বইও পেয়ে গেছি।

 

বিজ্ঞানের দর্শন পড়ে জানতে পারি, বিজ্ঞান তার চান্দের গাড়ি স্টার্ট দেওয়া আগেই কিছু ধারণাকে সঠিক বলে ‘ধরে নেয়’; অন্যভাবে বললে বিশ্বাস করে নেয়! এগুলোকে বলা হয় এসাম্পসান/প্রিসাপোজিশনস অফ সাইন্স! নামকরা একজন একাডেমিকের বইতে প্রিসাপোজিশনের সংজ্ঞায় দুটি বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে ([2]) –

 

১. সূচনাকালীন ধারণা                    

২. যা যাচাই বা প্রমাণ করা সম্ভব না

 

এইবার লেগে গেলো খটকা! এতদিন কোন বিজ্ঞান শিখলাম মুখরোচক বই পড়ে! একাডেমিক বই দেখি মুখ তেতো করে দিলো! এতদিন বিজ্ঞান শিখে এলাম বিজ্ঞান মানে যুক্তি-প্রমাণের তীক্ষ্ণ ধার। এর মধ্যে বিশ্বাসের ভোঁতা ছুরি ঢুকে গেলো কীভাবে! নামকরা একাডেমিক প্রকাশনির এক বইতে এমিরেটাস অধ্যাপককে লিখতে দেখি ([3]):

 

[S]cience based on a set of presuppositions or beliefs that cannot be proved by logic or firmly established by evidence. If this proposition is correct, then it would be reasonable to conclude that since science rests on a foundation of statements that are assumed to be true but that cannot be proved/firmly established, science fundamentally is a matter of faith! A statement that many scientists would find shocking due to their lack of serious reflection on the foundations of their fields of endeavor and their strong faith in science as providing true and objectively testable knowledge of physical reality. ” 

 

ভেবেছিলাম আমার দেশের কোনো পণ্ডিত মনে হয় এটা বুঝতে পারেন নি এখনো। পরে দেখি না, একজন আছে। তিনি এই বাস্তবতা বুঝতে পেরে লিখেছেন ([4]):

 

“বিজ্ঞান সম্পর্কে মনে করা হয় যে, জ্ঞানের এ শাখা যুক্তি ও প্রমাণ ভিত্তিক এবং এখানে বিনা বিচারে কোনো কিছুই গ্রহণ করা হয় না। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো যে, বিজ্ঞানের যৌক্তিক কাঠামোর মধ্যেও অন্তর্নিহিত রয়েছে অযৌক্তিক এবং অল্প-যৌক্তিক নানা দিক। যেমন বিশ্বাসের কথাই ধরা যাক। প্রচলিতভাবে এটা মনে করা হয় যে, বিশ্বাস হলো ধর্মের ভিত্তি, যা বিনা বিচারে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু বিজ্ঞানের যৌক্তিক কাঠামোর মধ্যে যদি বিশ্বাসকেও লক্ষ্য করা যায় তাহলে বলব যে, বিজ্ঞানের এ কাঠামোর মধ্যে যুক্তি ও বিশ্বাসের দ্বান্দ্বিক সহাবস্থান রয়েছে।” 

 

শুরুতে ভেবেছিলাম একটা-দু’টো হবে বোধহয়। পরে দেখি, নাহ! ভালই বিশ্বাস রয়েছে বিজ্ঞানের ডালায়। ([5]) কয়েকটা বলা যাক।

 

১. বিজ্ঞানের বিশ্বাসগুলোর মাঝে অন্যতম একটি বিশ্বাস হল - আমাদের ইন্দ্রিয় ও চিন্তাজগতের বাইরে এই বিশ্বজগতের প্রকৃত অস্তিত্ব আছে। যেমন আইনস্টাইন বলেছিলেন ([6]),

 

“যে-কারও ব্যক্তিকেন্দ্রিক অনুভূতির বাইরে বহির্জগতের যে আসলেই অস্তিত্ব আছে, এহেন বিশ্বাস সকল প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মূল ভিত্তি।”

 

আমাদের ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি কিন্তু এই জগৎ যে বাস্তবেই অস্তিত্বশীল, তা প্রমাণে যথেষ্ট নয়। দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেল তাঁর ‘দর্শনের সমস্যাবলী’ গ্রন্থে অনেক আগেই দেখিয়েছেন⸺ইন্দ্রীয় উপাত্তের সঙ্গে কোনও কিছুর অস্ত্বিত্বের নিশ্চিত সম্পর্ক নেই। ডেভিড হিউম-ও একই মত দিয়েছেন। আমেরিকার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক জর্জ সান্তায়ানা এহেন বিশ্বাসকে মজা করে বলেছেন “এনিমেল ফেইথ” মানে অযৌক্তিক বিশ্বাস। ([7])

 

২. এই বিশ্বজগত আমাদের পক্ষে ঠিকঠাক বুঝে উঠা সম্ভব। অন্যভাবে বললে, আমাদের চিন্তাশক্তির উপর আমরা ভরসা করতে পারি। এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান লেখক মারগারেট ভার্থেইম বলেন ([8])

 

“আমরা সবাই কিছু-না-কিছু বিশ্বাস করি এবং বিজ্ঞান নিজেও কিন্তু একগাদা বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। শুরুতেই বলা যায়, বিজ্ঞান এই বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে যে, বিশ্বজগতকে আমরা বুঝতে পারি এবং আমাদের উদ্ভাবন ক্ষমতা ও আরও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির ব্যবহারের দ্বারা আমরা শেষমেশ সব জেনে যাব।”

 

আমরা যে যৌক্তিক চিন্তাক্ষমতা সম্পন্ন জীব এটাও কিন্তু বিজ্ঞানের অনুমান। যদিও বিবর্তনের দর্শন এই অনুমানকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। কারণ এমতে মানুষ কেবলই দীর্ঘ এক বিবর্তন প্রক্রিয়ার আকস্মিক ফল। যে প্রক্রিয়া নিজেই জড়, এলোমেলো, উদ্দেশ্যহীন। বিবর্তনের চাবিকাঠি হলো ক্রমাগত জীবন সংগ্রামে যোগ্যতমের জয়। এই প্রক্রিয়ায় এমন প্রজাতি আবির্ভূত হবে যে শুধু বেঁচে থাকা ও বংশধর রেখে যাওয়ার মতো যথেষ্ট যোগ্য, ব্যস। সত্যের সন্ধান বিবর্তনের লক্ষ্য নয়। স্রেফ বেঁচে থাকা আর আবিষ্কারের খোঁজ দুটো দুই জিনিস। তেলাপোকা মহাশয়ও তো বেঁচে আছে; ও নিউক্লিয়ার হলোকাস্টও সয়ে নেয়। কিন্তু ওকে কি কখনও দেখা গেছে বসে বসে রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা পড়তে বা মহাবিশ্ব উৎপত্তির ইতিহাস বোঝার জন্য ভূতলে গবেষণা করতে? আমাদের চিন্তাক্ষমতার নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে স্বয়ং ডারউইন সাহেবও অনিশ্চিত ছিলেন। ডিএনএ-র ডাবল হেলিক্স মডেল প্রণেতাদ্বয়ের একজন, নোবেল বিজয়ী সুপরিচিত নাস্তিক বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ক্রিকও এই বিষয়ে মুখ খুলেছেন ([9]):

 

“সর্বোপরি বৈজ্ঞানিক সত্য আবিষ্কারের জন্য আমাদের অত্যন্ত বিকশিত মস্তিষ্কটি বিবর্তিত হয়নি। বরং স্রেফ বেঁচে থাকা ও বংশধর রেখে যাওয়ার জন্য আমাদের যথেষ্ট দক্ষ করে তুলতে বিবর্তিত হয়েছে।”

 

৩. প্রকৃতি সকল ক্ষেত্রে একনিয়মানুসারী (Uniformity of Nature)। ফলে, একটি পরীক্ষা একই পরিবেশে কয়েকবার চালালে একই ফল পাওয়া যাবে। এর আরেক বিবরণ হলো – প্রাকৃতিক সূত্রগুলো অপরিবর্তনীয়। এগুলো শুরুতে যেমন ছিলো, আজও তেমন আছে আর ভবিষ্যতেও তেমনই থাকবে। এটাও অনুমানমাত্র। ডেভিড হিউমও এই অনুমানকে সঠিক ভাবতেন না। ([10]) আবার একদল কসমোলজিস্ট মনে করেন – প্রকৃতির সূত্রগুলোও বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করেছে, এখনকার সূত্রগুলো অতীতেও এমন ছিলো এমন নাও হতে পারে।

 

৪. আমাদের চারপাশে যা কিছু ঘটে সেসব প্রাকৃতিক ঘটনাবলির জাগতিক ব্যাখ্যা দেওয়াই যথেষ্ঠ। বস্তুজগতের বাইরের কিছু বা প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরের কিছুকে কোনও প্রাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যাস্বরূপ টেনে আনা যাবে না। এই বিশ্বাসকে বলা হয় Methodological Naturalism বা পদ্ধতিগত প্রকৃতিবাদ। এটাই বিজ্ঞানের সর্বপ্রধান অনুমান বা বিশ্বাস। এর সম্পর্কে না জানার কারণে অনেকে ভুল ধারণা লালন করেন যে – বিজ্ঞান স্রষ্টাকে খুঁজে পায় নি বা বিজ্ঞান কোনও পরমসত্তাই বিশ্বাস করে না। আসল কথা হলো – বিজ্ঞান স্রষ্টাকে খুঁজতে যায় না। স্রষ্টা আছে কি নেই সে বিষয়ে বিজ্ঞান নিরব হয়ে বসে থাকে। আমেরিকার বিখ্যাত ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সাইন্সেস-এর বিবৃতিতে এ ব্যাপারটি আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে ([11]):

 

বিজ্ঞান হলো প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের একটি উপায়। প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে জাগতিক ব্যাখ্যা প্রদানেই এটি সীমাবদ্ধ। অতিপ্রাকৃত কিছু আছে কি না, সে বিষয়ে বিজ্ঞান কিছুই বলতে পারে না। স্রষ্টা আছে কি নেই, এ প্রশ্নের ব্যাপারে বিজ্ঞান নীরব।”

 

যদি সকল তথ্য-উপাত্ত কোনও স্রষ্টার দিকে ইঙ্গিত করে, তবে তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়াই বিজ্ঞানের কাজ! জাগতিক ব্যাখ্যা প্রদানেই বিজ্ঞান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জীববিজ্ঞানী স্কট টড বিখ্যাত সাইন্স জার্নাল Nature-এ প্রকাশিত এক চিঠিতে এই বাস্তবতা স্বীকার করে বলেন ([12]):

 

“জগতের সকল উপাত্ত যদি কোনও বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন স্রষ্টার দিকে ইঙ্গিত করে, তারপরও এমন অনুকল্প বিজ্ঞান থেকে বাদ দেওয়া হয়, কারণ এই ব্যাখ্যা প্রকৃতিবাদী নয়। তবে ব্যক্তি হিসেবে কোনও বিজ্ঞানী এমন বাস্তবতাকে সাদরে গ্রহণ করতে পারেন, যা (পদ্ধতিগত) প্রকৃতিবাদের ঊর্ধ্বে।”

 

বৈজ্ঞানিক মহলে আরও কিছু ধারণা জেঁকে বসে আছে মেলা দিন হলো। বিজ্ঞানী রুপার্ট শেল্ড্রেক স্বীয় গ্রন্থে এমন দশটি বিশ্বাসকে তালিকাবদ্ধ করেছেন। গবেষণায় দেখা গেছে এই প্রতিটি বিশ্বাসেরই ব্যত্যয় ঘটেছে, বিপরীতে প্রমাণ মিলেছে। ([13]) এদিকে ক্যালিফোর্নিয়ার প্রগ্রেসিভ সাইন্স ইন্সটিটিউট-এর পরিচালক, নাস্তিক বিজ্ঞান-দার্শনিক গ্লেন বরচার্ড The Ten Assumptions of Science Towards a New Scientific Worldview গ্রন্থে বিজ্ঞানের দশটি দার্শনিক অনুমানকে লিপিবদ্ধ করেছেন। যথা:

 

  1. Materialism
  2. Causality
  3. Uncertainty
  4. Inseparability
  5. Conservation
  6. Complementarity
  7. Irreversibility
  8. Infinity
  9. Relativism
  10. Interconnection

 

কি, চোখ কপালে উঠে গেলো নাকি? দেখুন তো, কেমন ধোঁকাবাজি করা হয়েছে আমাদের সাথে। আমরা কোন বিজ্ঞান শিখলাম, আর আসল বিজ্ঞান কী?! কতরকম বিশ্বাসের কথকতা! বিস্তারিত আলোচনা শেষে গবেষক (যিনি নিজেও বিজ্ঞানের কড়া সমর্থক) নিজেই লিখেছেন, ([14])

 

“দার্শনিক আর. জি. কলিংউড ঠিকই বলেছেন : বিজ্ঞান আগে থেকেই অনুমান করে নেওয়া কিছু ধারণার ওপর নির্ভরশীল। একথা বিজ্ঞান ‘ফ্যাক্ট’ নয় বরং ‘বিশ্বাস’-এর ওপর দাঁড়িয়ে আছে এমনটা বলার সমতুল্য।

 

বাস্তবতা হলো, জ্ঞানের সূচনাই হয় বিশ্বাস থেকে। যাচাই হওয়ার পর বিশ্বাস থেকে জ্ঞানের জন্ম হয়। বিশ্বাস মানব জ্ঞান ভান্ডারের প্রতিটি ক্ষেত্রের গোড়াতেই আছে। এই বিষয়গুলো জানলে আমরা বিজ্ঞানবাদি নাস্তিকদের হঠকারিতা সহজেই ধরে ফেলতে পারবো। যখন নাস্তিকদের কোনও সস্তা সাইটে সেলিব্রটি নাস্তিকের উক্তি তুলে ধরা হবে ([15]) –

 

“এই মহাবিশ্বের বিস্ময় দেখে আমার এক সময় একজন মহানির্মাতার ছবি মনে আসত। ডারউইনের বিজ্ঞান পড়ার পর, সেই ছবি মন থেকে উধাও হয়ে যায়।” [রিচার্ড ডকিন্স]

 

তখন আপনি সংশয়ে না পড়ে মুচকি মুচকি হাসবেন। কেন? প্রথমেই দেখুন ডকিন্স ফিতরাহ-এর স্বীকৃতি দিচ্ছেন। মহাবিশ্বের বিস্ময় দেখে এক মহানির্মাতার ইঙ্গিত পাওয়ার প্রবনতা মানুষের মনস্তত্ত্বে গ্রথিত। ([16]) যেহেতু পদ্ধতিগত প্রকৃতিবাদে বিশ্বাসের কারণে, বিজ্ঞান স্রষ্টাকে সমীকরণের বাইরে রেখে যাত্রা শুরু করে, তাই বৈজ্ঞানিক বিবর্তনতত্ত্বের প্রচেষ্টাও হলো মানুষসহ সকল প্রাণের উৎপত্তি ও বিকাশের জাগতিক ব্যাখ্যা দেওয়া। তাই ডারউইনের বিজ্ঞান পড়ে কেবল তার মন থেকেই স্রষ্টার ধারণা উধাও হতে পারে সে বিজ্ঞানের এসাম্পসানগুলো সম্পর্কে অজ্ঞ। বিজ্ঞানের যে-কোনও তত্ত্বই স্রষ্টার অস্তিত্ব বা অনস্তিত্বের ব্যাপারে নিরব। যেমন সেলিব্রেটি নাস্তিক প্রফেসর লরেন্স এম. ক্রউস বলেন ([17]):

 

“বৈজ্ঞানিক মতবাদ হিসেবে বিবর্তনবাদ স্রষ্টার অস্তিত্ব বা অনস্তিত্বের বিষয়ে কিছুই বলে না। এমনকি প্রাণ কীভাবে উৎপত্তি হল সে বিষয়েও কিছু বলে না বরং কীভাবে পৃথিবীর এত বৈচিত্রময় প্রজাতির আবির্ভাব হল তা নিয়ে আলোচনা করে...”

 

তাছাড়া অনেকেই বিজ্ঞানের সাথে নাস্তিকতা গুলিয়ে ফেলেন, বিবর্তনকে নাস্তিকতার সমর্থক ভাবেন। এটা একেবারেই ভুল। ডারউইন নিজেও বলেছেন ([18])–

 

কোন ব্যক্তি একই সাথে বিবর্তনবাদি ও গোড়া আস্তিক হতে পারে। এ নিয়ে কোনও প্রকার সন্দেহ আমার কাছে অবান্তর লাগে।”

 

তাহলে প্রশ্ন আসে, কেন তারা বিজ্ঞানের সাথে নাস্তিকতা মেলায়? অধিকাংশই মেলায় অজ্ঞতার কারণে, গুটি কয়েক মানুষ মেলায় হঠকারিতা করে। নামকরা বিজ্ঞান দার্শনিক এলিয়ট সোবার বলেন ([19]):

 

Newtonian theory and Darwinian theory suggest to some people that there is no god. However, this is not what these theories say; it is a philosophical interpretation of those theories, one whose justification requires additional premises… we should not be astonished, when we discuss science, to find that we are actually doing philosophy.”

 

অর্থাৎ বিজ্ঞানের কোনো তত্ত্বই বলতে পারে না স্রষ্টার অস্তিত্ব আছে নাকি নেই। বরং বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তের সাথে আরো কিছু দর্শন/বিশ্বাস (বস্তুবাদ, আবদ্ধ কার্যকারণ) জুড়ে দিয়ে নাস্তিকতার জগাখিচুড়ি বানানো হয়। এই যে অতিরিক্ত মালমশলা জুড়ে দেয়া হলো সেটার যৌক্তিকতা, আবশ্যিকতা নিয়ে কেউ কথা বলে না। সত্য সমাগত হিসেবে ধরে নেয়। অধিকাংশই তো এটা জানেই না। ভাবে বিজ্ঞান তো আছেই, খোদার দরকার কী? কেন এমন বালসুলভ ভাবনা? মুক্তচিন্তা এখানে আটকে যায় কেন?

 

সুতরাং বোঝা যাচ্ছে বিজ্ঞানের অনুমান ও তার কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকলে পথভ্রষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। নাস্তিকদের বুক ফুলানো গর্বটাও ঝিমিয়ে পড়বে। তাই বিজ্ঞানকে ধর্মবিদ্বেষী, বিজ্ঞানবাদি হামলাকারীদের হাত থেকে উদ্ধার করতে বিজ্ঞানের দর্শন হতে পারে আমাদের সহযোগী।

 

 

তথ্যসূত্রঃ

[1]. ড. জাফর ইকবাল, একটুখানি বিজ্ঞান; পৃ. ১৩ (কাকলী প্রকাশন ২০০৬)

[2]. Hugh G. Gauch Jr., Scientific Method in Practice; P. 131  (Cambridge: Cambridge University Press, 2003)

[3]. Peter Pruzan, Research Methodology: The Aims, Practices and Ethics of Science, p. 44 (Switzerland: Springer, 2016)

[4]. গালিব আহসান, বিজ্ঞানের দর্শন; ভূমিকা (ঢাকা:  জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ২০১৫)

[5]. Dr. Martin Nickels, The Nature Of Modern Science & Scientific Knowledge. Anthropology Program, Illinois State University, August 1998

[6]. Glenn Borchardt, The Ten Assumptions of Science: Towards a New Scientific worldview; p. 14 (iUniverse 2004)

[7]. David Ray Griffin, The Oxford Handbook of Religion and Scince; p. 458 (Edt. Phillip Clayton, Zachary Simpson, Oxford University Press 2006)

[8]. John Brockman (etd.), What We Believe but Cannot Prove; p. 176 (Perfectbound 2006)

[9]. Francis Crick, The Astonishing Hypothesis: The Scientific Search for the Soul; p. 262 (New York: Charles Scribner’s Sons, 1994)

[10]. An Enquiry concerning Human Understanding; 4.1, p.15

[11]. https://www.nap.edu/read/5787/chapter/6#58

[12].   Scott C. Todd, A  view from Kansas on that evolution debate; Nature, vol. 401, p. 423 (30 September 1999)

[13]. Rupert Sheldrake, Science Set Free : 10 Paths to New Discovery; introduction (epub version, New York, Deepak Chopra Books 2012)

[14]. Glenn Borchardt, The Ten Assumptions of Science: Towards a New Scientific worldview; p. 119

[15]. অতনু চক্রবর্তী, রিচার্ড ডকিন্স: ধর্মান্ধতা আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যিনি লড়ে চলেছেন নিরন্তর! এগিয়ে চলো, ২৭ মার্চ ২০১৮

[16]. এ প্রসঙ্গে চমকপ্রদ আলোচনার জন্য বিস্তারিত দেখুন : রাফান আহমেদ, অবিশ্বাসী কাঠগড়ায়; পৃ. ৫৪-৭০ (ঢাকা : সমর্পন প্রকাশন, ২০১৯)

[17].  Science in the Dock, Discussion with Noam Chomsky, Lawrence Krauss & Sean M. Carroll, Science & Technology News, March 1, 2006; Retrieved from: https://chomsky.info/20060301

[18]. Belief In God And In Evolution Possible, Darwin Letter Says. The New York Times, 27 December 1981

[19]. Elliott Sober, Did Darwin Write the Origin Backwards; p. 152 (Prometheus Books, 2010)