প্রতিটি মানুষের মধ্যেই নিজেকে অন্য কারও কাছে সমর্পণ করার সহজাত প্রবণতা আছে। এই ‘অন্য কেউ’ হয় তার থেকে শক্তিশালী বা তার থেকে শ্রেষ্ঠতর কোনো একজন। আস্তিক এবং নাস্তিক- উভয়ের মধ্যেই এই বৈশিষ্ট্য আছে, তা সে স্বীকার করুক বা না করুক। শুধু পার্থক্য হলো আস্তিকেরা এই কাজটা করে নিজের ধর্ম অনুযায়ী, আর নাস্তিকেরা কোনো ধর্মীয় নীতি ছাড়াই। তারা মানুষের মধ্যে বিশেষ কোনো শ্রেণীকে বা মানুষের তৈরি কোনো বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ করে। যেমন- নাস্তিকদের কাছে কোনো সমস্যার সমাধান চাওয়া হলে তারা কোনো উৎস থেকে পাওয়া চিন্তা বা যুক্তি দিয়ে উক্ত সমস্যা সমাধানের কথা বলে। এখানে তারা উক্ত চিন্তার উৎসকে চরম নির্ভরযোগ্য মনে করে এবং তার কাছে মাথা নত করে। বর্তমান কালের নাস্তিকদের কাছে এই ‘স্রষ্টা’র আসনে আছেন রিচার্ড ডকিন্স নামে এক বায়োলজিস্ট, একই সাথে তারা নিজেদেরকে ‘বিজ্ঞান’- এর দাস হিসেবেও স্বীকার করে নিয়েছে (যদিও বা তারা জানে যে, বিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্ব পরিবর্তনশীল এবং ধ্রুব সত্য নয়)। সমাজতন্ত্রীরা স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করলেও কার্ল মার্কস, লেনিন- এদেরকে তাদের প্রভু হিসেবে পরোক্ষভাবে মেনে নিয়ে নিজেদেরকে তাদের সামনে নত রেখেছে। কোন নাস্তিকের কাছে সমস্যার সমাধান চাওয়া হলে সে কখনও বলে না যে, ‘আমি কিছুই মানি না বা কিছুই বিশ্বাস করি না, তাই আমি কিছুই বলবো না।’ বরং সে তার লালিত বিশ্বাস থেকে জন্ম নেয়া কনসেপ্ট অনুযায়ী কথা বলা শুরু করে। এ ব্যাপারে অমুক বিজ্ঞানী এরকম বলেছেন, তমুক ঐরকম বলেছেন- এভাবে সে আসলে কোনো একটা নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিত্ব করে এবং সে এক্ষেত্রে তাদেরকেই প্রাধান্য দেয় যাদের সাথে তার চিন্তাধারা বা আদর্শের মিল আছে। মূলত সে তার এই বিশ্বাসের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, যার কারণে সে বার বার উক্ত উৎসের কাছে ফিরে যায়। আমরা একটু লক্ষ্য করলেই দেখবো যে, ব্যাপারটা সহজাত এবং সবার ক্ষেত্রেই ঘটে। মানুষ তার শক্তির সর্বোচ্চ প্রয়োগেও যখন সফল হতে পারে না বা উদ্ধার পেতে পারে না, তখন সে নিজের অজান্তেই এক মহাশক্তির দারস্থ হয়। এটি মানুষের এক সহজাত প্রবৃত্তি যা প্রত্যেকটা মানুষের ক্ষেত্রেই একই। এখানে এসে নাস্তিকেরা প্রশ্ন করতে পারে, ‘আসলে এই প্রবৃত্তির থেকেই স্রষ্টা, ধর্ম- এসবের জন্ম...’ চলুন, তাহলে আরও একটু গভীরে প্রবেশ করা যাক।
লক্ষ্য করুন এখানে তারা বলছে যে এই প্রবৃত্তি থেকেই ঈশ্বরের ধারনার জন্ম, অথচ তারা কিন্তু এই প্রবৃত্তির উৎপত্তিটা কিভাবে হল- সেটি অনুসন্ধান করছে না। প্রত্যেকটি মানুষই এক আল্লাহ্র অস্তিত্বের স্বাভাবিক অনুভূতি নিয়ে জন্মায়, জন্ম থেকেই মানুষ জানে যে আল্লাহ্ এক এবং আল্লাহ্ চান আমি তার ইবাদত করি– ইসলামের ভাষায় এই অনুভূতিকে ‘ফিতরাহ’ বলে। কী? ‘ফিতরাহ’ এর ব্যাপারটা বিশ্বাস হচ্ছে না? বৈজ্ঞানিক প্রমাণ লাগবে? তাহলে শুনুন। University of Oxford এর Centre for Anthropology and Mind বিভাগের সিনিয়র রিসার্চার Dr. Justin Berrett দীর্ঘ ১০ বছর শিশুদের উপর বৈজ্ঞানিক গবেষণা করে বলেছেন: [1]
“Young people have a predisposition to believe in a supreme being because they assume that everything in the world was created with a purpose.”
“If we threw a handful (of babies) on an island and they raised themselves I think they would believe in God.”
“সাধারণত বাচ্চারা মনে মনে আগে থেকেই বিশ্বাস করে যে, একজন অতিপ্রাকৃত সত্তা কোনো একটি উদ্দেশ্যে এই মহাবিশ্বকে সৃষ্টি করেছে... যদি কোনো দ্বীপে কিছু শিশুকে ছেড়ে দিয়ে নিজে নিজেই বেড়ে উঠার সুযোগ দেওয়া হয়, দেখা যাবে, তারা স্রষ্টায় বিশ্বাস করে।”
আপনি যদি কোনো বিজ্ঞানী বা যুক্তিবাদীকে টেবিলের উপর একটা ল্যাপটপকে দেখিয়ে বলেন যে, এটা এখানে কেউ আনে নি, এটা আগে থেকেই এখানে ছিল, এটার কোন maker বা স্রষ্টা নেই। তাহলে সে আপনাকে চরম মূর্খ বলবে। কারণ এটা যে এমনি এমনি এখানে আসতে পারে না, সেটা বাচ্চা ছেলেও জানে। একটি মোবাইলের কথাই ধরুন, একটা মোবাইল ফোনের প্রধান উপাদান হলো বালি। যেটা হলো ভিতরের সেমিকন্ডাক্টর চিপের উপাদান আর উপরের কেসিংটা প্লাস্টিকের তৈরি। এখন একটা প্লাস্টিককে বালিতে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর রেখে দিলে একটা প্রোগ্রামেবল মোবাইল তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা (probability) কতটুকু? আবার, একটা বানরকে যদি কিবোর্ড দিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসিয়ে দেয়া হয়, তাহলে একটা অর্থপূর্ণ বাক্য, যেমন- I am a monkey, এটা পাওয়ার probability কত? এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয়, দুটো ক্ষেত্রেই probability নির্ভর করছে বুদ্ধিমত্তার উপর। এই মহাবিশ্ব randomly তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক অনেক কম, যেটা Higher Intellectual ছাড়া probability বাড়ানো সম্ভব না।
কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, আপনি এই একই ধরনের প্রশ্ন যখন বিশাল কোনো কিছুর ক্ষেত্রে করবেন, অর্থাৎ এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি নিয়ে, তখন যদি আপনি বলেন, এটা আগে থেকেই ছিল- তাহলে সেই একই বিজ্ঞান বা যুক্তিবাদী আপনাকে বুদ্ধিমান বলে আখ্যায়িত করবে।
যদি কোনো নাস্তিককে প্রশ্ন করা হয়, মানুষ কিভাবে এসেছে, তাহলে সে আপনাকে বিবর্তনবাদের কথা বলবে। এখন যদি তাঁকে প্রশ্ন করেন সেই এককোষী অণুজীব বা first living cell কিভাবে আসলো? তাহলে সে আপনাকে ২ ধরনের উত্তর দিতে পারে-
১। এটা আগে থেকেই ছিল (!)।
২। Random Chemical process.
আপনি এখানেও একই প্রশ্ন করতে পারেন এগুলো কিভাবে শুরু হলো? সে বলবে সবই ‘প্রকৃতি’র তৈরি। কিন্তু এই প্রকৃতি যে কী জিনিস সেটার নির্ভরযোগ্য সংজ্ঞা আমি আজ পর্যন্ত কারও কাছে পেলাম না। এখানেও সেই একই প্রশ্ন চলে আসে, প্রকৃতিকে অস্তিত্বে আনলো কে? আপনি যদি বলেন এক মহাবিস্ফোরণের ফলে এই নিখুঁত সিস্টেমটা তৈরি হয়েছে, সেটা খুব লজিক্যাল কথা হবে না। ব্যাপারটা অনেকটা দুইটা ফেরারি এবং পোরশে গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষে একটা বিএমডব্লিউ গাড়ি তৈরি হওয়ার মতো! Explosion create chaos, not discipline. এখানেও একটা কথা আসে যে এই বিস্ফোরণটাই বা কিভাবে হলো বা কেন হলো? আর যদি বলেন এই বিস্ফোরণের আগে কি ছিল, তাহলে সে আপনাকে singularity-র কথা বলবে। সেটা কিভাবে হলো? এভাবে আপনি যে পথেই আগান না কেন আপনাকে এক সময় থামতেই হবে। আপনাকে কোনো একটা কিছু বা কোনো পয়েন্টকে constant বা reference ধরতেই হবে। এরপর সেটার ক্ষেত্রে বলতে হবে, ‘এটাকে কেউ সৃষ্টি করে নি। এটা আগে থেকেই ছিল। ছিল তাই ছিল!’
সুতরাং, আমরা বিজ্ঞান দিয়ে লজিক দেয়ার ক্ষেত্রেই বলি আর সাধারণ কমন সেন্স ব্যবহারের ক্ষেত্রেই বলি এমন কিছুর অস্তিত্ব সবসময় থেকেই যাচ্ছে যাকে আমরা বিলীন করতে পারছি না। আমরা আস্তিকেরা এই অদৃশ্য সত্ত্বাকে স্রষ্টা বলি। এখন যদি স্রষ্টার অস্তিত্ব আমরা স্বীকার করে নেই, তাহলে প্রথমেই যেই প্রশ্নের উদয় হয় সেটা হলো, এই স্রষ্টা কি মহাবিশ্ব বা প্রকৃতি হতে পারে না? কেন সেটাকে আলাদা কোন সত্ত্বা ধরতে হবে? এর উত্তর হলো, না পারে না। যদি Big bang theory-র উপর ভিত্তি করে আমরা যুক্তি দাড় করাই, তাহলে এই তত্ত্ব অনুযায়ী এই মহাবিশ্বের একটা শুরু আছে। পৃথিবীর অন্যতম বড় পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং নিজেও তার ওয়েবসাইটে এই সম্পর্কে লিখেছেন:
The conclusion of this lecture is that the universe has not existed forever. Rather, the universe, and time itself, had a beginning in the Big Bang, about 15 billion years ago. – The Beginning of Time, Stephen Hawking[2]
“এই বক্তৃতা শেষে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছি যে, মহাবিশ্বের অস্তিত্ব চিরকাল বিদ্যমান ছিল না। বরং, মহাবিশ্ব, এমনকি স্বয়ং সময়ের সূচনা হয়েছিল বিগ ব্যাং এর মধ্য দিয়ে, প্রায় ১৫ বিলিয়ন বছর পূর্বে।”
যার শুরু থাকে তার সৃষ্টি হওয়ারও একটা কাল থাকে, আর যে সৃষ্টি হয় – তার অবশ্যই একজন স্রষ্টা থাকে। কাজেই মহাবিশ্ব নিজে কখনোই স্রষ্টা হতে পারে না। আরও একটা ব্যাপার হল, মহাবিশ্ব বা প্রকৃতির কি বুদ্ধি বা চিন্তা করার ক্ষমতা আছে? যদি না থাকে, তাহলে বুদ্ধিহীন প্রকৃতি কিভাবে বুদ্ধিমান প্রাণী সৃষ্টি করে? আর যদি চিন্তা করার ক্ষমতা থেকেই থাকে, তাহলে তো নাস্তিকরা আর স্রষ্টা নাই বলে চিল্লানোর কোন সুযোগ পাচ্ছে না। কিন্তু আমরা যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমে দেখলাম যে, প্রকৃতি বা মহাবিশ্ব নিজেই সৃষ্ট। তাই এগুলোকে স্রষ্টা হিসেবে ধরে নেয়া যাচ্ছে না। একইভাবে, আমরা যদি অন্যান্য বৃহৎ কোনো কিছুর দিকে লক্ষ করি তাহলেও দেখবো যে আকৃতির বিশালতা এবং কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য ছাড়া কারও মধ্যেই আসলে খুব বেশি পার্থক্য নেই। যেমন- সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, পাহাড়-পর্বত এদের কারও কোন বিচারবুদ্ধি নেই; সবই জড় পদার্থ। অতএব, এদের কেউই স্রষ্টা না।
“তারা কি সৃষ্ট, নাকি না তারা নিজেরাই স্রষ্টা? নাকি তারা সৃষ্টি করেছে আকাশসমূহ ও পৃথিবী? বরং (বাস্তবতা তো এই যে,) তারা বিশ্বাসই রাখে না। তোমার প্রতিপালকের ভাণ্ডারসমূহ কি তাদের কাছে, নাকি তারাই (সবকিছুর) নিয়ন্ত্রক?” [সূরা তূর ৫২: ৩৫-৩৭]
আমাদের কাছে এখন আছে কেবল একটাই option. স্রষ্টা সম্পূর্ণ আলাদা সত্ত্বা। এখন দ্বিতীয় ধাপে আমাদের মাথায় যে প্রশ্ন আসে সেটি হল, স্রষ্টা যদি সবকিছু সৃষ্টি করেই থাকে তাহলে তাঁকে সৃষ্টি করলো কে? এখানে আমরা স্রষ্টার সৃষ্টি হওয়া নিয়ে ৩ টা তত্ত্ব পাই।
১। স্রষ্টা নিজেকে নিজেই সৃষ্টি করেছেন।
২। স্রষ্টাকে কেউ সৃষ্টি করেছেন।
৩। স্রষ্টাকে কেউ সৃষ্টি করে নি। তিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন।
প্রথমটি হবে না। কারণ নিজেকে সৃষ্টি করতে হলে প্রথমে নিজের অস্তিত্ব থাকতে হয়। আর যার নিজের অস্তিত্ব আছেই, তার নিজেকে সৃষ্টি করার প্রশ্নটাও অবান্তর। এটা কিভাবে সম্ভব যে যিনি আগে থেকেই ছিলেন (নিজেকে সৃষ্টি করার জন্য), আবার একইসাথে সৃষ্টিও হচ্ছিলেন??!!
দ্বিতীয়টিও অযৌক্তিক। কারণ স্রষ্টাকে যদি অন্য কেউ তৈরি করে থাকে, তাহলে তো স্রষ্টা আর স্রষ্টা থাকেন না। তিনিও আমাদের মত সৃষ্ট হয়ে যান। বরং তাঁকে যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনিই প্রকৃত স্রষ্টা। তাহলে তাঁকে কে সৃষ্টি করেছে? সেই মহাসত্তাকে যে সৃষ্টি করেছে, সেই মহা-মহাসত্তাকে কে সৃষ্টি করেছে? সেই মহা-মহাসত্তাকে যেই মহা-মহা-মহাসত্তা সৃষ্টি করেছে, তাকে কে সৃষ্টি করেছে?… এই প্রশ্নের শেষ নেই। এটা চলতেই থাকবে। আর এটা সম্ভব না, কারণ একটু আগেই আমরা দেখেছি যে প্রকৃতি বা মহাবিশ্ব সৃষ্ট। আর যে সৃষ্ট তার পক্ষে আগে থেকেই থাকা সম্ভব না।
ধরুন আপনি একজন সৈনিক। আপনাকে গুলি করার আগে আপনার পেছনের একজন সৈনিকের অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু তাকেও তার পেছনের সৈনিকের অনুমতি নিতে হবে, আপনাকে অনুমতি দেওয়ার আগে। এভাবে পেছনের দিকে অসীম সময় পর্যন্ত অনুমতি নেওয়া চলতে থাকবে। যদি তাই হয়, তাহলে আপনি কি কোনোদিন গুলি করতে পারবেন? পারবেন না। আপনাকে অবশ্যই কারও নির্দেশকে ধ্রুবক ধরে সেই কমান্ডকে বাস্তবায়ন করতে হবে। এটা প্রমাণ করে যে, এরকম পেছনের দিকে অসীম পর্যন্ত চলতে থাকা একটি অবাস্তব ধারণা। এরকম হলে কোনোদিন কোনো ঘটনা ঘটতো না। সুতরাং, কখনই অসীম পর্যন্ত কোনো ঘটনার পেছন দিকে যাওয়া যায় না।
আরেকটা উদাহরণ দেখি। আপনার সামনে যদি ৫০০ জন থাকে, তাহলে আপনি ৫০০ জনের পরে বাসে উঠার সুযোগ পাবেন। যদি আপনার সামনে ১০০০ জন থাকে তাহলে আপনি ১০০০ জনের পরে বাসে উঠতে পারবেন। কিন্তু যদি আপনার সামনে অসীম সংখ্যক লোকের লাইন থাকে, তাহলে কি আপনার বাসে উঠার পালা কখনো আসবে? না, কখনো আসবে না। কেননা, অসীম সংখ্যক লোকেরও বাসে উঠা কখনও শেষ হবে না, আর আপনারও বাসে উঠার পালা কখনোই আসবে না। এবার উল্টোভাবে চিন্তা করুন। ধরুন, একটা লোক তার সামনের লোকদের বাসে উঠার পরে সে বাসে উঠেছে। এখন এই লোকটা কত জনের পর উঠেছে? যত জনের পরেই উঠুক না কেন, সেটার অবশ্যই একটা সীমা আছে। একথা বলা যাবে না যে, সে অসীম সংখ্যক লোকের পর বাসে উঠেছে। কেননা তার সামনে যদি অসীম সংখ্যক লোকই থাকতো, তাহলে তো সেই অসীম সংখ্যক লোকেরও কোনদিন বাসে উঠা শেষ হতো না, আর তারও কোনদিন বাসে উঠার পালা আসতো না। কিন্তু যেহেতু তার পালা এসেই গেছে, বাসে যেহেতু সে উঠেই গেছে- এটাই অকাট্য প্রমাণ যে সে সসীম ও নির্দিষ্ট সংখ্যক কিছু লোকের পর বাসে উঠেছে। ঠিক তেমনি এই মহাবিশ্ব যেহেতু অস্তিত্বে এসেই গেছে, এটাই অকাট্য প্রমাণ যে এই মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছনে কারণের কোনো অসীম লাইন নেই। বরং শুরুতে এমন একজন স্রষ্টা আছেন যার পিছনে আর কোন স্রষ্টা নেই।
স্রষ্টাকে কে সৃষ্টি করলো, এই প্রশ্নের মাঝে একটা ফাঁক আছে। সেটা হলো প্রশ্নকারী বিনা প্রমাণে আগেই ধরে নিয়েছেন যে, স্রষ্টাকে সৃষ্টি করা হয়েছে; তিনি একসময় ছিলেন না। যেমন- আপনি যদি জিজ্ঞাসা করেন যে, স্রষ্টার সন্তান কয়জন? এর মানে হলো, আপনি আগেই বিনা প্রমাণে ধরে নিয়েছেন যে, স্রষ্টার সন্তান আছে। অথচ এরকম বিনা প্রমাণে কিছু ধরে নিয়ে, তার উপর ভিত্তি করে প্রশ্ন করা একেবারেই অযৌক্তিক। এ ধরনের প্রশ্নকে বলা হয় loaded question বা complex question fallacy, যেটি কোন controversial বা unjustified assumption করে করা হয়।[3] ‘এখনও বউকে পেটান?’- এরকম একটা loaded question, যেখানে ধরে নেয়া হচ্ছে- প্রথমত, আপনার বউ আছে। দ্বিতীয়ত, আপনি তাকে পেটাতেন।
তাই স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণিত হবার পর, তাকে কে সৃষ্টি করলো- এই প্রশ্ন করার আগে আপনাকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি একসময় ছিলেন না, তাকে পরে সৃষ্টি করা হয়েছে। এটা প্রমাণ না করে তাকে কে সৃষ্টি করলো, এই প্রশ্ন করাটা একেবারেই অযৌক্তিক। যেমন আমরা আগে প্রমাণ করেছি যে, এই মহাবিশ্ব একসময় ছিল না, পরে অস্তিত্বে এসেছে।
আবূ হুরাইরাহ্ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (স.) বলেছেন, তোমাদের কারো নিকট শয়তান আসতে পারে এবং সে বলতে পারে, এ বস্তু কে সৃষ্টি করেছে? ঐ বস্তু কে সৃষ্টি করেছে? এরূপ প্রশ্ন করতে করতে শেষ পর্যন্ত বলে বসবে, তোমার প্রতিপালককে কে সৃষ্টি করেছে? যখন ব্যাপারটি এ স্তরে পৌঁছে যাবে তখন সে যেন অবশ্যই আল্লাহর নিকট আশ্রয় চায় এবং বিরত হয়ে যায়। [সহীহ বুখারী, হাদিস নং: ৩২৭৬]
আমাদের তাহলে তিন নম্বর থিওরিতেই যেতে হচ্ছে। অর্থাৎ, স্রষ্টা সম্পূর্ণ আলাদা সত্ত্বা, যিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং অনন্তকাল ধরে আছেন এবং থাকবেন।
স্রষ্টাকে তাঁর সৃষ্টি থেকে আলাদা সত্ত্বা এবং অনাদি-অনন্ত হিসেবে ধরে নেয়ার পর তৃতীয় ধাপে আমরা যে প্রশ্নের সম্মুখীন হই, সেটি হল স্রষ্টা কি এক নাকি একাধিক?
আমরা যদি এই মহাবিশ্ব বা আমাদের চারপাশে তাকাই, তাহলে দেখবো যে সবকিছুই একটা সুনির্দিষ্ট নিয়মে সুশৃঙ্খলভাবে চলছে। আমাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ এরুপ কোন অসঙ্গতিও আমরা দেখি না। যদি একাধিক স্রষ্টা থাকতো, তাহলে অবশ্যই এরকমটা দেখা যেত না। কারণ তাদের উভয়ই যেহেতু বিশাল ক্ষমতাবান, তাহলে তারা অবশ্যই নিজেদের উপর এবং তাদের সৃষ্টির উপর প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করতো। কোনো বিজ্ঞানী কোনো সূত্র আবিষ্কার করার কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখতো যে, তার পরিশ্রম বিফলে গেছে। কারণ এক স্রষ্টা যেভাবে সিস্টেম ডিজাইন করেছিল, অন্য স্রষ্টা তার ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য আগের স্রষ্টার ডিজাইন বাতিল করে নতুন ডিজাইন তৈরি করেছে। এটা অবশ্যই ঘটত, কারণ উভয় স্রষ্টাই বিশাল ক্ষমতাবান। ক্ষমতাবান দুই স্রষ্টার মধ্যে এক স্রষ্টাই যদি সবসময় ক্ষমতা প্রদর্শন করতে থাকে, তাহলে অন্য স্রষ্টার ক্ষমতা আছে এর প্রমাণ কোথায়? আর এক স্রষ্টা অন্য স্রষ্টার কর্তৃত্ব মেনে নিবেনই বা কেন? আল্লাহ্ বলেছেন, “আল্লাহ্ কোনো সন্তান গ্রহণ করেন নি এবং তাঁর সাথে কোনো ইলাহ্ নেই। যদি থাকতো তাহলে প্রত্যেক ইলাহ্ স্বীয় সৃষ্টি নিয়ে পৃথক হয়ে যেত এবং এঁকে অন্যের উপর প্রাধান্য বিস্তার করতো।” [সূরা আল-মু’মিনূন ২৩: ৯১] যদি একাধিক স্রষ্টা থাকতো, তাহলে নিশ্চিতভাবেই বহু মৃত ব্যক্তি হরহামেশাই জীবিত হত!
অর্থাৎ, একাধিক স্রষ্টা থাকাও সম্ভব না। তারমানে স্রষ্টা হল একক, তার সৃষ্ট সবকিছু থেকে আলাদা, অনাদি-অনন্ত, সর্বশক্তিমান সত্ত্বা। আল্লাহ্ কুরআনে নিজের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেছেন-
“১। বল, তিনিই আল্লাহ্, এক ও অদ্বিতীয়।
২। আল্লাহ্ কারও মুখাপেক্ষী নন।
৩। তিনি কাউকে জন্ম দেন নি এবং কেউ তাঁকে জন্ম দেয় নি।
৪। এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।” [সূরা ইখলাস ১১২: ১-৪]
কৃতজ্ঞতা: নাম না জানা কোনো ভাই, আদনান ফয়সাল, এম ইউ জামান, ওমর আল জাবির
তথ্যসূত্রঃ
[1]. http://www.telegraph.co.uk/news/religion/3512686/Children-are-born-believers-in-God-academic-claims.html
[2]. http://www.hawking.org.uk/the-beginning-of-time.html
[3]. https://en.wikipedia.org/wiki/Loaded_question
- স্রষ্টার অস্তিত্ব, অতঃপর... – এম. ডব্লিউ. জেড. মুন্না
- http://www.hamzatzortzis.com/2425/divine-singularity-how-do-we-know-god-is-one/