প্রশ্নঃ হাদিসে ইহুদি-খ্রিষ্টানদেরকে আগে সালাম দিতে নিষেধ করা হয়েছে এবং হাঁটার সময়ে রাস্তার এক পাশ দিয়ে যেতে বাধ্য করতে বলা হয়েছে। ইসলাম শান্তির ধর্ম হলে অমুসলিমদের সাথে এমন আচরণ কেন?
উত্তরঃ আলোচ্য হাদিসঃ
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عَلَيْهِ وَسلم: لَا تَبْدَؤُوْا الْيَهُوْدَ وَلَا النَّصَارَى بِالسَّلَامِ وَإِذَا لَقِيتُمْ أَحَدَهُمْ فِي طَرِيْقٍ فَاضْطَرُّوهُ إِلَى أضيَقِه.
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূল (স) বলেছেন, তোমরা ইহুদি-খ্রিষ্টানদেরকে আগে সালাম দিবে না এবং রাস্তায় চলার পথে যখন তাদের কারো সাথে তোমাদের সাক্ষাৎ হয়, তখন তাদেরকে রাস্তার সংকীর্ণ পাশ দিয়ে যেতে বাধ্য করবে। [1]
◘ হাদিসের ব্যাখ্যাঃ
ইমাম কুরতুবী(র.) বলেছেন, যখন তাদের সাথে সাক্ষাত হয় এই অবস্থায় যে রাস্তায় ভিড় থাকে তাদেরকে কিনারায় যেতে বাধ্য করো এমন ভাবে যে তারা গর্তে না পতিত হয় এবং দেওয়াল ইত্যাদিতে আঘাত না পায় অর্থাৎ তাদের সম্মানে ও মর্যাদাদানের জন্য রাস্তার মধ্যখান ছেড়ে দিও না। এই কথা বাক্যটি অর্থ ও সহানুভূতি দিক থেকে প্রথম বাক্যের সাথে মিল রাখে। (তাদেরকে আগে সালাম দিও না এই বাক্য)
এবং তার অর্থ এই নয় যে, আমরা যখন তাদের প্রশস্ত রাস্তায় সাক্ষাত পাব তাদেরকে কিনারায় নিয়ে যাবো যাতে তাদের উপর আমরা কঠোরতা প্রদর্শন করতে পারি। এটা তো আমাদের পক্ষ থেকে তাদেরকে বিনা কারনে কষ্ট দেওয়া। আর আমাদেরকে তাদের কষ্ট দিতে নিষেধ করা হয়েছে। [2]
কাজী ইয়াজ(র.)বলেন, আল্লাহ রাসুল (ﷺ) থেকে (এ রকম কোন বিষয় ) বর্ণিত নেই যে, রাস্তা যখন প্রশস্ত ছিল তিনি তাদেরকে বাধ্য করেছেন যেন তাদের জন্য তা সংকীর্ণ হয় এবং তাদেরকে সে (পথে চলতে) বাধা দিয়েছে যাতে তারা অন্য পথে চলতে বাধ্য হয়। [3]
শায়েখ মুহাম্মদ বিন সালিহ আল উসাইমিন(র.) বলেন, এর অর্থ হল, যখন তাদের সাথে সাক্ষাত হবে তাদের জন্য প্রশস্ত করে দিয়ে নয়, যাতে তাদের জন্য প্রশস্ত হয়ে যায় এবং তোমাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে যায়। বরং, তোমরা তোমাদের [গন্তব্যের] দিকে ও পথে চলতে থাকো। (এভাবে চলার কারণে যদি তাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে যায়) সংকীর্ণ করো, যদি সেখানে তাদের জন্য সংকীর্ণ হয়। এটা জ্ঞাত বিষয় যে, নবীর(ﷺ) হেদায়েত এমন ছিল না, যখন তিনি কোনো কাফিরকে দেখতেন, তাকে দেওয়ালের কাছে নিয়ে যেতেন যাতে দেওয়ালের কাছে তাদেরকে জমা করবে। রাসুলুল্লাহ(ﷺ) মদিনায় ইহুদিদের সাথে এমন করতেন না। তাঁর সাহাবীরাও বিভিন্ন শহর বিজয় করার পর তাদের সাথে এমন করতেন না। [4]
◘ কেন বা কী প্রেক্ষাপটে হাদিসে এই কথা বলা হলঃ
আহলে কিতাবদের ব্যাপারে মদীনাবাসীর বাড়াবাড়ি শ্রদ্ধাবোধ ও ভ্রান্ত ধারণা।
মদিনা মুনাওরায় যে ইহুদিরা ছিল তারা ধর্ম, রাজনীতি, শিক্ষা, ব্যাবসা-বানিজ্য ও অর্থনীতি দিক থেকে মুশরিকদের থেকে অগ্রবর্তী ছিল। মুশরিকরা তাদেরকে নিজেদের থেকে উত্তম মনে করত। এমনকি মদীনার মুশরিক নারীদের সন্তান না হলে মানত করত যে – সন্তান হলে ইহুদিদের কাছে দিয়ে দেবে। এভাবে ইহুদিদের কাছে অনেক আরব শিশু চলে যায়। ইসলামের আগমনের পরে মুশরিকরা মুসলিম হয়ে যায়। তবে মূলগত ইহুদিরা মুসলিম হয় নি। যেসব আরব ইহুদি ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে গিয়েছিল, তারা মুসলিম হয়ে যায়। সেই মুসলিমদের অন্তরে প্রথম থেকেই ইহুদিদের প্রতি বিশেষ একটা মর্যাদার জায়গা দখল করে নিয়েছিল। তারা এখনও ইহুদিদেরকে নিজেদের থেকে উত্তম মনে করত। এই তুচ্ছ ও হীনমন্যতা অনুভূতি শেষ করার জন্য রাসুল (ﷺ) দু’টি হুকুম দিয়েছিল। ইহুদি বা খ্রিষ্টানদের ব্যাপারে উম্মতের কোন কুসংস্কার কিংবা বাড়াবাড়ি শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত নয়।
সুতরাং এটা একটি সময় সাপেক্ষ হুকুম ছিল। যা তাদের সিয়াসাত বা রাজনীতির কল্যাণে দিয়ে ছিলেন। এখন আহলে কিতাবদেরকে প্রথমে সালাম করা যাবে এবং তাদের সালামের জওয়াবও দেওয়া যেতে পারে। অনুরূপভাবে মুসলিমরাও রাস্তা থেকে সরে যেতে পারবে। এটি মুফতি সাঈদ আহমেদ পালনপুরীর অভিমত। [5]
তবে অধিকাংশ আলেমের অভিমত এই যে, ইহুদি-খ্রিষ্টানদেরকে আগে সালাম প্রদান করা যাবে না। তারা সালাম প্রদান করলে ‘”ওয়া আলাইকুম” বলে প্রতি উত্তর দিতে হবে। [6]
◘ ঠিক কী কারণে অমুসলিমদেরকে আগে সালাম দেয়া নিষেধ?
কাজি আবু বকর বিন আরাবী(র.) বলেন,
‘সালাম’ শব্দটি আল্লাহর গুণবাচক নামের একটি এবং “আসসালামু আলাইকুম” দ্বারা বোঝানো হয় – আল্লাহ তোমার অভিভাবক এবং তত্ত্বাবধায়ক। (আহকামুল কুরআন)
সালামের এই দিকটির জন্য এর একটি ধর্মীয় গুঢ়ার্থ রয়েছে এবং এতি আল্লাহর গুণবাচক নামের একটি। তাই সাধারণভাবে এটি দ্বারা অমুসলিমদেরকে সম্ভাষণ জানানো বৈধ নয়। তবে অমুসলিমদেরকে অন্য বিভিন্ন উপায়ে সম্ভাষণ জানানো যেতে পারে; যেমনঃ ‘সুপ্রভাত’ বা এ জাতীয় অন্য শব্দাবলী দ্বারা যাতে তারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। [7]
সর্বোপরী, অমুসলিমদের প্রতি ন্যায় ও ইনসাফ প্রদর্শন করা ইসলামের নির্দেশ।
আল্লাহ বলেন,
“আর তোমরা উত্তম পন্থা ছাড়া আহলে কিতাবদের সাথে বিতর্ক করো না। তবে তাদের মধ্যে ওরা ছাড়া, যারা যুলম করেছে। আর তোমরা বল, ‘আমরা ঈমান এনেছি আমাদের প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে এবং তোমাদের প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে তার প্রতি এবং আমাদের ইলাহ ও তোমাদের ইলাহ তো একই। আর আমরা তাঁরই সমীপে আত্মসমর্পণকারী’ ”। [8]
“দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের বাড়ি-ঘর থেকে বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করতে এবং তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করছেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদেরকে ভালবাসেন।
আল্লাহ কেবল তাদের সাথেই বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেন, যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এবং তোমাদেরকে তোমাদের ঘর-বাড়ী থেকে বের করে দিয়েছে ও তোমাদেরকে বের করে দেয়ার ব্যাপারে সহায়তা করেছে। আর যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে, তারাই তো যালিম।” [9]
তথ্যসূত্রঃ
[1]. সহীহ মুসলিম, তিরমিযি, মিশকাত হা/৪৬৩৫
[2]. মুফহাম লিমা আশকালা মিন কিতাবি তালখিসি মুসলিম-৫ খণ্ড ৪৯০ পৃষ্ঠা
[3]. ■ ইকমালুল মুয়াল্লিম-৭ খণ্ড ৫৩ পৃষ্ঠা]
■ আরো দেখুন- তাকমিলে ফাতহি মুলহিম-৪ খণ্ড ২২১ পৃষ্ঠা, তুহফাতুল আহওয়াজি-৫ খণ্ড ২২৮ পৃষ্ঠা
[4]. মাজমু ফাতাওয়া ও রাসায়েল - শায়খ মুহাম্মদ বিন সালিহ আল উসাঈমিন-৩য় খণ্ড, ৩৯ পৃষ্ঠা
[5]. তুহফাতুল আলমায়ী-৪ খণ্ড, মুফতি সাঈদ আহমেদ পালনপুরী, ৫৩৬-৫৩৭ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য
[6]. “Can we greet the kuffaar with a greeting other than salaam- islamqa” (Shaykh Muhammad Saalih al-Munajjid)
[7]. "Greeting non-Muslims with Salam" (IslamQA Hanafi)
http://islamqa.org/hanafi/daruliftaa/7787
[8]. আল কুরআন, আনকাবুত ২৯ : ৪৬
[9]. আল কুরআন, মুমতাহিনা ৫৯ : ৮-৯