মূলঃ Islamweb
অনুবাদঃ মুহাম্মাদ মুশফিকুর রহমান মিনার
ফতোয়া নং ৮১১৮৮ : [ কুরআনের (তথাকথিত) ব্যাকরণগত ভুল]
প্রশ্নঃ
আমার নজরে একটি ওয়েবসাইট এসেছে যেটিতে বলা হয়েছে কুরআনে নাকি ব্যাকরণগত ভুল আছে। আপনারা তাদের এই দাবির জবাব প্রদান করলে অনেক কৃতজ্ঞ থাকবো।
উত্তরঃ
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর, যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ(ﷺ) তাঁর বান্দা ও রাসুল।
আল কুরআন নিয়ে আপনার এই গভীর সচেতনতার জন্য আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন। আল্লাহ আপনাকে আপনার এই প্রচেষ্টার দ্বারা ইসলাম ও মুসলিমদের সাহায্য করবার তাওফিক দিন। আল কুরআন বিশুদ্ধ আরবি ভাষায়। নবী(ﷺ) এর যুগে কেউ আল কুরআনকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেনি, অথচ সেকালে তারা তাদের সাহিত্যিক উৎকর্ষের জন্য বিখ্যাত ছিলো। সুবক্তা হিসাবেও তাদের খ্যাতি ছিলো তুলনাহীন। এতোগুলো শতাব্দী পরে হঠাৎ করে কেউ কুরআনের মধ্যে ‘ব্যাকরণগত ভুল’ আবিষ্কার করে ফেলেছে এই কথা কেউ ভাবে কী করে? আরবি ভাষা এবং এর ইতিহাস সম্পর্কে যাদের ন্যুনতম জ্ঞান আছে, তাদের জন্য এই সকল আক্রমণ মূলত অসার প্রচেষ্টা ছাড়া কিছু নয়।
কেউ যদি কোনো প্রবন্ধ লিখে তাতে দাবি করে যে একটা জিনিসের মূল কাঠামোই ত্রুটিপূর্ণভাবে নকশা করা, তাহলে আমরা সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রে ঐ আলোচ্য বিষয়ে যথেষ্ট পরিমাণে যোগ্যতা আশা করি। আমরা আশা করি এই ক্ষেত্রে মৌলিক বিষয়গুলোর পরীক্ষাতে সে উত্তীর্ণ হবে। কিন্তু আমরা যদি দেখি যে তার ঐ প্রবন্ধের মধ্যে যোগ-বিয়োগের মতো সাধারণ জিনিসেও বার বার ভুল হয়েছে, আমরা বুঝে যাবো যে সে ঐ বিষয়ে আলোচনা করবার ন্যুনতম যোগ্যতাও রাখে না। আমরা বলছি না যে তাকে আরবি ভাষায় মড় মাপের পণ্ডিত হতে হবে। ইতিহাস, গণিত এসব বিষয়ে আলোচনার জন্যও আমরা আমরা আরবি ভাষায় দক্ষতা আশা করছি না। আমরা যেটি বলছি তা হলোঃ যে কোনো বিষয়ে সমালোচনার জন্য একজনকে ঐ বিষয়ের প্রারম্ভিক বিষয়গুলো জানতে হয়, এগুলোতে উত্তীর্ণ হতে হয়। নাহলে তার সে আলোচনা বিবেচনারই যোগ্য হয় না।
আমাদের পয়েন্ট হচ্ছেঃ এই ইস্যুতে যেসব জায়গায় ইসলামকে আক্রমণ করা হয়, আমরা সেগুলো পড়ে বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করেছি যে তারা আরবি ভাষার প্রাথমিক জায়গাগুলোতেই ভুল করেছে। এর দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয় যারা এসব লিখছে তারা এই বিষয়ে প্রাথমিক পর্যায়েও উত্তীর্ণ হবে না। যেমন, আরবি ‘যা’ (ز) এবং ‘যাল’ (ذ) হরফের মধ্যে বারংবার যে পরিবর্তন দেখা যায়, কুরআনের ঐ পৃষ্ঠাগুলো থেকে তারা ব্যাকরণের সমালোচনা করেছে। ইসলামের যেসব শত্রু ভালো আরবি জানে, তারা সাধারণত আরবি ভাষা সংক্রান্ত এই ব্যাপারগুলো এড়িয়ে যায়। কারণ বিষয়টা তারা ভালো করেই বোঝে। যাদের থেকে এসব অভিযোগ আসে তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে তারা এ বিষয় আলোচনা করবারই যোগ্য নয় (ইতিমধ্যে আমরা একটি উদাহরণ দিয়েছি এবং সামনে আরো আলোচনা আসছে)। তবুও আমরা আগ্রহী পাঠকের কথা বিবেচনা করে এই ইস্যুটি নিয়ে আলোচনা করছি।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা যদি দেখি, আরবি ভাষার জুযুর (جذور; মূল ধাতুর অর্থ থেকে শব্দ গঠন করা) এবং তাসরিফ (تصريف, রূপতত্ত্ব) এর অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য প্রাচীন আরবরা নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে যে নিয়ম জানতো তা থেকেই শব্দ ও বাক্য গঠন করতো। কেউ কতোটা সুনিপুণভাবে শব্দটা ও বাক্য গঠন করতে পারে অথবা ভাষার ক্ষেত্রে সে কতোটা দক্ষ এই বিষয়গুলো দেখে আরবরা একজন ব্যক্তির সাহিত্যের ব্যাপারে সামর্থ্য বিচার করতো। আরবি ভাষার ক্ষেত্রে সব থেকে বেশি দক্ষতা দেখা যেতো বেদুঈনদের। নবী(ﷺ) বেড়ে উঠেছিলেন শহর থেকে দূরে বাইদাহ অঞ্চলে (মরুর বেদুঈন আরবদের বাসভূমি ছিলো সেটি) । সে যুগে এটাই ছিলো রীতি। আরবি ভাষার নিয়মগুলো ভালোভাবে শেখানোর জন্য এমনটি করা (শিশুদের শহরের বাইরে বেদুঈনদের মাঝে বড় করা) হতো।
নবী(ﷺ) এর সমসাময়িক এমনকি তাঁর পরবর্তীকালের বিশ্লেষকরাও তাঁর বক্তব্যগুলোকে সে সময়ের আরবদের মধ্যে সব থেকে বাগ্মীতাপূর্ণ বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এরপরেও সেগুলো ‘মানবীয়’ বক্তব্য হিসাবেই বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু যখন কুরআন নাজিল হলো, অনেকের কাছেই এর ভাষাভঙ্গি মানুষের ক্ষমতার বাইরের কোনো কিছু বলে ধরা দিলো। বিভিন্ন গোত্রের আরবরা বিশেষত বেদুঈনরা শুধুমাত্র কুরআন শুনেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলো। এটাই প্রকৃত ইতিহাস। বাইবেল কিংবা নিউ টেস্টামেন্টের চেয়ে তা বহু গুণে নির্ভরযোগ্য উপায়ে লিপিবদ্ধ ও বর্ণিত আছে।
একটি দেয়ালের উপরে সুরা কাওসার লেখা ছিলো (কুরআনের ক্ষুদ্রতম সুরা)। সেটি পড়ে এর পাশে লিখে দিয়েছিলোঃ ما هذا بقول البشر (এটা কোনো মানুষের বাণী হতে পারে না)। এটা যোগ্যতাসম্পন্ন (আরবিভাষী) মানুষের সাক্ষ্য। এটা এমন কারো কথা নয় যারা আরবি যা (ز) এবং যাল (ذ) হরফের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। আরো একটা উদাহরণ দেখানো যায়। একজন বেদুঈন শুধুমাত্র এই আয়াত দেখে ইসলাম কবুল করেছিলোঃ فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ [ অতএব আপনি প্রকাশ্যে শুনিয়ে দিন যা আপনাকে আদেশ করা হয় এবং মুশরিকদের পরওয়া করবেন না। (সুরা হিজর ১৫ : ৯৪)] তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দিলোঃ এই প্রসঙ্গে গোটা আরবি ভাষায় فَاصْدَعْ এর চেয়ে শক্তিশালী কোনো শব্দ আর নেই (এর শাব্দিক অর্থ ‘Crack Down’ বা কঠোর ব্যবস্থা নেয়া। যা দ্বারা বোঝা যাচ্ছে সাধারণ কোনো আনুগত্য নয় বরং সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ )।
এটা ঐতিহাসিকভাবে সুবিদিত যে, নবী(ﷺ) এর শত্রুরা তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতাকে আক্রমণ করার জন্য সামান্য সুযোগ পেলেও সেটা লুফে নেবার চেষ্টা করেছে। কুরআনের মধ্যে সামান্যতম ব্যাকরণগত ভুল পেলেও তারা অবশ্যই এই সুযোগের সদ্বব্যবহার করতো। এমনকি তাহলে সাহাবীরাও(রা.) দলে দলে ইসলাম ত্যাগ করতেন। কেননা আরবি ভাষা এবং কাব্যচর্চা ছিলো তাঁদের সংস্কৃতির সব থেকে প্রিয় দিক। একাকী ভাবনার গভীরে হারিয়ে যাবার সময়ে, সুখে ও দুঃখে, উচ্ছ্বাসে কিংবা অনুযোগে, ভালোবাসার মানুষের স্মৃতি হাতড়াতে, বিয়ের প্রস্তাব দিতে, লোকজনের সামনে বক্তৃতা দিতে, কারো প্রশংসা করতে, যুদ্ধের ময়দানে শত্রুদলকে সম্বোধণ করতে, শত্রুকে কটাক্ষ করতে, মর্মযাতনার মাঝে, মৃত্যুশয্যায় কাতরাতে – এই সব মুহূর্তগুলোতে আরবরা নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করতে কবিতাকে বেছে নিতো (অন্য যে কোনো জাতির থেকে তাদের এই গুণটি ব্যতিক্রমী)।
অতএব, কোনো গ্রন্থকে আল্লাহ কর্তৃক নাজিলকৃত বলে প্রমাণিত হবার জন্য একে সুস্পষ্ট কিছু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। অপরদিকে অনেকে ইসলামকে অস্বীকার করেও পরোক্ষভাবে কুরআনের অলৌকিক সাহিত্যিক গুণাবলীকে মেনে নিয়েছে। তারা স্বীকার করেছে কোনো মানুষের পক্ষে এমন কিছু তৈরি করা সম্ভব নয়। ইতিহাস এর সাক্ষ্য দেয়। [1] তাহলে কিভাবে তারা এরপরেও ইসলাম গ্রহণ না করার পক্ষে সাফাই গায়? ছোট্ট একটা কথা বলে দিয়ে, আর তা হলোঃ এটা (কুরআন) জাদু ছিলো এবং আমরা এর দ্বারা সম্মোহিত হয়েছিলাম! (এ থেকে পরোক্ষভাবে কুরআনের শ্রেষ্ঠত্বই প্রমাণ হয়) এই ধরনের কর্মপ্রচেষ্টা অসার এবং নিন্দনীয়। তবে কল্পিত ভুল, ব্যাকরণ, সাহিত্য এইসব প্রসঙ্গ টেনে এনে কুরআনকে হেয় করার চেষ্টার থেকে এটা ভালো কৌশল।
আল্লাহই সর্বোত্তম জানেন।
ফতোয়াটি প্রদান করা হয়েছে ইসলামওয়েব এর ফতোয়া কেন্দ্র থেকে।
মূল ফতোয়ার লিঙ্কঃ
https://www.islamweb.net/emainpage/PrintFatwa.php?lang=E&Id=81188
অথবা
https://www.islamweb.com/en/fatwa/81188/
অনুবাদকের টিকা
[1] উদাহরণস্বরূপ মক্কার ওয়ালিদ বিন মুগিরার কথা বলা যায়। তিনি ছিলেন কুরাঈশদের মধ্যে একজন সম্পদশালী, প্রভাবশালী, কবিতা সম্পর্কে জ্ঞানী, এবং বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি কুরআন শুনে এর ব্যাপারে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন, কুরআনের ভাষায় মোহাবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন এবং এর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিয়েছিলেন। কিন্তু এরপরেও ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। তার ব্যাপারে সুরা মুদ্দাসিরের কিছু আয়াত নাজিল হয়।
বিস্তারিত দেখুনঃ তাফসির ইবন কাসির, খণ্ড ১১ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ); সুরা মুদ্দাসসিরের ২১-২৩ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ৩২৯-৩৩১
আরো দেখুনঃ সীরাতুন নবী (সা.) - ইবন হিশাম, ১ম খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), পৃষ্ঠা ২৪২-২৪৪
ওয়ালিদ বিন মুগিরার এই ঘটনাটি বিশুদ্ধভাবে বর্ণিত। বিস্তারিতঃ https://www.islamweb.net/ar/fatwa/104947/
অথবাঃ https://archive.is/6O2Yg (আর্কাইভকৃত)