বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রচারকাজ করেন খ্রিষ্টান মিশনারীরা। বিশেষত দেশের সীমান্তের কাছাকাছি জেলাগুলোতে তাদের কর্মকাণ্ড বেশি। ইন্টারনেট জগতেও তাদের সরব পদচারণা রয়েছে। বর্তমানে তারা মুসলিমদেরকে খ্রিষ্টান বানানোর জন্য ব্যাপক পদক্ষেপ নিচ্ছেন, যার মধ্যে একটি হচ্ছে—কুরআনের অপব্যাখ্যা করে মুসলিমদের বিভ্রান্ত করা এবং কুরআন থেকেই খ্রিষ্টবাদের দলিল দেওয়া। তারা বর্তমানে কুরআন-হাদিস এবং উলামাদের বক্তব্য উদ্ধৃত করে প্রমাণ করতে চেষ্টা করছেন যে বাইবেল অবিকৃত এবং ইসলামে নাকি বাইবেল অনুসরণের নির্দেশ দেয়। তারা নিজেরা যদি বাইবেলকে অবিকৃত মনে করেন এবং বিশ্বাস করেন, এটা তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা। ইসলাম মানুষকে সত্যের দিকে আহ্বান করে, তবে কাউকে জোর-জবরদস্তি করে না। কিন্তু তারা যদি অপব্যাখ্যা করে এবং ধোঁকা দিয়ে মানুষকে বাইবেল মানানোর চেষ্টা করেন, তাহলে সেটা এক বড় সমস্যা। তাদের এই জাতীয় প্রচারণার ফলে কম জানা সরলপ্রাণ অনেক মুসলিম বিভ্রান্ত হয়েছেন ও ঈমানহারা হয়েছেন। এই প্রবন্ধে খ্রিষ্টান প্রচারকদের দাবিগুলো বিশ্লেষণ করা হবে এবং এ বিষয়ে ইসলামের প্রকৃত অবস্থান তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে।
১। পূর্বের ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে ইসলামের অবস্থানঃ
আলোচনার শুরুতেই পূর্বের সকল ধর্মগ্রন্থের উপরে এবং আহলে কিতাব তথা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থের ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান ব্যাখ্যা করা হবে। এ ব্যাপারে দলিল-প্রমাণ এবং ইসলামের অবস্থান সম্পর্কে সম্যকভাবে জানা থাকলে খুব সহজেই ইসলামবিরোধীদের সকল অপব্যাখ্যার অসারতা বোঝা যাবে।
১.১। পূর্বের সকল আসমানী কিতাবের উপর ঈমান রাখতে হবেঃ
আল্লাহর কিতাব আল কুরআনে বলা হয়েছে,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا آمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِي نَزَّلَ عَلَىٰ رَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِي أَنزَلَ مِن قَبْلُ ۚ وَمَن يَكْفُرْ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا
অর্থঃ “হে মুমিনগণ! তোমরা ঈমান আন আল্লাহ্র প্রতি, তাঁর রাসূলের প্রতি, এবং সে কিতাবের প্রতি যা আল্লাহ তার রাসূলের উপর নাযিল করেছেন। আর সে গ্রন্থের প্রতিও যা তার পূর্বে তিনি নাযিল করেছেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ, তার ফিরিশতাগণ, তার কিতাবসমূহ, তার রাসূলগণ ও শেষ দিবসের প্রতি কুফর করে সে সুদূর বিভ্রান্তিতে পতিত হলো।” [1]
এখানে আয়াতের অর্থ একদমই স্পষ্ট। আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদ(ﷺ) এর উপর যে কিতাব নাজিল হয়েছে অর্থাৎ আল কুরআন এবং এর পূর্বে যতো গ্রন্থ নাজিল হয়েছে সবগুলোর উপর ঈমান রাখতে হবে। বিষয়টি বিতর্কের ঊর্ধ্বে। তবে অনেক সময় খ্রিষ্টান মিশনারীরা পূর্বের কিতাবের উপর ঈমান রাখার এই ইসলামী আকিদাকে ভুল ব্যাখ্যা করে বোঝাতে চায় এর মাঝে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের কাছে যেসব কিতাব রয়েছে, সেগুলোও শামিল। কিন্তু আমরা যদি ভালো করে কুরআন-হাদিস অধ্যায়ন করি, তাহলে লক্ষ করবো পূর্বের কিতাবের উপর যেভাবে ঈমান আনতে বলা হয়েছে, এর সাথে আহলে কিতাব তথা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের নিকট যেসব কিতাব আছে সেগুলোকে এক কাতারে ফেলা হয়নি। বরং সেগুলোর ব্যাপারে ভিন্ন কথা বলা হয়েছে।
১.২। আহলে কিতাবদের ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে আল কুরআনের বক্তব্যঃ
আল কুরআনে বলা হয়েছে,
( 77 ) أَوَلَا يَعْلَمُونَ أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا يُسِرُّونَ وَمَا يُعْلِنُونَ
( 78 ) وَمِنْهُمْ أُمِّيُّونَ لَا يَعْلَمُونَ الْكِتَابَ إِلَّا أَمَانِيَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَظُنُّونَ
(79) فَوَيْلٌ لِّلَّذِينَ يَكْتُبُونَ الْكِتَابَ بِأَيْدِيهِمْ ثُمَّ يَقُولُونَ هَٰذَا مِنْ عِندِ اللَّهِ لِيَشْتَرُوا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلًا ۖ فَوَيْلٌ لَّهُم مِّمَّا كَتَبَتْ أَيْدِيهِمْ وَوَيْلٌ لَّهُم مِّمَّا يَكْسِبُونَ
অর্থঃ “তারা কি জানে না যে, তারা যা গোপন রাখে এবং যা ব্যক্ত করে, নিশ্চয় আল্লাহ তা জানেন? আর তাদের মধ্যে এমন কিছু নিরক্ষর লোক আছে যারা মিথ্যা আশা ছাড়া কিতাব সম্পর্কে কিছুই জানে না, তারা শুধু অমূলক ধারণা পোষণ করে। কাজেই দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা নিজ হাতে কিতাব রচনা করে অতঃপর সামান্য মূল্য পাওয়ার জন্য বলে, “এটা আল্লাহর কাছ থেকে। অতএব, তাদের হাত যা রচনা করেছে তার জন্য তাদের ধ্বংস এবং যা তারা উপার্জন করেছে তার জন্য তাদের ধ্বংস।” ” [2]
এই আয়াতগুলোতে বলা হচ্ছে তাদের গোপন করা বিষয়গুলোও আল্লাহ জানেন। তাদের মধ্যে বহু লোক কিতাবের ব্যাপারে মিথ্যা আশা ছাড়া কিছুই জানে না। যা একদমই বাস্তব সত্য। এরপর বলা হচ্ছে, তারা নিজ হাতে কিতাব লিখে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে বলে দাবি করে। আল্লাহ তা’আলা তাদের এহেন কাজের নিন্দা করেছেন।
এখানে ৭৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় কুরআনের অন্যতম প্রাচীন তাফসির গ্রন্থ তাফসির তাবারীতে বলা হয়েছে,
“...হযরত মুসা (আ.)-এর উপর অবতীর্ণ আল্লাহ পাকের কিতাবে বনী ইসরাঈলের কিছু য়াহুদী পরিবর্তন করে। তারা এর পরিবর্তে নিজেদের মনগড়া কথা লিপিবদ্ধ করে। এরপর তারা দুনিয়ার সামান্য স্বার্থ লাভের উদ্দেশ্যে এৰ কিতাবকে এমন সম্প্রদায়ের নিকট বিক্রি করে, যাদের কিতাব সম্পর্কে কোন জ্ঞান নেই এবং তাওরাত সম্পর্কে তারা জানে না। বরং তারা অল্লাহ তাআলার কিতাব সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। … হযরত মুজাহিদ (র.) এ আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় বলেন যে, এরা ঐ সমস্ত লোক, যারা উপলদ্ধি করে যে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। তবুও তারা তা পরিবর্তন করে। হযরত মুজাহিদ (র.) থেকে অনুরূপ আরো একটি বর্ণনা রয়েছে। তবে এ বর্ণনায় উল্লেখ আছে, অতঃপর তারা তাকে পরিবর্তন করে। হযরত কাতাদাহ (র.) থেকে বর্ণিতঃ যারা নিজেদের হাতে কিতাব রচনা করে, তারা য়াহুদী। হযরত কাতাদাহ (র.) থেকে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তার একটি সনদে বর্ণিত আছে যে, বনী ইসরাঈলের কিছু লোক নিজেদের হাতে কিতাব রচনা করত। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, লোকদের নিকট থেকে খাদ্য সামগ্রী সংগ্রহ করা। তারা বলত- এটা আল্লাহর নিকট থেকে অবতীর্ণ হয়েছে, অথচ তা আল্লাহর নিকট থেকে অবতীর্ণ নয়।
হযরত আবুল ‘আলিয়াহ(র.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেনঃ তাদের কিতাবে আল্লাহ তাআলা হযরত মুহাম্মদ(ﷺ)-এর যে সকল গুণাবলী অবতীর্ণ করেছেন, তারা সেগুলোকে ইচ্ছানুসারে পরিবর্তন করে দিত। এতে তাদের উদ্দেশ্য ছিল দুনিয়ার কিছু স্বার্থ অন্বেষণ করা। … হযরত উসমান ইবন ‘আফফান (রা.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেনঃ দোযখের একটি পাহাড়ের নাম ‘আল-ওয়ায়ল'। এ আয়াত য়াহুদীদের প্রসংগে নাযিল হয়েছে। কারণ, তারা তাওরাতকে পরিবর্তন করেছে। তারা এতে তাদের পসন্দনীয় বিষয়কে যোগ করেছে এবং তাদের অপসন্দনীয় বিষয়ক বাদ দিয়েছে। তারা তাওরাত থেকে হযরত মুহাম্মাদ(ﷺ)--এর নাম উঠিয়ে দিয়েছে। আল্লাহ পাক এ জন্য তাদের উপর নারায হয়েছেন এবং তাওরাতের কিছু অংশ তুলে নিয়েছেন। এবং ইরশাদ করেন---
فَوَيْلٌ لَّهُم مِّمَّا كَتَبَتْ أَيْدِيهِمْ وَوَيْلٌ لَّهُم مِّمَّا يَكْسِبُونَ
অর্থাৎ তাদের হাতের লিখনের কারণে তাদের জন্য ধ্বংস এবং এর সাহায্যে তারা যা কিছু অর্জন করত, তাও তাদের ধ্বংসের উপকরণ।” [3]
কুরআনের তাফসিরের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস(রা.) এর ব্যাখ্যাও ছিলো অনুরূপ। সহীহ বুখারীতে একাধিক স্থানে তাঁর থেকে এই অভিমত বর্ণিত আছে।
أَنَّ ابْنَ عَبَّاسٍ قَالَ كَيْفَ تَسْأَلُونَ أَهْلَ الْكِتَابِ عَنْ شَيْءٍ وَكِتَابُكُمْ الَّذِي أُنْزِلَ عَلَى رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَحْدَثُ تَقْرَءُونَهُ مَحْضًا لَمْ يُشَبْ وَقَدْ حَدَّثَكُمْ أَنَّ أَهْلَ الْكِتَابِ بَدَّلُوا كِتَابَ اللهِ وَغَيَّرُوهُ وَكَتَبُوا بِأَيْدِيهِمْ الْكِتَابَ وَقَالُوا هُوَ مِنْ عِنْدِ اللهِ لِيَشْتَرُوا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلاً أَلاَ يَنْهَاكُمْ مَا جَاءَكُمْ مِنْ الْعِلْمِ عَنْ مَسْأَلَتِهِمْ لاَ وَاللهِ مَا رَأَيْنَا مِنْهُمْ رَجُلاً يَسْأَلُكُمْ عَنْ الَّذِي أُنْزِلَ عَلَيْكُمْ
অর্থঃ “ইবনু ‘আব্বাস (রা.) বলেছেন, তোমরা কিভাবে আহলে কিতাবদেরকে কোন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর? অথচ তোমাদের কিতাব (আল-কুরআন) তাঁর রাসুল(ﷺ)-এর উপর এখন অবতীর্ণ হয়েছে, তা তোমরা পড়ছ যা পূত-পবিত্র ও নির্ভেজাল। এ কিতাব তোমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছে, আহলে কিতাবরা আল্লাহর কিতাবকে পরিবর্তিত ও বিকৃত করে দিয়েছে। তারা নিজ হাতে কিতাব লিখে তা আল্লাহর কিতাব বলে ঘোষণা দিয়েছে, যাতে এর দ্বারা সামান্য সুবিধা লাভ করতে পারে। তোমাদের কাছে যে ইলম আছে তা কি তোমাদেরকে তাদের কাছে কোন মাসআলা জিজ্ঞেস করতে নিষেধ করছে না? আল্লাহর কসম! আমরা তো তাদের কাউকে দেখিনি কখনো তোমাদের উপর নাযিল করা কিতাব সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করতে।” [4]
অন্য বর্ণনায় আছে, তিনি বলেছেন,
وَقَدْ حَدَّثَكُمُ اللَّهُ أَنَّ أَهْلَ الْكِتَابِ بَدَّلُوا مَا كَتَبَ اللَّهُ وَغَيَّرُوا بِأَيْدِيهِمُ الْكِتَابَ، فَقَالُوا هُوَ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ، لِيَشْتَرُوا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلاً
অর্থঃ “…তদুপরি আল্লাহ তোমাদের জানিয়ে দিয়েছেন যে, আহলে কিতাবরা আল্লাহ যা লিখে দিয়েছিলেন, তা পরিবর্তন করে ফেলেছেন এবং নিজ হাতে সেই কিতাবের বিকৃতি সাধন করে তা দিয়ে তুচ্ছ মূল্যের উদ্দেশ্যে প্রচার করেছে যে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকেই অবতীর্ণ। …” [5]
মুক্বাতিল বিন সুলাইমান(র.) [মৃত্যুঃ ১৫০ হিজরী] এর তাফসির গ্রন্থটি আল কুরআনের অন্যতম প্রাচীন তাফসির গ্রন্থ। সেখানে সুরা বাকারাহর ৭৯ নং আয়াতের তাফসিরে বলা হয়েছে,
سوى نعت محمد، عليه السلام، وذلك أن رءوس اليهود بالمدينة محوا نعت محمد صلى الله عليه وسلم من التوراة، وكتبوا سوى نعته،
অর্থঃ “মুহাম্মাদ(ﷺ) এর বর্ণনা ব্যতিত। কারণ মদিনার ইহুদিদের নেতারা তাওরাত থেকে মুহাম্মাদ(ﷺ) এর বর্ণনা মুছে দিতো। তারা সেখানে অন্য বর্ণনা লিখে দিতো।” [6]
এখানে এই ব্যাখ্যাকারীদের মধ্যে ইবন আব্বাস(রা.) এবং উসমান(রা.) ছিলেন সাহাবী, যাঁরা সরাসরি নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) এর ছাত্র। বাকিরা তাবিঈ, যাঁরা একাধিক সাহাবীর ছাত্র এবং তাঁদের সকলের শিক্ষকের হিসেবে ছিলেন কুরআনের তাফসিরের ব্যাপারে প্রসিদ্ধ সাহাবী ইবন আব্বাস(রা.)। খ্রিষ্টান মিশনারীরা অনেক সময় প্রচার করে প্রাচীন মুসলিমরা নাকি তাওরাত—ইঞ্জিল অবিকৃত বলে বিশ্বাস করতো! কিন্তু উপরের এই সংক্ষিপ্ত আলোচনাতেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে তাদের এইসব প্রচারণা সঠিক নয়। আমরা সামনের আলোচনায় এমন আরো দলিল-প্রমাণ দেখবো ইন শা আল্লাহ।
আল কুরআনে আরো বলা হয়েছে,
(12) ۞ وَلَقَدْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ بَنِي إِسْرَائِيلَ وَبَعَثْنَا مِنْهُمُ اثْنَيْ عَشَرَ نَقِيبًا ۖ وَقَالَ اللَّهُ إِنِّي مَعَكُمْ ۖ لَئِنْ أَقَمْتُمُ الصَّلَاةَ وَآتَيْتُمُ الزَّكَاةَ وَآمَنتُم بِرُسُلِي وَعَزَّرْتُمُوهُمْ وَأَقْرَضْتُمُ اللَّهَ قَرْضًا حَسَنًا لَّأُكَفِّرَنَّ عَنكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَلَأُدْخِلَنَّكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ۚ فَمَن كَفَرَ بَعْدَ ذَٰلِكَ مِنكُمْ فَقَدْ ضَلَّ سَوَاءَ السَّبِيلِ
(13) فَبِمَا نَقْضِهِم مِّيثَاقَهُمْ لَعَنَّاهُمْ وَجَعَلْنَا قُلُوبَهُمْ قَاسِيَةً ۖ يُحَرِّفُونَ الْكَلِمَ عَن مَّوَاضِعِهِ ۙ وَنَسُوا حَظًّا مِّمَّا ذُكِّرُوا بِهِ ۚ وَلَا تَزَالُ تَطَّلِعُ عَلَىٰ خَائِنَةٍ مِّنْهُمْ إِلَّا قَلِيلًا مِّنْهُمْ ۖ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاصْفَحْ ۚ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ
অর্থঃ "নিশ্চয় আল্লাহ বনী-ইস্রাঈলের অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন এবং তাদের মধ্য হতে বারো জন নেতা নিযুক্ত করেছিলেন আর বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গে আছি, তোমরা যদি নামায পড়, যাকাত দাও, আর আমার রসূলগণকে বিশ্বাস কর ও তাদেরকে সাহায্য কর এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান কর, তাহলে তোমাদের পাপরাশি অবশ্যই মোচন করব এবং নিশ্চয় তোমাদেরকে বেহেশ্তে প্রবেশাধিকার দান করব; যার পাদদেশে নদীমালা প্রবাহিত। এর পরও তোমাদের মধ্যে যে অবিশ্বাস করবে সে সরল পথ হারাবে।’ তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের দরুন আমি তাদেরকে অভিসম্পাত করেছি ও তাদের হৃদয় কঠোর করে দিয়েছি, তারা (তাওরাতের) বাক্যাবলীর পরিবর্তন সাধন করে থাকে এবং তারা যা উপদিষ্ট হয়েছিল তার একাংশ ভুলে গেছে। তুমি সর্বদা ওদের অল্পসংখ্যক ব্যতীত সকলেরই তরফ হতে বিশ্বাসঘাতকতার সংবাদ পেতে থাকবে। সুতরাং তুমি ওদেরকে ক্ষমা কর ও উপেক্ষা কর। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরকে ভালবাসেন।" [7]
এখানে ১৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসির তাবারীতে বলা হয়েছে,
“ يُحَرِّفُونَ الْكَلِمَ عَن مَّوَاضِعِهِ - এর ব্যাখ্যাঃ ইমাম আবু জাফর তাবারী (র.) বলেন,
… আল্লাহ তা'আলা তাদের অন্তর হতে ঈমান ও তাওফীক উৎপাটিত করেছেন বিধায় তারা তাদের নবী মূসা আলায়হিস্ সালামের প্রতি অবতীর্ণ তাদের প্রতিপালকের বাণী বিকৃত করে। অর্থাৎ তারা তাওরাত গ্রন্থের মাঝে পরিবর্তন সাধন করে এবং নিজেদের হাতে অন্য রকম কথা লিখে অজ্ঞদের কাছে বলে বেড়ায় যে, এটাই তো আল্লাহর সে বাণী, যা তিনি তার নবী মূসা (আ.)-এর প্রতি নাযিল করেছেন। এই তো সেই তাওরাত, যা তিনি তার কাছে প্রত্যাদেশ করেছেন।
এটা হচ্ছে মূসা আলায়হিস-সালামের পরবর্তীকালের ইয়াহুদীদের অবস্থা। এদের কতেক রাসূলুল্লাহ(ﷺ) এর কালেও বিদ্যমান ছিল। কিন্তু আল্লাহ তা'আলা মূসা (আ.)-এর জীবদ্দশাকালীন ইয়াহুদীদের আলোচনার মাঝে এদেরও উল্লেখ করে দিয়েছেন। কারণ এরা তাদেরই সন্তান এবং আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা বলার স্বভাব তাদের মত এদের মাঝেও পুরোপুরি বিদ্যমান। এরাও তাদেরই মত বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা কথা বলে। তাদের ন্যায় এরাও তাওরাতে গৃহীত অংগীকার ভংগ করে।” [8]
প্রিয় পাঠক, লক্ষ করুন। ইমাম তাবারী(র.) আয়াতের ব্যাখ্যায় ইহুদি কর্তৃক লিখিতভাবে তাওরাত বিকৃতির কথা উল্লেখ করেছেন। তারা শুধু ভুল ব্যাখ্যাই করতো না বরং তাওরাতের লিখিত রূপ পরিবর্তন করে দিতো।
وَمِنَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّا نَصَارَىٰ أَخَذْنَا مِيثَاقَهُمْ فَنَسُوا حَظًّا مِّمَّا ذُكِّرُوا بِهِ فَأَغْرَيْنَا بَيْنَهُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ إِلَىٰ يَوْمِ الْقِيَامَةِ ۚ وَسَوْفَ يُنَبِّئُهُمُ اللَّهُ بِمَا كَانُوا يَصْنَعُونَ
অর্থঃ “এবং যারা বলে, ‘আমরা নাসারা’ (খ্রিষ্টান), তাদেরও অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু তারা যা উপদিষ্ট হয়েছিল, তার একাংশ ভুলে বসে। সুতরাং আমি তাদের মাঝে কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী শত্রুতা ও বিদ্বেষ জাগরুক রেখেছি। আর তারা যা করত, আল্লাহ অচিরেই তাদেরকে তা জানিয়ে দেবেন।” [9]
এর ব্যাখ্যায় তাফসির তাবারীতে বলা হয়েছে,
“ইমাম আবু জা'ফর তাবারী (র.) বলেন, আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে ইরশাদ করছেন যে, আমি খৃষ্টান সম্প্রদায় হতে আমার আনুগত্য, বিধি-বিধান আদায়, রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস ও তাঁদের অনুসরণের প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলাম। কিন্তু তারাও এ ব্যাপারে পথভ্রষ্ট ইয়াহুদী জাতির নীতি অনুসরণ করে। তাদেরই মত তারা তাদের দীনে বিকৃতি সাধন করে তাদেরই অনুরূপ প্রতিশ্রুতি ভংগ করে, আমার আদেশ-নিষেধ পালনের যে অংগীকার নিয়েছিলাম, তার অংশবিশেষ পরিত্যাগ করে এবং আমার দীন বরবাদ করে ।
যেমন বর্ণিত হয়েছেঃ
১১৫৯৬. হযরত কাতাদা (র) وَمِنَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّا نَصَارَىٰ أَخَذْنَا مِيثَاقَهُمْ فَنَسُوا حَظًّا مِّمَّا ذُكِّرُوا بِهِ এর ব্যাখ্যায় বলেন, তারা তাদের সম্মুখে বিদ্যমান মহান আল্লাহর কিতাব ভুলে যায়, মহান আল্লাহর গৃহীত প্রতিশ্রুতি ও তার আদেশ নিষেধ বিস্মৃত হয়। …” [10]
আমরা কুরআনের কিছু আয়াত ও এ ব্যাপারে সাহাবী-তাবিঈ ও প্রাচীন উলামাদের ব্যাখ্যা দেখলাম। এবার আমরা কুরআনের প্রসিদ্ধ তাফসিরকারী সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস(রা.) এর একটি দীর্ঘ বক্তব্য দেখবো। যাতে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের দ্বীন ও কিতাব বিকৃতির ব্যাপারে বেশ বড় একটি ইতিহাস জানা যাবে।
عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ كَانَتْ مُلُوكٌ بَعْدَ عِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ عَلَيْهِ الصَّلَاة وَالسَّلَامُ بَدَّلُوا التَّوْرَاةَ وَالْإِنْجِيلَ وَكَانَ فِيهِمْ مُؤْمِنُونَ يَقْرَءُونَ التَّوْرَاةَ قِيلَ لِمُلُوكِهِمْ مَا نَجِدُ شَتْمًا أَشَدَّ مِنْ شَتْمٍ يَشْتِمُونَّا هَؤُلَاءِ إِنَّهُمْ يَقْرَءُونَ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمْ الْكَافِرُونَ وَهَؤُلَاءِ الْآيَاتِ مَعَ مَا يَعِيبُونَّا بِهِ فِي أَعْمَالِنَا فِي قِرَاءَتِهِمْ فَادْعُهُمْ فَلْيَقْرَءُوا كَمَا نَقْرَأُ وَلْيُؤْمِنُوا كَمَا آمَنَّا فَدَعَاهُمْ فَجَمَعَهُمْ وَعَرَضَ عَلَيْهِمْ الْقَتْلَ أَوْ يَتْرُكُوا قِرَاءَةَ التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ إِلَّا مَا بَدَّلُوا مِنْهَا فَقَالُوا مَا تُرِيدُونَ إِلَى ذَلِكَ دَعُونَا فَقَالَتْ طَائِفَةٌ مِنْهُمْ ابْنُوا لَنَا أُسْطُوَانَةً ثُمَّ ارْفَعُونَا إِلَيْهَا ثُمَّ اعْطُونَا شَيْئًا نَرْفَعُ بِهِ طَعَامَنَا وَشَرَابَنَا فَلَا نَرِدُ عَلَيْكُمْ وَقَالَتْ طَائِفَةٌ مِنْهُمْ دَعُونَا نَسِيحُ فِي الْأَرْضِ وَنَهِيمُ وَنَشْرَبُ كَمَا يَشْرَبُ الْوَحْشُ فَإِنْ قَدَرْتُمْ عَلَيْنَا فِي أَرْضِكُمْ فَاقْتُلُونَا وَقَالَتْ طَائِفَةٌ مِنْهُمْ ابْنُوا لَنَا دُورًا فِي الْفَيَافِي وَنَحْتَفِرُ الْآبَارَ وَنَحْتَرِثُ الْبُقُولَ فَلَا نَرِدُ عَلَيْكُمْ وَلَا نَمُرُّ بِكُمْ وَلَيْسَ أَحَدٌ مِنْ الْقَبَائِلِ إِلَّا وَلَهُ حَمِيمٌ فِيهِمْ قَالَ فَفَعَلُوا ذَلِكَ فَأَنْزَلَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ وَرَهْبَانِيَّةً ابْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ إِلَّا ابْتِغَاءَ رِضْوَانِ اللَّهِ فَمَا رَعَوْهَا حَقَّ رِعَايَتِهَا وَالْآخَرُونَ قَالُوا نَتَعَبَّدُ كَمَا تَعَبَّدَ فُلَانٌ وَنَسِيحُ كَمَا سَاحَ فُلَانٌ وَنَتَّخِذُ دُورًا كَمَا اتَّخَذَ فُلَانٌ وَهُمْ عَلَى شِرْكِهِمْ لَا عِلْمَ لَهُمْ بِإِيمَانِ الَّذِينَ اقْتَدَوْا بِهِ فَلَمَّا بَعَثَ اللَّهُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَلَمْ يَبْقَ مِنْهُمْ إِلَّا قَلِيلٌ انْحَطَّ رَجُلٌ مِنْ صَوْمَعَتِهِ وَجَاءَ سَائِحٌ مِنْ سِيَاحَتِهِ وَصَاحِبُ الدَّيْرِ مِنْ دَيْرِهِ فَآمَنُوا بِهِ وَصَدَّقُوهُ فَقَالَ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَآمِنُوا بِرَسُولِهِ يُؤْتِكُمْ كِفْلَيْنِ مِنْ رَحْمَتِهِ أَجْرَيْنِ بِإِيمَانِهِمْ بِعِيسَى وَبِالتَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ وَبِإِيمَانِهِمْ بِمُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَتَصْدِيقِهِمْ قَالَ يَجْعَلْ لَكُمْ نُورًا تَمْشُونَ بِهِ الْقُرْآنَ وَاتِّبَاعَهُمْ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لِئَلَّا يَعْلَمَ أَهْلُ الْكِتَابِ يَتَشَبَّهُونَ بِكُمْ أَنْ لَا يَقْدِرُونَ عَلَى شَيْءٍ مِنْ فَضْلِ اللَّهِ الْآيَةَ
অর্থঃ “ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ঈসা ইবন মারয়াম (আ.)-এর পর এমন কয়েকজন বাদশাহ ছিলেন, যারা তাওরাত এবং ইঞ্জিলে পরিবর্তন সাধন করেন। তাদের মধ্যে এমন কিছু ঈমানদার লোকও ছিলেন, যারা তাওরাত পাঠ করতেন। তখন তাদের বাদশাহদেরকে বলা হলো—এ সকল লোক আমাদেরকে যে গালি দিচ্ছে, এর চেয়ে কঠিন গালি আর কি হতে পারে? তারা পাঠ করেঃ “যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দ্বারা মীমাংসা করে না, তারা কাফির। তাদের পড়ার মধ্যে থাকে এই আয়াত এবং ঐ সকল আয়াত, যাতে আমাদের কর্মকাণ্ডের দোষ প্রকাশ পায়। তাদেরকে আহবান করুন, তারা যেন আমরা যেরূপ পাঠ করি, সেরূপ পাঠ করে, আর আমরা যেরূপ ঈমান এনেছি, সেরূপ ঈমান আনে।
বাদশাহ তাদের সকলকে ডেকে একত্র করলেন এবং তাদের সামনে পেশ করলেন যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে, যদি না তারা তাওরাত ও ইঞ্জিল পাঠ ত্যাগ করে, তবে ঐ সকল আয়াত ব্যতীত, যা পরিবর্তন হয়েছে। তারা বললোঃ এর দ্বারা তোমাদের উদ্দেশ্য কী? আমাদেরকে আমাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দাও। তাদের একদল বললোঃ আমাদের জন্য একটি স্তম্ভ তৈরি কর, এরপর আমাদেরকে তাতে চড়িয়ে দাও এবং আমাদেরকে এমন কিছু দান কর, যা দ্বারা আমরা আমাদের খাদ্য ও পানীয় উঠিয়ে নিতে পারি, তা হলে আমরা আর তোমাদের নিকট আসবো না।
তাদের আর একদল বললোঃ আমাদেরকে ছেড়ে দাও, আমরা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াবো এবং বন্য পশুর ন্যায় আহার ও পান করবো। আর এরপর যদি তোমাদের দেশে আমাদেরকে পাও, তবে আমাদেরকে হত্যা করো। তাদের আর একদল বললোঃ মরুভূমিতে আমাদের জন্য গির্জা তৈরি করে দাও। আমরা কূপ খনন করবো এবং তরি-তরকারি ফলাব, আমরা তোমাদের কাছেও আসবো না এবং তোমাদের পাশ দিয়ে কোথাও যাব না। আর এমন কোন গোত্র ছিল না, যাতে তাদের আত্মীয়-স্বজন না ছিল। পরে তারা এরূপই করলো। তখন আল্লাহ্ তা'আলা আয়াত নাযিল করেনঃ “তারা নিজেরাই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য সন্যাসবাদ প্রবর্তন করেছিল। আমি তাদেরকে এর বিধান দেইনি, অথচ তারা তাও যথাযথভাবে পালন করেনি” (হাদীদঃ ২৭)।
অন্যান্য লোকেরা বলতে লাগলোঃ আমরাও ইবাদত-বন্দেগী করব, যেমন অমুক করে থাকে, আমরাও ভ্রমণ করব, যেমন অমুক ভ্রমণ করে থাকে এবং আমরাও গির্জা তৈরি করব, যেমন অমুক লোকেরা করে থাকে। অথচ তারা শিরকে পতিত ছিল, তারা যাদের অনুকরণ করছিল, তাদের ঈমান সম্বন্ধেও অবহিত ছিল না। যখন আল্লাহ্ তা'আলা নবী(ﷺ)-কে প্রেরণ করলেন, তখন তাদের মধ্যে কিছু লোক অবশিষ্ট ছিল। তাদের মধ্যে যে ইবাদতখানায় ছিল, সে ইবাদতখানা হতে নেমে আসলো, ভ্রমণকারী তার ভ্রমণ হতে ফিরে আসলো, গির্জাবাসী তার গিজা হতে নেমে আসলো। তারা তাঁর প্রতি ঈমান আনলো এবং তাকে বিশ্বাস করলো।
এ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা'আলা বলেন, “হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়ন কর, তা হলে তিনি তোমাদেরকে তাঁর রহমতে দ্বিগুণ দান করবেন (হাদীদঃ ২৮)। এক তো ঈসা (আ.)-এর উপর ঈমান আনয়ন ও তাওরাত-ইঞ্জিলে বিশ্বাস স্থাপনের কারণে। আর দ্বিতীয়ত মুহাম্মদ(ﷺ)-এর উপর ঈমান আনা এবং তাঁকে সত্যবাদী জানার কারণে। আল্লাহ্ বলেন, “তিনি তোমাদেরকে দেবেন আলো, যার সাহায্যে তোমরা চলবে [অর্থাৎ কুরআন এবং নবী(ﷺ) এর অনুসরণ] যেন আহলে কিতাব জানতে পারে, আল্লাহর সামান্যতম অনুগ্রহের উপরও তাদের কোন অধিকার নেই। (হাদীদঃ ২৮), অর্থাৎ যেই কিতাবীগণ তোমাদের অনুকরণ করে, অথচ ঈমান আনে না, তারা ।” [11]
এর দ্বারা জানা গেলো কিভাবে শাসকের দ্বারা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাওরাত-ইঞ্জিল বিকৃত করা হয়েছে। এই বর্ণনার তথ্য থেকে বোঝা যায় যে ঐ শাসকেরা হয়তো সেই বিকৃত তাওরাত-ইঞ্জিলের অনুসারী ছিল, সেই অনুযায়ী ‘ঈমান’ রাখতো এবং তারা অন্যদেরকেও তাদের মতো হতে বলতো, তাদের মতো কিতাব পাঠ করতে বলতো নচেৎ হত্যা করতে চাইতো। সহজ কথায়, নিজ ধর্মীয় বিশ্বাসে নিয়ে আসতে জোর করতো। [তাদেরকে আহবান করুন, তারা যেন আমরা যেরূপ পাঠ করি, সেরূপ পাঠ করে, আর আমরা যেরূপ ঈমান এনেছি, সেরূপ ঈমান আনে। বাদশাহ তাদের সকলকে ডেকে একত্র করলেন এবং তাদের সামনে পেশ করলেন যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে, যদি না তারা তাওরাত ও ইঞ্জিল পাঠ ত্যাগ করে, তবে ঐ সকল আয়াত ব্যতীত, যা পরিবর্তন হয়েছে। ] এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে এখানে হয়তো অত্যাচারী রোম সম্রাটদের কথা বলা হচ্ছে যারা খ্রিষ্ট ধর্মে বিকৃতি সাধন করেছিলো এবং যাদের আমলে বিভিন্ন কাউন্সিল বা সম্মেলনের দ্বারা বাইবেলের জন্য ‘উপযুক্ত’ পুস্তকসমূহ ‘নির্বাচিত’ করা হয়েছিলো। অন্য পুস্তকগুলো বাতিল করা হয়েছিলো। [12] ভিন্ন বিশ্বাসের খ্রিষ্টানদেরকে বিশেষত যিশুকে ঈশ্বরের সমান মানতে না চাওয়া Arian খ্রিষ্টানদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শাস্তি দেয়া হচ্ছিলো। [13] ভিন্ন বিশ্বাসের খ্রিষ্টানদেরকে ‘Heretic’ আখ্যা দিয়ে হত্যা করা হচ্ছিলো। [14] ঐ সময়ে মরুভূমিসহ বিভিন্ন অঞ্চলে কঠোর সন্যাসব্রত অবলম্বন করা খ্রিষ্টান দল তৈরি হয়। [15] এগুলো ঐতিহাসিক সত্য। ইবন আব্বাস(রা.) এর বক্তব্যে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে।
কুরআনের আয়াত এবং সাহাবী-তাবিঈদের ব্যাখ্যা ও বক্তব্যগুলো দ্বারা আহলে কিতাবদের ধর্মগ্রন্থের মাঝে বিকৃতির বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে বোঝা যাচ্ছে।
১.৩। আহলে কিতাবদের ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে নবী(ﷺ) এর বক্তব্যঃ
আহলে কিতাবদের ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে আল কুরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্য এবং সালাফে সলিহীনদের পরিষ্কার ব্যাখ্যা মওজুদ থাকা সত্ত্বেও খ্রিষ্টান মিশনারীরা এগুলোর অপব্যাখ্যা করে এ থেকেও তাদের বাইবেলের সত্যতা প্রমাণের চেষ্টা করে। এবার আমরা আহলে কিতাবদের ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে নবী(ﷺ) এর কিছু হাদিস দেখবো। এই হাদিসগুলোকে সামনে রাখলে আর কোনো অপব্যাখ্যার সুযোগই থাকে না।
নবী(ﷺ) বলেছেন,
أنَّهُ أَتَى الشامَ فرأَى النصارى يسجُدُونَ لِأَحْبَارِهِمْ وعُلَمَائِهِمْ وفُقَهائِهِمْ فقال لِأَيِّ شيءٍ تفعلونَ هذا قالوا هذِهِ تحيَّةُ الأنبياءِ قُلْنَا فنحْنُ أحقُّ أنْ نصنَعَ بِنَبِيِّنَا صلَّى اللهُ عليه وسلَّم فلمَّا قدِمَ علَى النبيِّ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم سجَدَ فقَالَ ما هذا يا معاذُ قال إني أتيتُ الشامَ فرأيْتُ النصارى يسجدونَ لِأَساقِفَتِهِمْ وقِسِّيسِيهِمْ ورهبانِهم وبطارِقَتِهم ورأيتُ اليهودَ يسجدونَ لأحبارِهِم وفقهائِهِم وعلمائِهِم فقلْتُ أيُّ شيءٍ تصنعونَ هذا وتفعلونَ هذا قالوا هذِهِ تَحِيَّةُ الأنبياءِ قلتُ فنحنُ أحقُّ أن نصنعَ بِنَبِيِّنَا فقالَ نبيُّ اللهِ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم إِنَّهُمْ كذَبُوا عَلَى أنبيائِهِم كَمَا حَرَّفُوا كِتَابَهُمْ
অর্থঃ [বর্ণনাকারী মুআয বিন জাবার(রা.)] তাঁর থেকে বর্ণিত আছে, তিনি একবার শামে গেলেন এবং দেখতে পেলেন যে, খ্রিষ্টানরা তাদের পণ্ডিত, যাজক এবং (কিতাবের) আইনজ্ঞদেরকে সিজদা করছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কেন এই কাজ করো?” তারা বললো, “এটা তো নবীদের সম্ভাষণ”। আমরা বললাম, আমরাই তো আমাদের নবী(ﷺ) কে এটা করার অধিক হকদার। আমরা যখন নবী(ﷺ) এর কাছে ফিরে এলাম, তাঁকে সিজদা করলাম।
তিনি বললেন, “এটা কী, মুআয?”
তিনি বললেন, “আমি শামে গিয়েছিলাম আর সেখানে দেখলাম খ্রিষ্টানরা তাদের বিশপ, পুরোহিত, সাধু এবং প্যাট্রিয়ার্কদেরকে সিজদা করছে। ইহুদিদেরকে দেখলাম তাদের আহবার, আইনজ্ঞ এবং পণ্ডিতদেরকে সিজদা করছে। তাই আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমরা কিভাবে এই কাজ করো ও কেন এই কাজ করো?” তারা বলেছিলো, “এটা তো নবীদের সম্ভাষণ”। আমি বললাম, আমরাই তো আমাদের নবী(ﷺ) কে এটা করার অধিক হকদার।”
নবী(ﷺ) বললেন, “নিশ্চয়ই তারা তাদের নবীদের উপর মিথ্যারোপ করেছে যেভাবে তারা তাদের কিতাব বিকৃত করেছে। …” [16]
আরো একটি হাদিস উল্লেখ করছিঃ
ইবন আবূ হাতিম (র.) ..... আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) হইতে বর্ণনা করেন। আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলিয়াছেনঃ “বনী ইসরাঈলের নিকট আসমানী কিতাব নাযিল হইবার পর দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হইয়া গেল। তাহাদিগের অন্তর পাষাণ হইয়া যায় এবং তাহারা আসমানী কিতাবের পরিবর্তে নিজেদের চাহিদা, রুচি ও স্বার্থ অনুযায়ী কিতাব আবিষ্কার করিয়া লয়। এবং তাহারা পরস্পর এই পরিকল্পনা করে যে, চল আমরা বনী ইসরাঈলদেরকে আমাদিগের এই কিতাব অনুসরণ করিবার আহ্বান জানাই। ফলে যে ইহা অনুসরণ করিবে তাহাকে আমরা ছাড়িয়া দিব আর যাহারা ইহা প্রত্যাখ্যান করিবে তাহাকে হত্যা করিব। কার্যত তাহারা উহাই করিল।” [17]
নবী(ﷺ) এর হাদিসের সত্যতার প্রতিফলন আমরা এখনকার বাইবেলের মাঝেও পাই। এ ব্যাপারে প্রবন্ধের শেষাংশে [“৩। বাইবেল নিজেই সাক্ষ্য দেয় এর মাঝে অবিকৃত তাওরাত নেই, এর অনেক পুস্তক হারিয়ে গেছে” অনুচ্ছেদে] আলোচনা করা হবে ইন শা আল্লাহ।
নবী(ﷺ) এর হাদিস থেকেও আহলে কিতাবদের ধর্মগ্রন্থের মাঝে বিকৃতির বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। কুরআন এবং বিশুদ্ধ হাদিস থেকে বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত। ইহুদি-খ্রিষ্টানদের নবীদের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্য কিতাব অবতীর্ণ হয়েছিলো। মুসলিমরা সেইসব কিতাবের উপর ঈমান রাখবে। কিন্তু এটিও সত্য যে পরবর্তীকালে অনুসারীদের মাঝে সেগুলো আর অবিকৃত অবস্থায় নেই। বিকৃত হয়ে গেছে। কুরআন-সুন্নাহ থেকে এটিই প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটিই ইসলামী আকিদা বা বিশ্বাস। এই প্রসঙ্গে কুরআনে এবং নবী(ﷺ) এর হাদিসে কী বলা হয়েছে তা মুসলিমদের নিকট সংরক্ষিত আছে। এই প্রসঙ্গে সাহাবী, তাবিঈ, তাবে-তাবিঈগণ এবং পূর্বযুগের উলামাদের ব্যাখ্যা কী ছিলো তাও মুসলিমদের নিকট সংরক্ষিত আছে। মুসলিমরা এখান থেকেই তাদের আকিদা-বিশ্বাস নেয় এবং নেবে। হাজার বছর পরে কেউ নতুন করে কোনো ব্যাখ্যা তৈরি করলে তা কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না।
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " لَيَأْتِيَنَّ عَلَى أُمَّتِي مَا أَتَى عَلَى بَنِي إِسْرَائِيلَ حَذْوَ النَّعْلِ بِالنَّعْلِ حَتَّى إِنْ كَانَ مِنْهُمْ مَنْ أَتَى أُمَّهُ عَلاَنِيَةً لَكَانَ فِي أُمَّتِي مَنْ يَصْنَعُ ذَلِكَ وَإِنَّ بَنِي إِسْرَائِيلَ تَفَرَّقَتْ عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ مِلَّةً وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِي عَلَى ثَلاَثٍ وَسَبْعِينَ مِلَّةً كُلُّهُمْ فِي النَّارِ إِلاَّ مِلَّةً وَاحِدَةً قَالُوا وَمَنْ هِيَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِي " . قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ مُفَسَّرٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ لاَ نَعْرِفُهُ مِثْلَ هَذَا إِلاَّ مِنْ هَذَا الْوَجْهِ .
অর্থঃ “আবদুল্লাহ ইবনু আমর(রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেনঃ বনী ইসরাঈল যে অবস্থায় পতিত হয়েছিল, নিঃসন্দেহে আমার উম্মাতও সেই অবস্থার সম্মুখীন হবে, যেমন একজোড়া জুতার একটি আরেকটির মতো হয়ে থাকে। এমনকি তাদের মধ্যে কেউ যদি প্রকাশ্যে তার মায়ের সাথে ব্যভিচার করে থাকে, তবে আমার উন্মাতের মধ্যেও কেউ তাই করবে। আর বনী ইসরাঈল ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল। আমার উন্মাত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। শুধু একটি দল ছাড়া তাদের সবাই জাহান্নামী হবে। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সে দল কোনটি? তিনি বললেনঃ আমি ও আমার সাহাবীগণ যার উপর প্রতিষ্ঠিত।” [18]
১.৪। ‘তাহরিফ’ শব্দের অর্থঃ
কুরআন-হাদিসে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থের প্রসঙ্গে ‘তাহরিফ’ (تحريف) এবং সমজাতীয় কিছু শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থে ‘তাহরিফ’ ঘটেছে। খ্রিষ্টান মিশনারীরা অনেক সময় এই শব্দের ব্যাপারে অপব্যাখ্যা করে বলেন, এর দ্বারা শুধুমাত্র অর্থের পরিবর্তন বা বিকৃতি বোঝাতে পারে, এর দ্বারা লিখিত রূপের বিকৃতি বোঝায় না।
‘তাহরিফ’ (تحريف) শব্দের অর্থ আলোচনা করতে গিয়ে এডওয়ার্ড উইলিয়াম লেনের অভিধানে (Lane’s Lexicon) বলা হয়েছে,
حَرْفٌ, (S, Msb,) He turned the thing from its proper way, or manner: (K:) or altered it therefrom: (Msb:) and ↓ حرّفهُ, inf. n. تَحْرِيفٌ, has this latter meaning: (K, * TA:) or has an intensive signification of this kind. (Msb.) الكَلِمِ عَنْ ↓ تَحْرِيفُ مَوَاضِعِهِ signifies The altering words from their proper meanings: (S, * TA:) and agreeably with this explanation, the verb is used in the Kur iv. 48, &c.: (TA:) or تحريف signifies the perverting of language: (Msb:) or the altering a word in form; as in writing بُرْدٌ for بَرْدٌ; or vice versâ: (KT:) [and the mistranscribing a word in any manner: commonly used in this sense in the lexicons &c.: or the altering a word by substituting one letter, or more, for another, or others. See also صَحَّفَ.] [19]
এখানে ‘তাহরিফ’ (تحريف) এর মানে হিসেবে অর্থের বিকৃতির কথা যেমন বলা হয়েছে, তেমনি আরো বলা হয়েছেঃ “ تحريف শব্দের দ্বারা ভাষার বিকৃতিকে বোঝানো হয়। অথবা কোনো শব্দের রূপ বদলে দেয়াকে বোঝায়। যেমন, بُرْد এর স্থলে بَرْدٌ লেখা অথবা এর উল্টোটা করা। এবং কোনো শব্দকে যে কোনো উপায়ে ভুলভাবে লিপিবদ্ধ করা। …অথবা কোনো শব্দকে এক বা একাধিক অক্ষর বদলে দিয়ে বিকৃত করা … ।”
‘তাহরিফ’ এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া(র.) ‘আকিদাতুল হামাওয়িয়্যাহ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,
“ তাহরিফঃ
ভাষাগতভাবে – বদলে দেয়া বা পরিবর্তন করা।
প্রায়োগিকভাবে – কোনো লেখার মাঝে উচ্চারণ বা অর্থ বদলে দেয়া। এটি ৩ উপায়ে হতে পারে।
১) শব্দ বদলে দেয়া যার ফলে অর্থ বদলে যায়। …
২) শব্দ বদলে দেয়া যার ফলে অর্থ বদলায় না। …
৩) অর্থ বদলে দেয়াঃ কোনো প্রমাণ ছাড়াই শব্দের সর্বাপেক্ষা প্রকাশ্য অর্থ থেকে এর অর্থকে অন্য দিকে নিয়ে যাওয়া। … ” [20]
এখানে তাহরিফের শেষ প্রকারটি অর্থের সাথে সম্পর্কিত হলেও তাহরিফের প্রথম দুইটি প্রকারে শব্দের লিখিত রূপ বদলে যায়। খ্রিষ্টান মিশনারীরা শুধু শেষ প্রকারটি উল্লেখ করে আর প্রথম দুইটি প্রকারের কথা গোপন করে। এভাবে তারা মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে, “কুরআন-হাদিসে আহলে কিতাবদের ধর্মগ্রন্থের ‘তাহরিফ’ দ্বারা বোঝানো হয়েছে কিছু ইহুদি বা খ্রিষ্টান এর অর্থ বদলে দিতো। কিতাবের লিখিত রূপের কোনো বিকৃতি এর দ্বারা বোঝায় না।” কিন্তু খ্রিষ্টান মিশনারীদের এহেন ব্যাখ্যা সঠিক নয় তা ‘তাহরিফ’ শব্দের অর্থ ও সংজ্ঞা দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। কুরআন-হাদিসে যেখানে আহলে কিতাবদের ধর্মগ্রন্থের ‘তাহরিফ’ এর কথা বলা হয়েছে, সেখানে তাদের কিতাবের লিখিত রূপের বিকৃতিও শামিল।
১.৪.১। ইবন আব্বাস(রা.) ও তাহরিফঃ
খ্রিষ্টান মিশনারীরা ইমাম বুখারী(র.) কর্তৃক ইবন আব্বাস(রা.) এর একটি বর্ণনা উল্লেখ করে দাবি করে ইবন আব্বাস(রা.) ‘তাহরিফ’ কথাটির দ্বারা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের গ্রন্থের শব্দের বিকৃতি নয় বরং শুধুমাত্র অর্থের বিকৃতির কথা বোঝাতেন।
قال قتادة مكتوب يسطرون يخطون في أم الكتاب جملة الكتاب وأصله ما يلفظ ما يتكلم من شيء إلا كتب عليه وقال ابن عباس يكتب الخير والشر يحرفون يزيلون وليس أحد يزيل لفظ كتاب من كتب الله عز وجل ولكنهم يحرفونه يتأولونه على غير تأويله دراستهم تلاوتهم واعية حافظة وتعيها تحفظها
অর্থঃ “… কাতাদা র. বলেন, ‘মাসতুর' শব্দের অর্থ লিপিবদ্ধ'; আর ইয়াসতুরুন' শব্দের অর্থ লিখছে; ‘উম্মুল কিতাব' শব্দের দ্বারা আসল, খাঁটী ও সংকলিত কিতাবকে বুঝানো হয়েছে; ‘মা ইয়ালফাযু' অর্থ যে কথাই বলা হোক তা লিখে রাখা হয়। ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ভালো-মন্দ সবই লিখে রাখা হয়। ইউহাররিফুন' অর্থ স্থানচ্যুত করা। এমন কোনো লোক নেই যে মহান আল্লাহর কিতাবের কোনো শব্দ বিলুপ্ত করতে পারে। যার দৃষ্টিভঙ্গী ও চিন্তাধারা আল্লাহর কিতাবের উদ্দেশ্যের পরিপন্থী, কেবল সে-ই তার পরিবর্তন ও অপব্যাখ্যা করতে পারে। দিরাসাতুহম' অর্থ তা পাঠ করা। ওয়াইয়াহ অর্থ তার হেফাযতকারী। তামীয়াহা' অর্থ তাকে নিরাপদে রাখে।…” [22]
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, এটি সহীহ বুখারীর মূল হাদিসের অংশ নয়। বরং তা’লিকাত (উল্লেখিত সনদবিহীন বর্ণনা যা সহীহ বা দুর্বল উভয়ই হতে পারে)। এখানে উল্লেখিত ইবন আব্বাস(রা.) এর উক্তি কতটুকু বিশুদ্ধ এ বিষয়ে ‘ফাতহুল বারী’ গ্রন্থে নিয়ে আলোচনা করেছেন সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাকারক ইমাম ইবন হাজার আসকালানী(র.)।
قوله ( يحرفون : يزيلون ) لم أر هذا موصولا من كلام ابن عباس من وجه ثابت مع أن الذي قبله من كلامه وكذا الذي بعده ،
...
وقد صرح كثير من أصحابنا بأن اليهود والنصارى بدلوا التوراة والإنجيل
অর্থঃ তাঁর বক্তব্যঃ ( يحرفون : يزيلون ) আমি ইবন আব্বাস(রা.) থেকে এই বক্তব্যের কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি কর্তৃক অবিচ্ছিন্ন বর্ণনাক্রম পাইনি। যদিও এর আগের ও পরের বক্তব্যগুলো ইবন আব্বাস(রা.) এরই। …
আমাদের অনেক সাথী এটি বলেছেন যে ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা তাওরাত ও ইঞ্জিলকে পরিবর্তন/বিকৃত করে (بدلوا বাদ্দালু) ফেলেছে। …” [23]
এ থেকে বোঝা গেলো যে ইবন আব্বাস(রা.) থেকে বিশুদ্ধভাবে এই বক্তব্য প্রমাণিত নয়। বিশুদ্ধ বর্ণনা ছাড়া এই বক্তব্যের ভিত্তিতে কোনো আকিদা নেয়া যাবে না। এর বিপরীতে ইবন আব্বাস(রা.) থেকে বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত অজস্র বক্তব্য পাওয়া যায় যাতে ইহুদ-খ্রিষ্টানদের লিখিত কিতাবকে বিকৃত বলা হয়েছে। আমরা ইতিমধ্যেই এই প্রবন্ধের ১.২ অনুচ্ছেদে স্বয়ং ইবন আব্বাস(রা.) থেকেই এ সংক্রান্ত একাধিক সন্দেহাতীত বিশুদ্ধ বর্ণনা দেখেছি। সেখানে আমরা সহীহ বুখারী ৭৩৬৩ ও ২৫০৬ নং হাদিসে ইবন আব্বাস(রা.) এর বক্তব্য দেখেছি যেখানে তিনি বলেছেন ইহুদি খ্রিষ্টানরা “নিজ হাতে” কিতাব বিকৃত করেছে। স্রেফ অর্থের পরিবর্তন হলে “নিজ হাতের” কথা আসতো না। তিনি আরো বলেছেন যে, ইহুদি-খ্রিষ্টানরা নিজের হাতে কিতাব লিখে তা আল্লাহর বাণী বলে চালিয়েছে। এটা মোটেও অর্থগত বা ব্যাখ্যাগত পরিবর্তন না বরং কিতাবের লিখিত রূপের পরিবর্তন। আমরা সুনান নাসাঈ ৫৩৯৯ নং বিশুদ্ধ হাদিসটিও দেখেছি যা থেকেও পরিষ্কার ইবন আব্বাস(রা.) শুধুমাত্র অর্থ বা ব্যাখ্যার পরিবর্তনের কথা বলেননি।
তবে কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। যদিও ইবন আব্বাস(রা.) থেকে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের তাহরিফ দ্বারা শুধুমাত্র অর্থের পরিবর্তন হওয়া সংক্রান্ত এই বক্তব্য বিশুদ্ধ নয়, কিন্তু কোনো কোনো আলেম সরলমনে এই বক্তব্যটি উল্লেখ করেছেন এবং সে অনুযায়ী অভিমত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সেই মত প্রসিদ্ধ মত নয়। তা ইবন আব্বাস(রা.) এর থেকে প্রমাণিত বক্তব্যের, পূর্বযুগের অনেক উলামার বক্তবত্যের, সর্বোপরী কুরআন-সুন্নাহর বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ ব্যাপারে শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া(র.) থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোচনা উল্লেখ করেছেন ইমাম ইবন কাসির(র.)। শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া(র.) তাঁর আলোচনায় আহলে কিতাবদের ধর্মগ্রন্থের শব্দগত (লিখিত) ও অর্থগত উভয় প্রকার তাহরিফের কথাই উল্লেখ করেছেন—
“যারা এ মত পোষণ করে যে, তাওরাত শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণই পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে এবং এর একটি অক্ষরও আসল অবস্থায় নেই, তাদের এ অভিমত কোনমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। তদ্রুপ যারা এ অভিমত পোষণ করে যে, তাওরাত আদৌ পরিবর্তন করা হয়নি, তাদের অভিমতও গ্রহণযোগ্য নয়। সত্য ও বাস্তবতা এই যে, তাওরাতের কতক শব্দে হ্রাস-বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিবর্তন, বিকৃতি ও রূপান্তর সংঘটিত হয়েছে; যেমন বিকৃতি ও পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এর মর্ম ও ব্যাখ্যায়। ভালভাবে চিন্তা করলে এটি অবগত হওয়া যায়। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ নেই। আল্লাহই ভাল জানেন।
তাদের তাওরাত বিকৃতির একটি উদাহরণ হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর পুত্র কুরবানীর ঘটনা। সেখানে আছে, “তোমার একক পুত্রকে কুরবানী কর।” তাওরাতের কোন কোন পাঠে আছেঃ “তোমার একক শিশু পুত্র ইসহাককে কুরবানী কর।” এসব কপিতে বর্ণিত ‘ইসহাক’ শব্দটি নিঃসন্দেহে তাদের নিজেদের সংযোজন। কারণ তখন হযরত ইব্রাহীমের একক ও প্রথম শিশু পুত্র ছিলেন হযরত ইসমাঈল (আ.)। হযরত ইসহাক (আ.)-এর জন্মের ১৪ বছর পূর্বে ইসমাঈল (আ)-এর জন্ম হয়। তাহলে ইসহাক (আ.) একক শিশু পুত্র হন কীভাবে? আরবদের প্রতি তাদের বিদ্বেষের প্রেক্ষিতে আরবদের পূর্ব পুরুষ হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর জন্যে কুরবানী বিষয়ক সামান নির্ধারণের জন্যে তারা আল্লাহ ও রাসূল(ﷺ) সম্বন্ধে মিথ্যা আরোপ করে ‘ইসহাক’ শব্দ সংযোজন করে দিয়েছে।
তাদের এই সংযোজনের প্রেক্ষিতে পূর্বের ও পরের অনেক লোক প্রতারিত হয়েছে এবং তাদের সাথে এ মত পোষণ করেছেন যে, কুরবানী বিষয়ক পুত্র হলেন ইসহাক (আ.)। সঠিক মতামত এই যে, কুরবানী বিষয়ক পুত্র ছিলেন হযরত ইসমাঈল (আ.)। ইতিপূর্বে আমরা তা বর্ণনা করেছি। আল্লাহই ভাল জানেন। সামিরা সম্পাদিত তাওরাতের দশম বাক্যে নামাযে তূর পর্বতের দিকে মুখ করার নির্দেশটি তাদের অতিরিক্ত সংযোজন। [24] ইয়াহুদী ও নাসারাদের অন্যান্য কপিতে এটুকু নেই। হযরত দাউদ (আ.)- এর নামে প্রচলিত যায়ূরের কপিতে প্রচুর অসংগতি পাওয়া যায়। তাতে এমন সব অতিরিক্ত ও সংযুক্ত বিষয়াদি পাওয়া যায়, যা মূলত যাবুরের ভাষ্য নয়। আল্লাহই ভাল জানেন।
ইয়াহুদীদের নিকট এখন যাবুরের যে আরবী অনুবাদ রয়েছে, তার মধ্যে যে প্রচুর বিকৃতি পরিবর্তন, সংযোজন ঘটনার মিথ্যাচারিতা ও স্পষ্ট হ্রাস-বৃদ্ধি রয়েছে, তাতে কোন বিবেকবান মানুষেরই সন্দেহ থাকতে পারে না। এ কপিতে সুস্পষ্ট মিথ্যাচার ও প্রচুর মারাত্মক ভ্রান্তি রয়েছে। তারা নিজেদের ভাষায় যা পাঠ করে এবং নিজেদের কলমে যা লিখে সে সম্পর্কে অবশ্য আমাদের জানা নেই। তবে তারা যে মিথ্যাবাদী, বিশ্বাস ভঙ্গকারী এবং আল্লাহ তাঁর রাসূল ও তাঁর কিতাব সম্পর্কে মিথ্যা আরোপকারী এরূপ ধারণা করার যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। নাসারাদের ইনজীল চতুষ্টয় যা মার্ক, লুক, মথি ও যোহন থেকে বর্ণিত, সেগুলো তাওরাতের তুলনায় আরো বেশী পরস্পর বিরোধী ও অসংগতিপূর্ণ।” [25]
ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ যে শুধুমাত্র অর্থ বা ব্যাখ্যাগত না বরং শব্দগত বা লিখিত বিকৃতির শিকার হয়েছে, ইসলামী সূত্র থেকে এর অকাট্য প্রমাণ নিয়ে এই প্রবন্ধে সামনে আরো বিস্তারিত আলোচনা আসছে ইন শা আল্লাহ।
১.৫। কুরআন পূর্বের কিতাবসমূহের সত্যায়নকারীঃ
বিভিন্ন স্থানে এটিও বলা হয়েছে যে কুরআন পূর্বের গ্রন্থগুলোর সমর্থক, সংরক্ষক বা সত্যায়নকারী। যেমনঃ
وَآمِنُوا بِمَا أَنزَلْتُ مُصَدِّقًا لِّمَا مَعَكُمْ وَلَا تَكُونُوا أَوَّلَ كَافِرٍ بِهِ ۖ وَلَا تَشْتَرُوا بِآيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلًا وَإِيَّايَ فَاتَّقُونِ
অর্থঃ “আর তোমাদের সাথে যা আছে তার সত্যায়নকারীস্বরূপ আমি যা নাযিল করেছি তার প্রতি তোমরা ঈমান আন এবং তোমরা তা প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। আর তোমরা আমার আয়াতসমূহ সামান্যমূল্যে বিক্রি করো না এবং কেবল আমাকেই ভয় কর।” [26]
وَأَنزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ الْكِتَابِ وَمُهَيْمِنًا عَلَيْهِ ۖ فَاحْكُم بَيْنَهُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ ۖ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ عَمَّا جَاءَكَ مِنَ الْحَقِّ ۚ لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا ۚ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَجَعَلَكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَلَٰكِن لِّيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آتَاكُمْ ۖ فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ ۚ إِلَى اللَّهِ مَرْجِعُكُمْ جَمِيعًا فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ
অর্থঃ “আর আমি তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি যথাযথভাবে, এর পূর্বের কিতাবের সত্যায়নকারী ও এর উপর তদারককারীরূপে। সুতরাং আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তুমি তার মাধ্যমে ফয়সালা কর এবং তোমার নিকট যে সত্য এসেছে, তা ত্যাগ করে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। তোমাদের প্রত্যেকের জন্য আমি নির্ধারণ করেছি শরীআত ও স্পষ্ট পন্থা এবং আল্লাহ যদি চাইতেন, তবে তোমাদেরকে এক উম্মত বানাতেন। কিন্তু তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে চান। সুতরাং তোমরা ভাল কাজে প্রতিযোগিতা কর। আল্লাহরই দিকে তোমাদের সবার প্রত্যাবর্তনস্থল। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে অবহিত করবেন, যা নিয়ে তোমরা মতবিরোধ করতে।” [27]
পূর্বে যেসব গ্রন্থ নাজিল হয়েছে [যেমনঃ তাওরাত, যাবুর, ইঞ্জিল] সেগুলোকে যে কুরআন সমর্থন করে, এতে তো কোনো সন্দেহেরই অবকাশ নেই। পূর্বের নবী-রাসুলদের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে যতো গ্রন্থ নাজিল হয়েছে মুসলিমরা এর উপর অবশ্যই বিশ্বাস রাখবে। আবার আহলে কিতাবদের ধর্মগ্রন্থগুলোর মাঝে সংঘটিত বিকৃতির বিষয়টিও কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। তাহলে এই কথার অর্থ কী হতে পারে যেখানে বলা হচ্ছেঃ কুরআন এদেরকে ‘সত্যায়ন’ করে?
এখানে সুরা মায়িদাহর ৪৮ নং আয়াতে ‘সত্যায়নকারী’ কথাটির সাথে আরো গুরুত্বপূর্ণ কথা সংযুক্ত আছে। আর তা হলোঃ কুরআন পূর্ববর্তী কিতাবের ‘তদারককারী’ (مُهَیۡمِنًا عَلَیۡهِ, মুহাইমিনান আলাইহি)। এই কথাটির অর্থ বোঝা গেলেই পুরো বিষয়টি সহজে বোঝা যাবে। আয়াত প্রসঙ্গে তাফসির তাবারীতে বলা হয়েছে,
“… ১২১০৬. মুজাহিদ (র) বলেন : وَمُهَيْمِنًا عَلَيْهِ অর্থ কুরআনের সংরক্ষক সাক্ষী ও সমর্থক। ইবন জুবায়র (র.) বলেন, অন্যদের মতে কুরআন অন্যান্য কিতাবের মানদণ্ড। কিতাবীগণ তাদের কিতাবের কোন বিষয় সম্পর্কে আমাদেরকে জানালে তা যদি কুরআনে থাকে তবে বুঝতে হবে তারা সত্য বলেছে, অন্যথায় তারা মিথ্যাবাদী। আবার কেউ কেউ বলেন وَمُهَيْمِنًا عَلَيْهِ অর্থ তার সত্যতার মানদন্ড (أمين)।
যাঁরা এ মত পোষণ করেনঃ
১২১০৭. ইবন আব্বাস(রা.) বলেন وَمُهَيْمِنًا عَلَيْهِ অর্থাৎ সত্যতার মানদণ্ড।
১২১০৮, ইবন আব্বাস (রা) হতে বিভিন্ন সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা রয়েছে।
১২১১৪. ইবন আব্বাস(রা.) وَمُهَيْمِنًا عَلَيْهِ এর ব্যাখ্যায় বলেন, এর অর্থ বিশ্বস্ত তথা সত্যতা নির্ণয়ের মানদণ্ড । তিনি বলেন, কুরআন তার পূর্ববর্তী সকল কিতাবের সত্যতা নির্ণয়ের মানদণ্ড।
১২১১৫. অপর সূত্রে ইবন আব্বাস(রা.) আলোচ্য আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় বলেন, এখানে কুরআন মাজীদের কথা বলা হয়েছে। এটা তাওরাত ও ইনজীলের সাক্ষী ও তার সমর্থক এবং সত্যতা নির্ণায়ক। এ কুরআন পূর্ববর্তী সকল কিতাবের ফয়সালা দানকারী।
১২১১৬, ইবন ওয়াকী(র.) এর সূত্রে বর্ণিত আছে যে, ইবন 'আব্বাস(রা.) বলেন, সত্যতা নির্ণয়ের মাপকাঠি।
১২১১৭, ইবন ওয়াকী(র.) অপর এক সূত্রে ইবন আব্বাস(রা.) হতে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
১২১১৮, ইবন আব্বাস (রা.) হতে অনুরূপ আরেকটি বর্ণনা রয়েছে।
১২১১৯, সাঈদ ইবন জুবায়র (র.) বলেন, وَمُهَيْمِنًا عَلَيْهِ অর্থ কুরআন তার পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহের সত্যতা নির্ণায়ক।
১২১২০, আবু রাজা' (র.) বলেন, আমি হুসায়ন(র.)কে আলোচ্য আয়াতাংশের অর্থ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, কুরআন এই সমস্ত কিতাবের সমর্থক এবং এর সত্যতা নির্ণয়কারী। আর 'ইকরিমা(র.) কেও আমার উপস্থিতিতে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি বললেন وَمُهَيْمِنًا عَلَيْهِ অর্থ مُؤتمِنًا عَلَيْهِ - অর্থাৎ এর সত্যতা নির্ণয়ের মাপকাঠি। … ” [28]
এই কথার অর্থ হিসেবে আরো কিছু বর্ণনা পাওয়া যায় তবে এই ব্যাখ্যাটিই ব্যাপকভাবে সালাফদের থেকে, বিশেষত ইবন আব্বাস(রা.) থেকে বর্ণিত আছে। এবং এটিই অন্যান্য আয়াতের সাথে সব থেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আল কুরআন সাধারণভাবে এইসব কিতাবের মূল বার্তাকে সমর্থন করে বা সত্যায়ন করে। এইসব কিতাবের মূল বাণী আল্লাহর একত্ববাদ, নবী-রাসুল, শেষ দিবস, জান্নাত-জাহান্নাম; যা কুরআনেও আছে। কুরআনের ভেতরে এই সকল মূল বাণী সংরক্ষিত আছে, কুরআন এদের সংরক্ষক। কিন্তু আহলে কিতাবদের এসব গ্রন্থের মাঝে বিকৃতি আছে এটিও সত্য যা কুরআন-সুন্নাহ থেকে প্রমাণিত। এসব কিতাবের মাঝে যেসব তথ্য আল কুরআনের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হবে না, সেগুলো নিশ্চিতভাবে বাতিল বলে গণ্য হবে। কেননা কুরআন হচ্ছে সত্য নির্ণয়ের মানদণ্ড। এসব কিতাব একদম ১০০% অবিকৃত আর নির্ভুল হলে তো আর আলাদা করে সত্য বের করার মানদণ্ড থাকার ব্যাপার ছিলো না। কুরআন এদেরকে সমর্থন করে বলার অর্থই এই নয় যে এসব কিতাব একদম পুরোপুরি অবিকৃত বরং কুরআনকে এদের ‘মানদণ্ড’ বা ‘তদারককারী’ বলা দ্বারা স্পষ্ট হচ্ছে যে এদের মাঝে সত্য-মিথ্যা আলাদা করার ব্যাপার আছে।
আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবন জুরাইজ(র.) এবং ইবন ওয়াহব(র.) এর বর্ণনায় বিষয়টি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।
“ইবন জুরাইজ(র.) বলেনঃ কুরআন পূর্ববর্তী সকল কিতাবের সংরক্ষক। তাই পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহের যে অংশ এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে সেইটুকু সত্য যেটুকু অংশ অসামঞ্জস্যপূর্ণ দেখা যাবে তা বাতিল ও পরিত্যাজ্য হবে।” [29]
“হযরত ইব্ন ওয়াহব (র.) হতে বর্ণিত যে, لَا تَلْبِسُوا الْحَقَّ بِالْبَاطِلِ আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত যায়দ (র.) বলেন, সত্য হচ্ছে তাওরাত গ্রন্থ যা আল্লাহ হযরত মূসা (আ.)-এর প্রতি নাযিল করেছেন এবং বাতিল হলো তা, যা তারা নিজেরা লিখেছে।” [30]
সুবিখ্যাত কুরআন অনুবাদক আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলি তাঁর ইংরেজি কুরআন অনুবাদে সুরা মায়িদাহর ৪৮ নং আয়াতে অত্যন্ত চমৎকারভাবে অল্প কথায় মুফাসসিরদের বক্তব্যগুলোর সার নির্যাস তুলে এনেছেনঃ
"After the corruption of the older revelations, the Quran comes with a twofold purpose: (1) to confirm the true and original Message and (2) to guard it, or act as a check to its interpretation. The Arabic word 'Muhaimin' is very comprehensive in meaning. It means one who safeguards, watches over, stands witness, preserves, and upholds. The Quran safeguards "the Book", for it has preserved within it the teachings of all the former Books. It watches over these Books in the sense that it will not let their true teachings to be lost. It supports and upholds these Books in the sense that it corroborates the Word of Allah which has remained intact in them. It stands a witness because it bears testimony to the Word of Allah contained in these Books and helps to sort it out from the interpretations and commentaries of the people which were mixed with it: what is confirmed by the Quran is the Word of Allah and what is against it is that of the people." [31]
অর্থাৎ, পূর্বের ঐশী গ্রন্থগুলো বিকৃত হয়ে যাবার পরে কুরআনের আগমন হয় দুইটি উদ্দেশ্য নিয়েঃ (১) [পূর্বের গ্রন্থের] সত্য এবং আসল বার্তাগুলোকে সত্যায়ন করা (২) একে রক্ষা করা অথবা এর ব্যাখ্যার মাপকাঠি হিসেবে কাজ করা। ‘মুহাইমিন’ আরবি শব্দটি বেশ সমন্বিত একটি অর্থ বহন করে। এর দ্বারা বোঝায় যে সংরক্ষণ করে, তদারক করে, সাক্ষ্যদান করে, টিকিয়ে রাখে এবং সমর্থন করে। কুরআন হচ্ছে কিতাবের সংরক্ষক কেননা এর মাঝে পূর্বের সকল কিতাবের শিক্ষা সংরক্ষিত আছে। এটি সব কিতাবের তদারক করে অর্থাৎ এটি ঐসব গ্রন্থের প্রকৃত শিক্ষাকে কখনো হারিয়ে যেতে দেয় না। এটি (কুরআন) এই গ্রন্থগুলোর সমর্থক এবং সহায়ক এই অর্থে যে, এটি এসব গ্রন্থের মাঝে যেসব আল্লাহর বাণী এখনো অবশিষ্ট আছে সেগুলোকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। কুরআন সাক্ষীস্বরূপ কেননা তা এসব গ্রন্থের মাঝে অবশিষ্ট আল্লাহর বাণীর পক্ষে সাক্ষ্য দেয় এবং এগুলোর মাঝে মিশ্রিত মানুষের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্য থেকে আল্লাহর বাণী খুঁজে বের করতে সাহায্য করে। কুরআন আল্লাহর বাণীগুলোকে সত্যায়ন করেছে। আর এর মাঝে যা কুরআনের বিরুদ্ধে যায় সেগুলো মানুষের পক্ষ থেকে সংযোজিত।
কুরআনে যদি এটাই বোঝানো হতো যে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের গ্রন্থগুলো অবিকৃত এবং নির্ভরযোগ্য, তাহলে মুসলিমদেরকে সরাসরিই আদেশ দেয়া হতো আহলে কিতাবদের তথা ইহুদি খ্রিষ্টানদের গ্রন্থগুলো বিশ্বাস করতে এবং সে অনুযায়ী আমল করতে। কিন্তু নবী(ﷺ) মুসলিমদেরকে তা করার আদেশ দেননি। বরং বলেছেন,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ كَانَ أَهْلُ الْكِتَابِ يَقْرَءُونَ التَّوْرَاةَ بِالْعِبْرَانِيَّةِ وَيُفَسِّرُونَهَا بِالْعَرَبِيَّةِ لِأَهْلِ الإِسْلاَمِ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لاَ تُصَدِّقُوا أَهْلَ الْكِتَابِ وَلاَ تُكَذِّبُوهُمْ {قُولُوا آمَنَّا بِاللهِ وَمَا أُنْزِلَ} الْآيَةَ
অর্থঃ “আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আহলে কিতাব তাওরাত হিব্রু ভাষায় পাঠ করত, আর মুসলিমদের জন্য আরবী ভাষায় এর ব্যাখ্যা করত। এ প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বললেনঃ কিতাবধারীদেরকে তোমার বিশ্বাস করো না আবার তাদেরকে মিথ্যেবাদী সাব্যস্তও করো না। বরং তোমরা আল্লাহর এ বাণীটি قُولُوا آمَنَّا بِاللهِ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْنَا (তোমরা বল, ‘আমরা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি এবং যা আমাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে) বল। (সূরাহ বাকারাহ ২/১৩৬) " [32]
এই হাদিস প্রসঙ্গে ইমাম ইবন কাসির(র.) বলেছেন,
“ইসরাঈলী বর্ণনাগুলো তিন প্রকার। (১) কতক বর্ণনা সঠিক। আল্লাহর কুরআনে বর্ণিত এবং রাসূলুল্লাহ(ﷺ) -এর হাদীসে বিবৃত ঘটনাসমূহের অনুরূপ (২) কতক বর্ণনা এরূপ যে, কুরআন ও হাদীসের সরাসরি বিপরীত হওয়ার কারণে এগুলোর অসত্য ও বানোয়াট হওয়া সুস্পষ্ট (3) কতক এমন যে, এগুলো সত্যও হতে পারে আবার মিথ্যাও হতে পারে। এ জাতীয় বর্ণনাগুলো সম্পর্কেই আমাদেরকে নীরব থাকতে বলা হয়েছে যে, আমরা এগুলোকে সত্যও বলব না, মিথ্যাও বলব না। বিশুদ্ধ হাদীসে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ্(ﷺ) বলেছেন, “ইয়াহুদী-নাসারাগণ যখন তোমাদের নিকট কোন কথা পেশ করে তখন তোমরা তাদেরকে সত্যবাদীও সব্যস্ত করো না; মিথ্যাবাদীও সাব্যস্ত করো না। বরং তোমরা বলঃ আমরা সে সবের প্রতি ঈমান এনেছি, যেগুলো আমাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে এবং তোমাদের প্রতিও নাযিল করা হয়েছে।” ইতিপূর্বে উল্লেখিত হাদীস “তোমরা ইসরাঈলীদের থেকে হাদীস বর্ণনা কর, তাতে দোষ নেই”—এর প্রেক্ষিতে এ প্রকারের উদ্ধৃতিগুলো বর্ণনা করা বৈধ।” [33]
এই হাদিসের ব্যাখ্যায় নাসরুল বারী গ্রন্থে বলা হয়েছে,
“… যেহেতু তাওরাতে বিকৃতি সাধন হয়েছিল, সেটি তার আসলরূপে ছিল না, সেহেতু প্রিয়নবী(ﷺ) মুসলিমদেরকে বিরত থাকার বা নীবরতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কারণ, ইয়াহুদীরা যা কিছু বলবে সেগুলো দু'অবস্থা শূন্য হবে না। আপনি সেগুলোকে বিশ্বাস করবেন অথচ বাস্তবে সেগুলো সহীহ নয় বরং বিকৃত। আবার এটাও হতে পারে যে, আপনি সেগুলোকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলেন অথচ বাস্তবে সেগুলো সঠিক সত্য । তাহলে তো আপনি হবেন সমালোচিত। যেহেতু আম্বিয়ায়ে কেরামের আহকাম ও শরীয়তে শাখাগত ব্যবধান ছিল সেহেতু নীরবতা অবলম্বন করাই আবশ্যক।” [34]
নবী(ﷺ) এর হাদিসের হুকুম স্পষ্ট, সাহাবী, তাবিঈ, তাবে-তাবিঈদের (সালাফ) আমলও স্পষ্ট। তাঁদের থেকে এমন উদাহরণ পাওয়া যায় না যে তাঁরা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের কিতাবগুলো অনুযায়ী আমল করতেন। বরং তাঁরা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের কিতাবগুলোকে বিকৃত বলেছেন এবং অনেক উক্তি পাওয়া যায়। এখানে আল কুরআন-সুন্নাহর বিধান ও সালাফদের বুঝ প্রকাশ্য দিবালোকের মতোই পরিষ্কার।
১.৬। ‘তাওরাত’, ‘ইঞ্জিল’ ইত্যাদি শব্দের ব্যবহারঃ
কুরআন এবং হাদিসের পরিভাষায় মুসা(আ.) এর উপর নাজিলকৃত আল্লাহর কিতাবকে ‘তাওরাত’ বলা হয়েছে, আবার ইহুদিদের নিকট রক্ষিত গ্রন্থকেও অনেক সময় ‘তাওরাত’ বলেই অভিহীত করা হয়েছে। পরিভাষার এই ব্যবহারের জন্য অনেক সময় খ্রিষ্টান মিশনারীরা অপব্যাখ্যা করে উভয়কে এক করে দেখাতে চায়। তারা বলতে চায়ঃ যেহেতু মদিনার ইহুদিদের কাছে যে কিতাব ছিলো তাকেও তাওরাত বলা হয়েছে – কাজেই এই তাওরাত আর মুসা(আ.) এর তাওরাত এক! নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) ইহুদি-খ্রিষ্টানদের তাওরাতকেই সত্য বলে বিশ্বাস করতেন! - অথচ রাসুল(ﷺ) এবং সাহাবীরা এই পরিভাষা কিভাবে ব্যবহার করেছেন তা ভালোমত লক্ষ করলেই এ নিয়ে বিভ্রান্তির আর অবকাশ থাকে না। খ্রিষ্টান মিশনারীদের অপব্যাখ্যার অসারতাও বোঝা যায়।
“ ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, রাফি' ইবন হারিসা, সালাম ইবন মিশকাম, মালিক ইবন সায়ফ ও রাফি’ ইবন হারীমালা হযরত রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর সাথে সাক্ষাত করে। তারা তাকে বলল, হে মুহাম্মদ! আপনার কি দাবি নয় যে, আপনি হযরত ইবরাহীম (আ)-এর দীন ও তাঁর ধর্মাদর্শে প্রতিষ্ঠিত এবং আমাদের তাওরাত গ্রন্থে বিশ্বাস রাখেন ও সাক্ষ্য দেন যে, তা আল্লাহর নিকট হতে অবতীর্ণ কিতাব?
প্রিয়নবী (ﷺ) বলেন, হ্যাঁ, তবে তোমরা তাওরাতে অনেক কিছু নিজেদের পক্ষ হতে সংযোজন করেছ, আর যে সকল বিষয়ে তোমাদের থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করা হয়েছিল, তোমরা তার অনেক কিছুই অস্বীকার করছ এবং তার যে সকল বিষয় মানুষের কাছে প্রকাশ করার জন্য তোমরা আদিষ্ট ছিলে, তোমরা তা গোপন করে রেখেছ। তোমাদের এসব কর্মকান্ডের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।” [35]
এই হাদিসে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নবী(ﷺ) এটি বলছেন যে তিনি ‘তাওরাতে’ বিশ্বাস করেন, সেই সাথে এটিও বলছেন যে ইহুদিরা কিভাবে তাওরাতের মাঝে সংযোজন করেছে, আবার তা থেকে গোপনও করেছে। এই বিষয়গুলোর সাথে নবী(ﷺ) নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সম্পর্কহীন ঘোষণা করেছেন। কাজেই নবী(ﷺ) ইহুদিদের তাওরাতকে পুরোপুরি সত্য বলে মানতেন এটা যে ভ্রান্তিপূর্ণ কথা তা প্রমাণিত হলো। স্বয়ং ইহুদিদের মধ্যেই ‘তাওরাত’ বা Torah শব্দ দ্বারা একাধিক জিনিস বোঝানোর রীতি আছে। প্রসঙ্গ অনুসারে ইহুদিরা ‘তাওরাত’ শব্দ দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন জিনিস বোঝায়। বাইবেলের Old Testament ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের কমন ধর্মগ্রন্থ। । সাধারণভাবে বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট বা পুরাতন নিয়মের ১ম ৫টি বইকে ইহুদিরা মুসা(আ.) এর ‘তাওরাত’(Torah) বলে গণ্য করে। হিব্রু ভাষায় তাওরাত (תּוֹרָה) মানে ‘আইন’ বা ‘বিধান’। ইহুদিরা Old Testamentকে Tanakh বলে যা ইহুদি বাইবেল (Jewish Bible) নামেও পরিচিত। কখনো কখনো বৃহত্তর অর্থে সমগ্র Tanakh / Old Testament / Jewish Bible কেও ইহুদিরা ‘তাওরাত’ বলে অভিহিত করে। আবার আরো বৃহত্তর অর্থে অনেক সময় তালমুদ-মিশনাহসহ সমগ্র ইহুদি আইনশাস্ত্রকেই ‘তাওরাত’ বলে তারা অভিহীত করে। [36] এখন কেউ যদি প্রসঙ্গ না বুঝে ইহুদিদের উদ্ধৃত ‘তাওরাত’ কথাটিকে সব সময়েই বাইবেলের ১ম ৫ বই অর্থে নেয়, সে নিঃসন্দেহে ভুল করবে। কুরআন-হাদিসের ক্ষেত্রেও একই কথা। প্রসঙ্গ অনুযায়ী ‘তাওরাত’ কথাটি দ্বারা কী বোঝানো হচ্ছে সেটি লক্ষ না রাখলে সহজেই এ থেকে ভুল ব্যাখ্যা করা যায়।
সাহাবী-তাবিঈদের থেকেও পরিভাষার এমন ব্যবহার পাওয়া যাবে। তাঁরাও নবীদের উপর নাজিলকৃত আল্লাহর কিতাবগুলোকে তাওরাত, ইঞ্জিল এই নামে ডাকতেন। আবার ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থের ব্যাপারে তাওরাত, ইঞ্জিল এই শব্দগুলোই ব্যবহার করেছেন যেহেতু ইহুদি-খ্রিষ্টানদের নিকট রক্ষিত গ্রন্থগুলোকে ঐ সময়ে আরবিতে এই নামেই ডাকা হতো। কিন্তু সাহাবী-তাবিঈরা যে বারংবার ইহুদি –খ্রিষ্টানদের গ্রন্থের বিকৃতির ব্যাপারে সাক্ষ্য দিয়েছেন এ ব্যাপারে একটু আগেই দীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে। প্রসঙ্গ অনুসারে বুঝতে হবে কখন এই পরিভাষা দ্বারা তাঁরা কোন জিনিসকে নির্দেশ করছেন। এই বিষয়টি জানা থাকলে এ ব্যাপারে আর বিভ্রান্তির অবকাশ থাকে না। দুঃখের বিষয় বহু সরলপ্রাণ মুসলিম এ ব্যাপারে অবগত নন। কাজেই শব্দের খেলা খেলে অনেক সময়ে তাদেরকে বিভ্রান্তির জালে ফেলেন খ্রিষ্টান প্রচারকরা। এই প্রবন্ধে সামনেই এ ব্যাপারে আরো বিস্তারিত আলোচনা করা হবে এবং নির্দিষ্টভাবে খ্রিষ্টান প্রচারকরা যেসব দলিল দেখিয়ে অপব্যাখ্যার চেষ্টা করেন সেগুলোর বিশ্লেষণ করা হবে। আলোচনার সুবিধার্থে পাঠকের নিকট আগেই পরিভাষার এই ব্যবহারটি উল্লেখ করা হলো।
২। খ্রিষ্টান প্রচারকরা যেসব দলিলের অপব্যাখ্যা করেঃ
প্রবন্ধের এই অংশে আমরা কিছু উদাহরণ দেখবো যেসব দলিলের অপব্যাখ্যা করে খ্রিষ্টান মিশনারী প্রমাণ করার চেষ্টা করে ইসলাম অনুযায়ী তাদের বাইবেল অবিকৃত।
২.১। আল্লাহর বাণীর কোনো পরিবর্তনকারী নেইঃ
আল কুরআনের বেশ কিছু জায়গায় বলা হয়েছে আল্লাহর বাণী পরিবর্তন করার কেউ নেই।
وَلَقَدْ كُذِّبَتْ رُسُلٌ مِّن قَبْلِكَ فَصَبَرُوا عَلَىٰ مَا كُذِّبُوا وَأُوذُوا حَتَّىٰ أَتَاهُمْ نَصْرُنَا ۚ وَلَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِ اللَّهِ ۚ وَلَقَدْ جَاءَكَ مِن نَّبَإِ الْمُرْسَلِينَ
অর্থঃ “আর অবশ্যই তোমার পূর্বে অনেক রাসূলকে অস্বীকার করা হয়েছে, অতঃপর তারা তাদেরকে অস্বীকার করা ও কষ্ট দেয়ার ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ করেছে, যতক্ষণ না আমার সাহায্য তাদের কাছে এসেছে। আর আল্লাহর বাণীসমূহের কোন পরিবর্তনকারী নেই এবং অবশ্যই রাসূলগণের কিছু সংবাদ তোমার কাছে এসেছে।” [37]
وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقًا وَعَدْلًا ۚ لَّا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ ۚ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
অর্থঃ "আর তোমার রবের বাণী সত্য ও ন্যায়পরায়ণতার দিক থেকে পরিপূর্ণ হয়েছে। তাঁর বাণীসমূহের কোন পরিবর্তনকারী নেই। আর তিনিই সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী।" [38]
وَاتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِن كِتَابِ رَبِّكَ ۖ لَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ وَلَن تَجِدَ مِن دُونِهِ مُلْتَحَدًا
অর্থঃ "আর তোমার রবের কিতাব থেকে তোমার নিকট যে ওহী পাঠানো হয়, তুমি তা তিলাওয়াত কর। তাঁর বাণীসমূহের কোন পরিবর্তনকারী নেই এবং তিনি ছাড়া কোন আশ্রয়স্থল তুমি পাবে না।" [39]
মুসলিমরা কুরআনকে যেমন ‘আল্লাহর বাণী’ বলে, তাওরাত, যাবুর, ইঞ্জিলসহ পূর্বের সকল আসমানী কিতাবকেও ‘আল্লাহর বাণী’ বলে বিশ্বাস করে। উপরের আয়াতগুলোতে দেখা যাচ্ছে ‘আল্লাহর বাণী’ পরিবর্তন করার কেউ নেই। এ থেকে খ্রিষ্টান মিশনারীরা সাধারণ মুসলিমদের বোঝানোর চেষ্টা করেনঃ কুরআন অনুযায়ী ‘আল্লাহর বাণী’কে কেউ পরিবর্তন করতে পারে না, কাজেই কুরআন থেকে মুসলিমদের বিশ্বাস করা উচিত যে তাওরাত, যাবুর, ইঞ্জিল তথা তাদের বাইবেল অবিকৃত!
আমরা একটু আগেই দেখেছি একই ‘তাওরাত’ শব্দ দ্বারা কিভাবে ভিন্ন জিনিস বোঝাতে পারে। এভাবে কালিমাহ (كلمة) বা বাণী শব্দটি দ্বারাও অনেক কিছু বোঝাতে পারে। উপরে উল্লেখিত সুরা আন’আমের ৩৪ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসির ইবন কাসিরে বলা হয়েছে,
“…তাই বলা হইয়াছে لَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِ اللَّهِ ‘আল্লাহর কথা কেহ পরিবর্তন করিতে পারে না।' অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ হইতে মুমিনদের জন্য ইহকালে ও পরকালে সাহায্যের যে অঙ্গীকার রহিয়াছে, তাহা অলংঘনীয়। যথা অন্য আয়াতে বলা হইয়াছেঃ
( 171 ) وَلَقَدْ سَبَقَتْ كَلِمَتُنَا لِعِبَادِنَا الْمُرْسَلِينَ
( 172 ) إِنَّهُمْ لَهُمُ الْمَنصُورُونَ
( 173 ) وَإِنَّ جُندَنَا لَهُمُ الْغَالِبُونَ
অর্থাৎ আমার প্রেরিত দাসদিগের [বান্দাদিগের – শারঈ সম্পাদক] সম্পর্কে আমার এই প্রতিশ্রুতি সত্য হইয়াছে যে, অবশ্যই তাহারা সাহায্যপ্রাপ্ত হইবে এবং আমার বাহিনীই হইবে বিজয়ী। (সুরা আস সফফাত ১৭১-১৭৩)
অন্যত্র তিনি বলিয়াছেনঃ
كَتَبَ اللَّهُ لَأَغْلِبَنَّ أَنَا وَرُسُلِي ۚ إِنَّ اللَّهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ
অর্থাৎ আল্লাহর সিদ্ধান্ত এই যে, তিনি এবং তাঁহার রাসূল অবশ্যই বিজয়ী হইবেন। আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী।' (সুরা মুজাদালাহ ২১)
এই আয়াতের শেষাংশেও বলা হইয়াছেঃ
وَلَقَدْ جَاءَكَ مِن نَّبَإِ الْمُرْسَلِينَ
অর্থাৎ পূর্ববর্তী রাসূলগণকে তাহাদের স্বজাতির বিরোধিতার মুখে আমি কিভাবে সাহায্য করিয়াছি তাহার খবর তো তোমাদের নিকট রহিয়াছে।' (সুরা আন’আম ৩৪) উহাতে তোমার জন্য রহিয়াছে অনুপ্রেরণার বিষয়।” [40]
উপরে উল্লেখিত সুরা কাহফের ২৭ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসির মাআরিফুল কুরআনে বলা হয়েছে,
“…তাঁর বাক্যকে (অর্থাৎ ওয়াদাসমূহকে) কেউ পরিবর্তন করতে পারে না। …” [41]
অর্থাৎ এখানে পূর্ববর্তী কিতাব বা তাওরাত, যাবুর, ইঞ্জিলের প্রসঙ্গে কিছুই বলা হচ্ছে না। বরং এখানে এটিই উল্লেখ করা হয়েছে আল্লাহর তা’আলার ওয়াদা বা অঙ্গীকার অলঙ্ঘনীয়। কেউ তা বদলাতে পারে না। প্রসঙ্গসহ আয়াতগুলো পড়লেই বোঝা যায় যে এখানে পূর্ববর্তী কিতাবের ব্যাপারে কিছু বলা হচ্ছে না। তবু পাঠকের জন্য তাফসির থেকে ব্যাখ্যা দেখানো হলো। বাংলা ভাষাতেও এভাবে একই শব্দের ভিন্নার্থে প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন নিচের বাক্যগুলো লক্ষ করুন, এখানে ‘কথা’ শব্দটি কতগুলো অর্থে প্রয়োগ হচ্ছেঃ
১। কথা দিচ্ছি, আগামীকাল বই জমা দেবো। (প্রতিশ্রুতি অর্থে)
২। আশা করি তিনি আমার কথা রাখবেন। (অনুরোধ অর্থে)
৩। এ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের কথা জানতে হবে। (ইতিহাস অর্থে)
৪। ওনার সাথে কথা বলে বড় আনন্দ পেয়েছি। (বাক্যলাপ অর্থে)
৫। অনেক দিন আগের কথা, এক দেশে এক রাজা ছিলো। (গল্প অর্থে)
উপরের বাক্যগুলোতে দেখা যাচ্ছে একই ‘কথা’ শব্দের কতো রকম অর্থ হতে পারে। প্রসঙ্গ থেকে বোঝা যায় কোন স্থানে কী অর্থ হচ্ছে। এখন কেউ যদি উপরের ১ম বাক্যে ‘কথা’ শব্দটি দেখিয়ে দাবি করে যে, ‘কথা’ তো গল্প অর্থেও ব্যবহার হয়, কাজেই এখানে মোটেও কোনো ‘প্রতিশ্রুতি’ দেয়া হচ্ছে না!! – তাহলে বিষয়টা কেমন হবে? নিঃসন্দেহে উদ্ভট হবে। খ্রিষ্টান মিশনারীরা ‘আল্লাহর বাণীর পরিবর্তনকারী নেই’ এই বক্তব্য থেকেও একইভাবে ভুল অর্থ বের করে। তারা আল কুরআন থেকে কিছু শব্দ বেছে নিয়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী অর্থ প্রয়োগ করে নিজেদের পক্ষের বিশ্বাস প্রমাণ করতে চেষ্টা করে। কিন্তু প্রসঙ্গসহ আয়াতগুলো দেখলে বোঝা যায় যে তাদের ব্যাখ্যাগুলো কীরূপ ভ্রান্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত।
এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর(র.) বলেছেন,
“আল্লাহ যে কথা বলেন তা আল্লাহর বাক্য বা কালিমা। আর আল্লাহর কালামের লিখিত রূপ ‘কিতাব’। এখানে বলা হয়েছে, আল্লাহর বাক্য বা কথা পরিবর্তন হয় না; কারণ আল্লাহ ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। কিন্তু আল্লাহর কালামের লিখিত গ্রন্থ বিকৃত হয় না তা কখনোই আল্লাহ বলেন নি। বরং তিনি বারংবার বলেছেন যে, ইহূদী-খৃস্টানগণ আল্লাহর কালামের লিখিত রূপ পরিবর্তন করেছে, অনেক কালাম ভুলে গিয়েছে বা হারিয়ে ফেলেছে এবং অনেক জাল বই লিখে আল্লাহর নামে চালিয়েছে। (২-বাকারা ৭৯, ৪-আল ইমরান: ৭৮, ৫-মায়িদা ১৩, ১৪, ৪১)” [42]
এ থেকে বোঝা গেলো তর্কের খাতিরে যদিও ধরেও নিই আলোচ্য আয়াতগুলোতে ‘আল্লাহর বাণী’ কথাটি তাওরাত, যাবুর, ইঞ্জিলের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, তবুও খ্রিষ্টান মিশনারীদের ভ্রান্ত দাবি প্রমাণ হয় না। কেননা সব আল্লাহর কালামের লিখিত রূপ যে অপরিবর্তিত থাকবে এমন নিশ্চয়তা কোথাও দেয়া হয়নি। সুনির্দিষ্টভাবে একমাত্র আল কুরআনের ক্ষেত্রে এই নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।
اِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا الذِّکۡرَ وَ اِنَّا لَهٗ لَحٰفِظُوۡنَ
অর্থঃ “আমিই জিকর (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই উহার সংরক্ষক।” [43]
আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবন কাসিরে বলা হয়েছে,
“…তা'আলা ইরশাদ করেন, তিনি যিকির অর্থাৎ আল-কুরআন অবতীর্ণ করিয়াছেন এবং তিনিই উহার মধ্যে কোনরূপ পরিবর্তন পরিবর্ধন হইতে উহাকে সংরক্ষণ করিবেন।…” [44]
আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসির যাকারিয়াতে বলা হয়েছে,
“অর্থাৎ এই বাণী, যার বাহক সম্পর্কে তোমরা খারাপ মন্তব্য করছ, আল্লাহ নিজেই তা অবতীর্ণ করেছেন। তিনি একে কোন প্রকার বাড়তি বা কমতি, পরিবর্তন বা পরিবর্ধন হওয়া থেকে হেফাযত করবেন। অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন, “বাতিল এতে অনুপ্রবেশ করতে পারে না—সামনে থেকেও না, পিছন থেকেও না। এটা প্রজ্ঞাময়, স্বপ্রশংসিতের কাছ থেকে নাযিলকৃত।” [সূরা ফুসসিলাত: ৪২] আরও বলেছেন, “নিশ্চয় এর সংরক্ষণ ও পাঠ করাবার দায়িত্ব আমাদেরই। কাজেই যখন আমরা তা পাঠ করি আপনি সে পাঠের অনুসরণ করুন, তারপর তার বর্ণনার দায়িত্ব নিশ্চিতভাবে আমাদেরই।” [সূরা আল-কিয়ামাহঃ ১৭–১৯]। সুতরাং একে বিকৃত বা এর মধ্যে পরিবর্তন সাধন করার সুযোগও তোমরা কেউ কোনদিন পাবে না। আল্লাহ্ তাআলা স্বয়ং এর হেফাযত করার কারণে শক্ররা হাজারো চেষ্টা সত্ত্বেও এর মধ্যে কোন পরিবর্তন আনতে পারেনি।” [45]
২.২। কুরআনে তাদেরকে জিজ্ঞেস করতে বলা হয়েছে যারা আগে কিতাব পড়েছেঃ
খ্রিষ্টান মিশনারীরা কুরআন থেকে কিছু আয়াত দেখিয়ে দাবি করে যে এসব স্থানে পূর্বে যারা কিতাব অধ্যায়ন করেছে অর্থাৎ ইহুদি-খ্রিষ্টানদেরকে জিজ্ঞেস করতে বলা হয়েছে। তাদের কিতাব যদি বিকৃত হতো, তাহলে কেন এভাবে জিজ্ঞেস করতে বলা হলো? তারা এ প্রসঙ্গে যেসব আয়াত দেখায়ঃ
وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنَا مِنۡ قَبۡلِکَ اِلَّا رِجَالًا نُّوۡحِیۡۤ اِلَیۡهِمۡ فَسۡـَٔلُوۡۤا اَهۡلَ الذِّکۡرِ اِنۡ کُنۡتُمۡ لَا تَعۡلَمُوۡنَ
অর্থঃ "আর আমি তোমার পূর্বে কেবল পুরুষদেরকেই রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছি, যাদের প্রতি আমি ওহী পাঠিয়েছি। সুতরাং জ্ঞানীদের জিজ্ঞাসা কর, যদি তোমরা না জানো।" [46]
وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنَا قَبۡلَکَ اِلَّا رِجَالًا نُّوۡحِیۡۤ اِلَیۡهِمۡ فَسۡـَٔلُوۡۤا اَهۡلَ الذِّکۡرِ اِنۡ کُنۡتُمۡ لَا تَعۡلَمُوۡنَ
অর্থঃ “আর তোমার পূর্বে আমি পুরুষই পাঠিয়েছিলাম, যাদের প্রতি আমি ওহী পাঠাতাম। সুতরাং তোমরা জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞাসা কর যদি তোমরা না জান।” [47]
এখানে সুরা নাহলের ৪৩ নং আয়াত এবং সুরা আম্বিয়ার ৭ নং আয়াতে প্রায় একই কথা বলা হয়েছে। সুরা নাহলের ৪৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসির ইবন কাসিরে বলা হয়েছে,
“যাহহাক(র.) হযরত ইবনে আব্বাস(রা.) হইতে বর্ণনা করেন, আল্লাহ তা'আলা যখন হযরত মুহাম্মাদ(ﷺ)কে নবী হিসাবে প্রেরণ করিলেন তখন আরবের লোকেরা তাহাকে অস্বীকার করিয়া বসিল এবং তাহারা বলিতে লাগিল কোন মানুষকে রাসূল বানাইবার আল্লাহর কোন প্রয়োজন নাই। আল্লাহ ইহা হইতে অনেক ঊর্ধ্বে। অতঃপর আল্লাহ তা'আলা অবতীর্ণ করিলেন أَكَانَ لِلنَّاسِ عَجَبًا أَنْ أَوْحَيْنَا إِلَىٰ رَجُلٍ مِّنْهُمْ أَنْ أَنذِرِ النَّاسَ “ইহা কি মানুষের জন্য আশ্চার্যের কারণ হইয়াছে যে তাহাদের মধ্যে হইতেই এক ব্যক্তির নিকট আমি ওহী অবতীর্ণ করিয়াছি যে, “তুমি মানুষকে সতর্ক করিয়া দাও।” ” তিনি আরো ইরশাদ করেনঃ وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنَا مِنۡ قَبۡلِکَ اِلَّا رِجَالًا نُّوۡحِیۡۤ اِلَیۡهِمۡ فَسۡـَٔلُوۡۤا اَهۡلَ الذِّکۡرِ اِنۡ کُنۡتُمۡ لَا تَعۡلَمُوۡنَ “আপনার পূর্বেও কেবল মানুষকেই রাসূল বানাইয়া প্রেরণ করিয়াছি যাহাদের নিকট আমি ওহী অবতীর্ণ করিতাম। যদি তোমরা না জান তবে বিজ্ঞ লোকদের নিকট জিজ্ঞাসা কর।” অর্থাৎ আহলে কিতাবের নিকট জিজ্ঞাসা কর যে তাহারা কি মানুষ ছিলেন না ফিরিশতা ছিলেন। যদি তাহারা ফিরিশতাই হইয়া থাকেন তবে তোমাদের অস্বীকার করা অন্যায় নহে। কিন্তু যদি তাহারা মানুষ হইয়া থাকেন তবে হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)কে নবী হিসাবে অস্বীকার করা তোমাদের উচিৎ নহে। ইরশাদ হইয়াছে وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ إِلَّا رِجَالًا نُّوحِي إِلَيْهِم مِّنْ أَهْلِ الْقُرَىٰ - অর্থাৎ পূর্বে যাহাদিগকে রাসূল হিসাবে প্রেরণ করিয়াছি তাহারা মানুষই ছিলেন যাহারা এই দুনিয়ার জনবসতীরই অধিবাসী ছিলেন তাহারা আসমান হইতে অবতীর্ণ হইতেন না। …” [48]
অর্থাৎ এখানে সম্বোধণ করা হয়েছে মুশরিকদের, যারা মানতে পারতো না আল্লাহ তা’আলা কোনো মানবকে রাসুল হিসেবে প্রেরণ করেছেন। আল কুরআন বিশ্বজগতের জন্য গ্রন্থ। কুরআন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষকে সম্বোধণ করেছে। আহলে কিতাব অর্থাৎ ইহুদি-খ্রিষ্টানরা মুসলিমদের সাথে এই বিষয়ে একমত যে আল্লাহ তা’আলা অতীতে মানব-রাসুল প্রেরণ করেছেন। কাজেই মুশরিকরা যদি এই বিষয়ে আহলে কিতাবদের নিকট জিজ্ঞেস করে, তাহলে ইসলামের দাবির পক্ষেই সত্যতা পাবে। মুশরিকদেরকে এই সম্বোধণ করার পর কী ঘটেছে, সেই ইতিহাসও আমাদের নিকট সংরক্ষিত আছে। তাফসির মাআরিফুল কুরআনে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসির মাআরিফুল কুরআনে বলা হয়েছে,
“রুহুল মাআনীতে বলা হয়েছে, এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর মক্কার মুশরিকরা মদীনার ইহুদীদের কাছে তথ্যানুসন্ধানের জন্য দূত প্রেরণ করল। তারা জানতে চাইল যে, বাস্তবিকই পুর্বেও সব পয়গম্বর মানব জাতির মধ্য থেকে প্রেরিত হয়েছেন কি না।
اَهۡلَ الذِّکۡرِ ---শব্দটি গ্রন্থধারী সম্প্রদায় ও মুসলমান সবাইকে বোঝায় ।
কিন্তু একথা সুস্পষ্ট যে, মুশরিকরা অমুসলমানদের বর্ণনা দ্বারাই তুষ্ট হতে পারত। কারণ তারা স্বয়ং রসুলুল্লাহ্র(ﷺ) বর্ণনায় সন্তুষ্ট ছিল না। এমতাবস্থায় মুসলমানদের বর্ণনা তারা কিরূপে মানতে পারত। اَهۡلَ الذِّکۡرِ - ذِّکۡرِ শব্দটি একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়। তন্মধ্যে এক অর্থ জ্ঞান। এ অর্থের সাথে সম্পর্ক রেখে কোরআন পাকে তওরাতকে ذِّکۡرِ বলা হয়েছে।
وَلَقَدْ كَتَبْنَا فِي الزَّبُورِ مِن بَعْدِ الذِّكْرِ, এবং কোরআনকেও ذِّکۡرِ শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে, যেমন এর পরের আয়াতে
أَنزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ বলে কোরআন বোঝানো হয়েছে। অতএব اَهۡلَ الذِّکۡرِ --এর শাব্দিক অর্থ দাঁড়াল বিদ্বান, জ্ঞানবান। এখানে স্পষ্টতই বিদ্বান বলে গ্রন্থধারী ইহুদী ও খৃষ্টান পণ্ডিতদেরকে বোঝানো হয়েছে। ইবনে আব্বাস, হাসান, সুদ্দী প্রমুখ তাই বলেছেন। … ” [49]
দেখা যাচ্ছে এই আয়াত নাজিলের পর মক্কার মুশরিকরা সত্যি সত্যি বিষয়টি যাচাইয়ের জন্য মদিনায় ইহুদিদের কাছে দূত পাঠিয়েছিলো! তাদের ক্ষেত্রে এরূপ করার কথা বলার কারণও তাফসিরে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মুশরিকদের যেহেতু নবী(ﷺ) এর দাবি মনঃপুত হচ্ছে না, তারা অন্ততপক্ষে আহলে কিতাবদের থেকে বিষয়টি জেনে নিক। আজকের দিনেও কারো যদি এরূপ সন্দেহ থাকে, তার জন্যও এই আয়াত প্রযোজ্য হবে। বিকৃত হওয়া সত্ত্বেও আহলে কিতাবদের ধর্মগ্রন্থে আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের নিকট নবী-রাসুল প্রেরণের যে ধারার উল্লেখ আছে, একে কুরআন সত্যায়ন করে। আর তাদের গ্রন্থে যেসব জায়গায় ভুল তথ্য আছে, কুরআন এর বিরোধিতা করে। (এই প্রবন্ধে ইতিমধ্যেই এ ব্যাপারে দীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে।) কাজেই সে হিসেবে বলা হয়েছে সন্দেহ থাকলে মুশরিকরা আহলে কিতাবদেরকে জিজ্ঞেস করে বিষয়টি যাচাই করুক। এ দ্বারা মোটেও এটি প্রমাণ হচ্ছে না যে মুসলিমদেরকে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ থেকে সত্য-মিথ্যা নির্ণয় করতে হবে!
খ্রিষ্টান মিশনারীরা এ প্রসঙ্গে আরো দলিল দেখায় যেখানে স্বয়ং নবী(ﷺ)কে সম্বোধণ করা হয়েছেঃ
(93) وَلَقَدْ بَوَّأْنَا بَنِي إِسْرَائِيلَ مُبَوَّأَ صِدْقٍ وَرَزَقْنَاهُم مِّنَ الطَّيِّبَاتِ فَمَا اخْتَلَفُوا حَتَّىٰ جَاءَهُمُ الْعِلْمُ ۚ إِنَّ رَبَّكَ يَقْضِي بَيْنَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِيمَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ
(94) فَإِن كُنتَ فِي شَكٍّ مِّمَّا أَنزَلْنَا إِلَيْكَ فَاسْأَلِ الَّذِينَ يَقْرَءُونَ الْكِتَابَ مِن قَبْلِكَ ۚ لَقَدْ جَاءَكَ الْحَقُّ مِن رَّبِّكَ فَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُمْتَرِينَ
( 95 ) وَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِ اللَّهِ فَتَكُونَ مِنَ الْخَاسِرِينَ
অর্থঃ “আমি বানী ইসরাঈলকে মর্যাদাপূর্ণ আবাসস্থলে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম আর তাদেরকে উত্তম রিযক দিয়েছিলাম। অতঃপর তাদের কাছে (আল্লাহর প্রেরিত) সঠিক জ্ঞান আসার পূর্ব পর্যন্ত তারা মতভেদ করেনি। তারা যে বিষয়ে মতভেদ করেছিল কিয়ামাত দিবসে তোমার প্রতিপালক অবশ্যই তা মীমাংসা করে দিবেন। আমি তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে যদি তুমি সন্দেহ পোষণ কর তাহলে তোমার পূর্বে থেকে যারা কিতাব পাঠ করে আসছে তাদেরকে জিজ্ঞেস কর। তোমার কাছে তোমার প্রতিপালকের নিকট থেকে প্রকৃত সত্য এসেছে। কাজেই তুমি কক্ষনো সন্দেহ পোষণকারীদের মধ্যে শামিল হয়ো না। আর তুমি কক্ষনো তাদের মধ্যে শামিল হয়ো না যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যে জেনে অমান্য করে, তাহলে তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।” [50]
এর ব্যাখ্যায় তাফসির ইবন কাসিরে বলা হয়েছে,
“কাতাদাহ ইবনে দিআমাহ(র.) বলেন, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) ইরশাদ করিয়াছেন, “আমি সন্দেহও করি না আর জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজনও বোধ করি না।" হযরত ইবনে আব্বাস (রা.), সায়ীদ ইবনে জুবাইর এবং হাসান বসরী (র.) ও অনুরূপ বর্ণনা করিয়াছেন।
গ্রন্থকার বলেন, উপরোক্ত আয়াতসমূহের মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা এই উম্মতকে স্বীয় শরীয়তের উপর দৃঢ় থাকিবার জন্য উৎসাহিত করা হইয়াছে। এবং এই কথা জানানো হইয়াছে যে, নবী করীম(ﷺ)-এর গুণাবলী পূর্ববর্তী কিতাব সমূহের মধ্যেও উল্লেখ করা হইয়াছে। যেমন ইরশাদ হইয়াছে, الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الْأُمِّيَّ الَّذِي يَجِدُونَهُ مَكْتُوبًا عِندَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنجِيلِ - অর্থাৎ যাহারা উম্মী নবীর অনুসরণ করে তাহারা এই কারণে অনুসরণ করে যে তাহারা তাহার গুণাবলীর কথা তাওরাত এবং ইঞ্জীলেও লিখিত পায় ('আরাফ-১৫৭)। তাহারা নবী করীম(ﷺ)-এর রিসালতের সত্যতা এত ভালভাবে জানে যেমন তাহাদের সন্তান-সন্তুতিদিগকে জানে। ইহা সত্ত্বেও তাহারা এই সত্যকে গোপন করে এবং তাওরাত ও ইঞ্জিলের মধ্যে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে। দলীল প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাহারা ঈমান আনে না। … ” [51]
এখানে প্রসঙ্গসহ আয়াতটি দেখলেই বোঝা যাচ্ছে যে ঘূণাক্ষরেও ইহুদি-খ্রিষ্টান বা তাদের কিতাব অনুসরণের কথা বলা হচ্ছে না। আয়াতের তাফসির থেকে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়েছে। তবু আরো স্পষ্ট করার জন্য একটি উদাহরণ উল্লেখ করছি। ধরা যাক বলা হলোঃ
“করোনায় আক্রান্ত হতে চাইলে মাস্ক ছাড়া ভিড়ের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করতে থাকো! দয়া করে রোগ বাধিও না।” – এই কথার দ্বারা কি কেউ বুঝবে যে এখানে মাস্ক ছাড়া ভিড়ে হাঁটাহাঁটি করার আদেশ দেয়া হয়েছে? উত্তর হচ্ছেঃ না। বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় শেষ বাক্যটি দ্বারাঃ “দয়া করে রোগ বাধিও না।” এর দ্বারা স্পষ্ট হচ্ছে যে বক্তার উদ্দেশ্য এটা না যে রোগ বাধানোর সংকল্প করে ঐ ব্যক্তি মাস্ক ছাড়াই হাঁটাহাঁটি করুক।
এবার কুরআনের আলোচ্য আয়াতগুলোর ভাষারীতি লক্ষ করুন।এখানে “যদি তুমি সন্দেহ পোষণ কর তাহলে তোমার পূর্বে থেকে যারা কিতাব পাঠ করে আসছে তাদেরকে জিজ্ঞেস কর” এই কথা বলার একটু পরেই বলা হয়েছেঃ ”তুমি কক্ষনো সন্দেহ পোষণকারীদের মধ্যে শামিল হয়ো না” । প্রিয় পাঠক, কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কি এ থেকে বুঝবে যে এখানে আহলে কিতাবদের ধর্মগ্রন্থ অনুসরণ করতে বলা হয়েছে? প্রশ্নই ওঠে না। কুরআন কখনো নিজেই নিজের প্রতি সন্দেহ পোষণের আদেশ দেয় না। বরং কুরআনে সাধারণভাবে বলা হয়েছে যে, বনী ইস্রাঈল বিষয়ক তথ্যগুলোর বিষয়ে সন্দেহ হলে পূর্ববর্তী গ্রন্থগুলি থেকে যাচাই করতে পারো। আর সেটা যদি করা হয় তাহলেও কুরআনের মূল বার্তার সাথেই মিল পাওয়া যাবে। বনী ইস্রাঈলের অনেক নবী-রাসুলের কাহিনী ও বনী ইস্রাঈলের পরিণতির ঘটনার সাথে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ আর কুরআন একমত। কিন্তু কুরআন মোটেও কাউকে সন্দেহপোষণকারী হতে বলছে না। বরং এরপরে আরো জোর দিয়ে বলছেঃ “আর তুমি কক্ষনো তাদের মধ্যে শামিল হয়ো না যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যে জেনে অমান্য করে, তাহলে তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।” মানে আহলে কিতাবদের মতো হতে নিষেধ করা হচ্ছে। যেই জায়গায় আহলে কিতাবদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে নিষেধ করা হচ্ছে, সেই জায়গা দেখিয়ে দাবি করা হচ্ছে এখানে নাকি আহলে কিতাবদের ধর্মগ্রন্থ মানার আদেশ দেয়া হচ্ছে! মূলত খ্রিষ্টান মিশনারীরা আগের-পরের অংশ গোপন করে মাঝখান থেকে এক অংশ উদ্ধৃত করে। যার ফলে মানুষ ধোঁকায় পড়ে। আয়াতের তাফসিরে দেখা যায় নবী (ﷺ) “আমি সন্দেহও করি না আর জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজনও বোধ করি না" এই কথা বলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তাঁর উম্মতের জন্যও করণীয় এটিই। এই আয়াতে বরং উম্মতকে স্বীয় শরীয়তের উপর দৃঢ় থাকবার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। বাইবেল পড়তে বলা তো দূরের কথা। আয়াতের হুকুম যা, খ্রিষ্টান মিশনারীরা এর সম্পূর্ণ উল্টো জিনিস মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করে।
২.৩। ইহুদি-খ্রিষ্টানদের কাছে কাছে আছে ‘তাওরাত-ইঞ্জিল’, তা দিয়ে বিচার করা ও এগুলো প্রতিষ্ঠা করতে বলাঃ
খ্রিষ্টান মিশনারীরা দাবি করে যে কুরআন-হাদিসে বিভিন্ন স্থানে বলা হয়েছে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের নিকট তাওরাত-ইঞ্জিল আছে, কুরআনে এগুলো অনুসারে বিচার করার কথা বলা হয়েছে।
وَكَيْفَ يُحَكِّمُونَكَ وَعِندَهُمُ التَّوْرَاةُ فِيهَا حُكْمُ اللَّهِ ثُمَّ يَتَوَلَّوْنَ مِن بَعْدِ ذَٰلِكَ ۚ وَمَا أُولَٰئِكَ بِالْمُؤْمِنِينَ
অর্থঃ “আর কীভাবে তারা তোমাকে ফয়সালাকারী বানায়? অথচ তাদের কাছে রয়েছে তাওরাত, যাতে আছে আল্লাহর বিধান, তা সত্ত্বেও তারা এরপর মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং তারা মুমিনও নয়।” [52]
عَنْ أَبِي الدَّرْدَاءِ، قَالَ كُنَّا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَشَخَصَ بِبَصَرِهِ إِلَى السَّمَاءِ ثُمَّ قَالَ " هَذَا أَوَانٌ يُخْتَلَسُ الْعِلْمُ مِنَ النَّاسِ حَتَّى لاَ يَقْدِرُوا مِنْهُ عَلَى شَيْءٍ " . فَقَالَ زِيَادُ بْنُ لَبِيدٍ الأَنْصَارِيُّ كَيْفَ يُخْتَلَسُ مِنَّا وَقَدْ قَرَأْنَا الْقُرْآنَ فَوَاللَّهِ لَنَقْرَأَنَّهُ وَلَنُقْرِئَنَّهُ نِسَاءَنَا وَأَبْنَاءَنَا . فَقَالَ " ثَكِلَتْكَ أُمُّكَ يَا زِيَادُ إِنْ كُنْتُ لأَعُدُّكَ مِنْ فُقَهَاءِ أَهْلِ الْمَدِينَةِ هَذِهِ التَّوْرَاةُ وَالإِنْجِيلُ عِنْدَ الْيَهُودِ وَالنَّصَارَى فَمَاذَا تُغْنِي عَنْهُمْ " .
অর্থঃ “আবুদ দারদা(রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আমরা নবী(ﷺ) এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি আসমানের দিকে চোখ তুলে তাকালেন। পরে বললেনঃ এ-ই হল লোকদের থেকে ইলম ছিনিয়ে নেওয়ার ক্ষণ। এমনকি ইলম বিষয়ে তাদের কোন ক্ষমতা থাকবে না। যিয়াদ ইবন লাবীদ আনসারী বললেনঃ আমাদের থেকে কেমন করে ইলম ছিনিয়ে নেওয়া হবে, অথচ আমরা কুরআন পড়েছি। আল্লাহর কসম, অবশ্যই তা আমরা পড়ব এবং আমাদের স্ত্রী-কন্যা ও সন্তান-সন্ততিদের তা পড়াব। তিনি বললেনঃ তোমার মা তোমাকে হারিয়ে ফেলুক, হে যিয়াদ। আশ্চর্য, আমি তো তোমাকে মদীনাবাসী প্রজ্ঞাবানদের একজন বলে গণ্য করতাম। ইয়াহূদী-নাসারাদের কাছেও তো এই তওরাত-ইনজিল আছে। কিন্ত কি উপকার হয়েছে তাদের? …” [53]
ইতিমধ্যেই এই প্রবন্ধে “১.৫। কুরআন পূর্বের কিতাবসমূহের সত্যায়নকারী” এ অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে যে ইহুদিদের তাওরাতের মাঝে এখনো কিছু আল্লাহর বাণী অবশিষ্ট আছে। পাশাপাশি এতে কিছু সংযোজন-বিয়োজন তথা বিকৃতিও আছে। কাজেই ইহুদিদের তাওরাতের মাঝে আল্লাহর বিধান আছে – এই কথা বলার দ্বারাই প্রমাণ হয় না তাদের তাওরাত অবিকৃত। এ ছাড়া এই প্রবন্ধে “১.৬। ‘তাওরাত’, ‘ইঞ্জিল’ ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার” এই অনুচ্ছেদে আলোচনা করা হয়েছে কিভাবে সে সময়ের প্রচলিত ভাষাতেই ইহুদি-খ্রিষ্টানদের গ্রন্থকে ‘তাওরাত’, ‘ইঞ্জিল’ ইত্যাদি পরিভাষা ব্যবহার করেই ডাকা হয়েছে। এর দ্বারা মোটেও প্রমাণ হয় না এগুলো নবীদের উপর নাজিলকৃত হুবহু সেই তাওরাত ও ইঞ্জিল।
আরো একটি হাদিস দেখিয়ে দাবি করা হয় নবী(ﷺ) ইহুদিদের তাওরাতকে অবিকৃত বলে বিশ্বাস করতেন।
، عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ: أَتَى نَفَرٌ مِنْ يَهُودٍ، فَدَعَوْا رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى الْقُفِّ، فَأَتَاهُمْ فِي بَيْتِ الْمِدْرَاسِ، فَقَالُوا: يَا أَبَا الْقَاسِمِ: إِنَّ رَجُلًا مِنَّا زَنَى بِامْرَأَةٍ، فَاحْكُمْ بَيْنَهُمْ، فَوَضَعُوا لِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وِسَادَةً فَجَلَسَ عَلَيْهَا، ثُمَّ قَالَ: بِالتَّوْرَاةِ، فَأُتِيَ بِهَا، فَنَزَعَ الْوِسَادَةَ مِنْ تَحْتِهِ، فَوَضَعَ التَّوْرَاةَ عَلَيْهَا، ثُمَّ قَالَ: آمَنْتُ بِكِ وَبِمَنْ أَنْزَلَكِ ثُمَّ قَالَ: ائْتُونِي بِأَعْلَمِكُمْ، فَأُتِيَ بِفَتًى شَابٍّ، ثُمَّ ذَكَرَ قِصَّةَ الرَّجْمِ، نَحْوَ حَدِيثِ مَالِكٍ، عَنْ نَافِعٍ
অর্থঃ “ইবনু উমার (রা.) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা একদল ইয়াহুদী এসে রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-কে ‘কুফফ’ নামক উপত্যকায় ততে আবেদন জানালো। তিনি তাদের এক পাঠাগারে উপস্থিত হলেন। তারা বললো, হে আবুল কাসিম! আমাদের এক ব্যক্তি জনৈকা মহিলার সঙ্গে যেনা করেছে। সুতরাং আপনি এদের সম্পর্কে ফায়সালা দিন। তারা রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর জন্য একটি বালিশ পেতে দিলো। তিনি তাতে বসে তাদের বললেনঃ তোমরা একখানি তাওরাত নিয়ে এসো।
তাওরাত নিয়ে আসা হলে তিনি তাঁর নীচে বিছানো বালিশ টেনে নিয়ে তার উপর তাওরাত রাখলেন এবং বললেনঃ আমি তোমার প্রতি এবং তোমায় যিনি নাযিল করেছেন তার প্রতি ঈমান এনেছি। অতঃপর তিনি বললেনঃ তোমাদের মধ্যকার অধিক জ্ঞানী ব্যক্তিকে নিয়ে এসো। অতএব এক যুবককে আনা হলো। অতঃপর তিনি (ইবনু উমার) নাফি থেকে মালিক সূত্রে বর্ণিত হাদীসের অনুরূপ ‘রজম’ সম্পর্কিত ঘটনা বর্ণনা করেন।” [54]
শায়খ আলবানী(র.) এই হাদিসকে হাসান বলেছেন। শায়খ যুবায়র আলি জাঈ(র.)ও একে হাসান বলেছেন। [55] তবে অন্যান্য মুহাদ্দিসদের এ ব্যাপারে ভিন্ন মতও রয়েছে। যেমন, শায়খ শু’আইব আরনাউত(র.) এই হাদিসকে দুর্বল বলেছেন। [56] এই হাদিসের রাবী হিশাম বিন সা’দের দুর্বলতার ব্যাপারে পূর্বযুগের অনেক মুহাদ্দিসের অভিমত পাওয়া যায়। যেমনঃ আবু আহমাদ বিন উদাই জুরজানি(র.), আবু বকর বায়হাকী(র.), আহমাদ বিন হাম্বল(র.), আহমাদ বিন শুআইব নাসাঈ(র.), ইবন আব্দুল বার আন্দালুসী(র.), মুহাম্মাদ বিন সা’দ(র.), মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ বিন বারক্বী, ইয়াহইয়া বিন সাঈদ কাত্তান(র.), ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন(র.), ইয়াকুব বিন সুফিয়ান আল ফাসাওয়ী(র.) প্রমুখ প্রাচীন মুহাদ্দিসদের থেকে এই বর্ণনাকারীর ব্যাপারে বিভিন্ন দুর্বলতা ও আপত্তির উল্লেখ আছে। যদিও কেউ কেউ ভিন্ন মতও দিয়েছেন, ইমাম যাহাবী(র.) এর মতে তিনি হাসান। [57] এই হাদিসটির ব্যাপারে ‘আল ফাসল’ গ্রন্থে ইমাম ইবন হাযম(র.) মন্তব্য করেছেন,
قوله عليه السلام آمنت بما فيك فانه باطل لم يصح قط
অর্থঃ “…তাঁর(ﷺ) বক্তব্য – “আমি তোমার উপর ঈমান এনেছি” এটি বাতিল এবং কখনো সহীহ নয়।…” [58]
তবু আমরা যদি হাদিসটিকে হাসান ধরে নিই, তবু এর দ্বারা ইহুদিদের কিতাব অবিকৃত বলে প্রমাণ হয় না। এই হাদিস প্রসঙ্গে ইমাম ইবন হাজার আসকালানী(র.) ‘ফাতহুল বারী’ গ্রন্থে বলেছেন,
وكذا من استدل به على أن التوراة التي أحضرت حينئذ كانت كلها صحيحة سالمة من التبديل لأنه يطرقه هذا الاحتمال بعينه ولا يرده قوله : " آمنت بك وبمن أنزلك " لأن المراد أصل التوراة .
অর্থঃ “কেউ কেউ একে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করতে চায় যে, সেই সময়ে যে তাওরাত আনা হয়েছিলো, সেটি সে সময়ে পুরোপুরি সহীহ ছিলো এবং এবং পরিবর্তন (বিকৃতি) থেকে নিরাপদ ছিলো। কিন্তু এমনটি হওয়া কোনোক্রমেই সম্ভব নয় এবং তাঁর [নবী(ﷺ)] এ বক্তব্য “আমি তোমার প্রতি এবং তোমায় যিনি নাযিল করেছেন তার প্রতি ঈমান এনেছি” এ ব্যাপারে ব্যবহার করা যাবে না কেননা তিনি এর দ্বারা আসল তাওরাতের কথা বুঝিয়েছিলেন।” [59]
পূর্বে ১.৬ অনুচ্ছেদে উল্লেখিত এই হাদিসটি পুনরায় দেখলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে।
“…তারা তাকে বলল, হে মুহাম্মদ! আপনার কি দাবি নয় যে, আপনি হযরত ইবরাহীম (আ)-এর দীন ও তাঁর ধর্মাদর্শে প্রতিষ্ঠিত এবং আমাদের তাওরাত গ্রন্থে বিশ্বাস রাখেন ও সাক্ষ্য দেন যে, তা আল্লাহর নিকট হতে অবতীর্ণ কিতাব? প্রিয়নবী (ﷺ) বলেন, হ্যাঁ, তবে তোমরা তাওরাতে অনেক কিছু নিজেদের পক্ষ হতে সংযোজন করেছ, আর যে সকল বিষয়ে তোমাদের থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করা হয়েছিল, তোমরা তার অনেক কিছুই অস্বীকার করছ এবং তার যে সকল বিষয় মানুষের কাছে প্রকাশ করার জন্য তোমরা আদিষ্ট ছিলে, তোমরা তা গোপন করে রেখেছ। তোমাদের এসব কর্মকান্ডের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।” [60]
إِنَّا أَنزَلْنَا التَّوْرَاةَ فِيهَا هُدًى وَنُورٌ ۚ يَحْكُمُ بِهَا النَّبِيُّونَ الَّذِينَ أَسْلَمُوا لِلَّذِينَ هَادُوا وَالرَّبَّانِيُّونَ وَالْأَحْبَارُ بِمَا اسْتُحْفِظُوا مِن كِتَابِ اللَّهِ وَكَانُوا عَلَيْهِ شُهَدَاءَ ۚ فَلَا تَخْشَوُا النَّاسَ وَاخْشَوْنِ وَلَا تَشْتَرُوا بِآيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلًا ۚ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
অর্থঃ “নিশ্চয় আমি তাওরাত নাযিল করেছি, তাতে ছিল হিদায়াত ও আলো, এর মাধ্যমে ইয়াহূদীদের জন্য ফয়সালা প্রদান করত অনুগত নবীগণ এবং রববানী ও ধর্মবিদগণ। কারণ তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের রক্ষক করা হয়েছিল এবং তারা ছিল এর উপর সাক্ষী। সুতরাং তোমরা মানুষকে ভয় করো না, আমাকে ভয় কর এবং আমার আয়াতসমূহের বিনিময়ে সামান্য মূল্য ক্রয় করো না। আর যারা আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তার মাধ্যমে ফয়সালা করে না, তারাই কাফির।” [61]
আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসির তাবারীতে বলা হয়েছে,
“…ইমাম আবু জাফর তারাবী (র.) বলেন, আল্লাহ তা'আলা ঘোষণা করেছেন যে, তিনি তার কিতাবে যে বিধান দিয়েছেন এবং বান্দাদের জন্য তাতে যে ফয়সালার ব্যবস্থা রেখেছেন, যারা তা গোপন রেখে অন্য ব্যবস্থা অবলম্বন করে, তারাই কাফির। যেমন ইয়াহুদী সম্প্রদায় বিবাহিত ব্যভিচারকারীর ক্ষেত্রে রজমের বিধান গোপন করে তার পরিবর্তে মুখে চুনকালি লাগানো ও গাধার পিঠে চড়িয়ে ঘোরানোকে স্থির করে নিয়েছে। অনুরূপ তারা কতক নিহতের বদলে পূর্ণ দিয়াত (মুক্তিপণ) এবং কতকের বদলে অর্ধ-দিয়াতের আইন বানিয়ে নিয়েছে। অভিজাত বংশের নিহতের বদলে কিসাস আর নিম্ন বংশের ক্ষেত্রে দিয়াত সাব্যস্ত করা তাদের আরেকটি মনগড়া আইন। অথচ তাওরাত গ্রন্থে আল্লাহ তা'আলা তাদের প্রতি এসব ক্ষেত্রে একই রকম বিধান দিয়েছেন। أُولَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ অথ্যাৎ যারা মহান আল্লাহর দেওয়া বিধান অনুযায়ী ফয়সালা করে না, বরং অন্য কোন আইন অবলম্বন করে এবং তাঁর অবতীর্ণ ন্যায় বিচারকে গোপন করে রাখে, তারাই কাফির। অর্থাৎ তারা সেই লোক, যারা সত্য-সঠিক বিধানকে মানুষের কাছে গোপন করে তদস্থলে অন্য কোন বিধান প্রকাশ করে। অথচ সেই সত্য বিধানকে প্রকাশ ও প্রচার করাই ছিল তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। বস্তুতঃ জনসাধারণ হতে উৎকোচ গ্রহণের লোভেই তারা এই দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়েছে।
এ স্থলে কুফর শব্দের দ্বারা কি বোঝান হয়েছে, তা নিয়ে তাফসীরকারকগণের একাধিক মত রয়েছে। আমি উপরে যে অর্থ উল্লেখ করেছি, তাদের কেউ কেউ তাই বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা এর দ্বারা চিহ্নিত করে দিয়েছেন যারা আল্লাহর কিতাবে বিকৃতি এবং তার আইনে পরিবর্তন সাধন করেছে, তারা ইয়াহুদী সম্প্রদায়।” [62]
এখানেও এমন কিছু প্রমাণ নেই যা থেকে বোঝা যায় ইহুদিদের তাওরাত অবিকৃত। আল্লাহর নাজিলকৃত তাওরাতের কিছু বিধান এখনো ইহুদিদের কিতাবের মাঝে আছে এ ব্যাপারে সবাই একমত। তারা আল্লাহ তা’আলার কিতাব বিকৃত করে, অপব্যাখ্যা করে ও নানা উপায়ে আল্লাহর বিধান থেকে দূরে সরে গিয়ে কুফরীতে লিপ্ত হয়েছে। এখানে সেটিই বলা হয়েছে।
وَلْيَحْكُمْ أَهْلُ الْإِنجِيلِ بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فِيهِ ۚ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ
অর্থঃ “আর ইঞ্জীল অনুসারীগণ যেন আল্লাহ তাতে যা নাযিল করেছেন তদনুসারে হুকুম দেয়। আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না, তারাই ফাসেক।” [63]
খ্রিষ্টান মিশনারীরা এই আয়াত দেখিয়ে দাবি করে যে খ্রিষ্টানদের এখানে বাইবেলের সুসমাচার মেনে চলতে বলা হয়েছে। কিন্তু আয়াতের সরল অনুবাদ থেকেই বোঝা যায় যে তাদের এই দাবি সম্পূর্ণ ভুল। এ কথা মুসলিমরা বিশ্বাস করে যে ঈসা(আ.) এর উপর যে ইঞ্জিল নাজিল করা হয়েছিলো, সেটির উপরে সে সময়কার তাঁর অনুসারীদের চলতে বলা হয়েছিলো। এখানে আয়াতে বলা হচ্ছেঃ “ইঞ্জীল অনুসারীগণ যেন আল্লাহ তাতে যা নাযিল করেছেন তদনুসারে হুকুম দেয়” – মানে এর মাঝে যতটুকু অংশ আল্লাহর নাজিল করা, সেই অংশ মেনে চলতে বলা হয়েছে। মুসলিমরাও তো এটিই বলে, বিকৃত অংশ বাদে অন্য অংশ থেকে সদুপদেশ নিলে তারা সত্যের কাছাকাছি আসতে পারবে, ইসলামের কাছাকাছি আসতে পারবে।
আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসির তাবারীতে বলা হয়েছে,
“…ليَحْكُمْ এর ل -এ যের দিয়ে পড়লে ব্যাখ্যা হবে এরূপ, আমি তার পূর্বে অবতীর্ণ তাওরাতের সমর্থকরূপে এবং মুত্তাকীগণের জন্য পথের নির্দেশ ও উপদেশরূপে ‘ঈসা ইবন মারইয়ামকে ইনজীল দিয়েছিলাম; তাতে ছিল পথের নির্দেশ ও আলো। এটা প্রদান করার উদ্দেশ্য ছিল যাতে তারা এতে প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী ফয়সালা দেয়। কিন্তু তারা তার বিধান পরিবর্তন করে ও তার বিরুদ্ধাচরণ করে। ফলে মহান আল্লাহর প্রদত্ত পথ হতে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ অর্থাৎ তারা মহান আল্লাহর দেওয়া বিধান সংঘনকারী ও তাঁর আদেশ-নিষেধের বিরুদ্ধাচরণকারী।
আর ل হরফে জযম দিয়ে পড়লে তখন ব্যাখ্যা হবে, আমি ঈসা ইবন মারইয়ামকে ইনজীল দিয়েছিলাম। তার পূর্বে তাওরাতের সমর্থক, মুত্তাকীগণের জন্য পথ নির্দেশ ও উপদেশরূপে। তাতে ছিল পথের নির্দেশ ও আলো। আর আমি এর অনুসারীদের নির্দেশ দিয়েছিলাম তারা যেন এতে প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী ফয়সালা করে। কিন্তু তারা আমার আদেশ পালন করল না, বরং তার বিরুদ্ধাচরণ করল। যারা আমার দেওয়া আদেশ অমান্য করল, তারাই তো সীমালংঘনকারী।” [64]
খ্রিষ্টান মিশনারীরা এই আয়াতগুলো উদ্ধৃত করে, অথচ এর শেষে কী বলা হয়েছে তাদের চোখ এড়িয়ে যায়। বা ইচ্ছা করে গোপন করে। এই আয়াতগুলোর পরে অর্থাৎ সুরা মায়িদাহর ৪৮-৪৯ নং আয়াতে আল কুরআন অনুযায়ী বিচার করতে বলা হয়েছে। যা একদম স্পষ্ট করে দেয় কুরআন থেকেই বিচার করতে হবে।
(48) وَأَنزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ الْكِتَابِ وَمُهَيْمِنًا عَلَيْهِ ۖ فَاحْكُم بَيْنَهُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ ۖ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ عَمَّا جَاءَكَ مِنَ الْحَقِّ ۚ لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا ۚ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَجَعَلَكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَلَٰكِن لِّيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آتَاكُمْ ۖ فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ ۚ إِلَى اللَّهِ مَرْجِعُكُمْ جَمِيعًا فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ
(49) وَأَنِ احْكُم بَيْنَهُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَاحْذَرْهُمْ أَن يَفْتِنُوكَ عَن بَعْضِ مَا أَنزَلَ اللَّهُ إِلَيْكَ ۖ فَإِن تَوَلَّوْا فَاعْلَمْ أَنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ أَن يُصِيبَهُم بِبَعْضِ ذُنُوبِهِمْ ۗ وَإِنَّ كَثِيرًا مِّنَ النَّاسِ لَفَاسِقُونَ
অর্থঃ “আর আমি তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি যথাযথভাবে, এর পূর্বের কিতাবের সত্যায়নকারী ও এর উপর তদারককারীরূপে। সুতরাং আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তুমি তার মাধ্যমে ফয়সালা কর এবং তোমার নিকট যে সত্য এসেছে, তা ত্যাগ করে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। তোমাদের প্রত্যেকের জন্য আমি নির্ধারণ করেছি শরীআত ও স্পষ্ট পন্থা এবং আল্লাহ যদি চাইতেন, তবে তোমাদেরকে এক উম্মত বানাতেন। কিন্তু তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে চান। সুতরাং তোমরা ভাল কাজে প্রতিযোগিতা কর। আল্লাহরই দিকে তোমাদের সবার প্রত্যাবর্তনস্থল। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে অবহিত করবেন, যা নিয়ে তোমরা মতবিরোধ করতে। আর তাদের মধ্যে তার মাধ্যমে ফয়সালা কর, যা আল্লাহ নাযিল করেছেন এবং তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর তাদের থেকে সতর্ক থাক যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তার কিছু থেকে তারা তোমাকে বিচ্যুত করবে। অতঃপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে জেনে রাখ যে, আল্লাহ তো কেবল তাদেরকে তাদের কিছু পাপের কারণেই আযাব দিতে চান। আর মানুষের অনেকেই ফাসিক।” [65]
আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসির ইবন কাসিরে বলা হয়েছে,
“এতক্ষণ আল্লাহ তা'আলা সেই তাওরাত সম্পর্কে আলোচনা করিয়াছেন যাহা মূসা কালীমুল্লাহর প্রতি অবতীর্ণ হইয়াছিল। উহাতে তিনি ইয়াহুদীগণকে উহার যথাযথ অনুসরণ করার আদেশ করিয়াছিলেন। তখন ইঞ্জীলের প্রসঙ্গ শুরু করিয়া বলা হইয়াছে যে, উহার অনুসারীদিগকে উহার নির্দেশসমূহের যথাযথ অনুসরণ করার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছিল। অবশেষে আল্লাহ্ তা'আলা পবিত্র কুরআন সম্বন্ধে আলোচনায় প্রবৃত্ত হন যাহা তিনি স্বীয় বান্দা ও রাসূলের উপর নাযিল করিয়াছেন। তাই বলেন وَأَنزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ “তোমার প্রতি সত্যসহ কিতাব নাযিল করিয়াছি।' অর্থাৎ উহা যে আল্লাহর পক্ষ হইতে অবতীর্ণ হইয়াছে সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। مُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ الْكِتَابِ -“উহা পূর্বে অবতীর্ণ সকল কিতাবের সমর্থক ও সংরক্ষক।'’ অর্থাৎ ইহার পূর্বেকার কিতাবসমূহে ইহার আলোচনা ও প্রশংসা করা হইয়াছিল যে, উহা অতি সত্ত্বর আল্লাহর পক্ষ হইতে তাহার বান্দা ও রাসূল মুহাম্মদ(ﷺ)-এর উপর অবতীর্ণ হইবে। বস্তুত আল্লাহ তা'আলার পূর্বাভাস অনুসারেই কুরআন অবতীর্ণ হয়। ফলে প্রত্যেক বিশ্বাসী, যাহারা আল্লাহর বিধান অনুসরণ করে এবং তাঁহার রাসূলগণের উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখে ও দূরদৃষ্টির অধিকারী, কুরআনের প্রতি স্বভাবতই তাহাদের বিশ্বাস বাড়িয়া যায়।
…
আলোচ্য আয়াতাংশের ভাবার্থে ইবন আবূ হাতিম (র.)...... ইব্ন আব্বাস (রা.) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন যে, ইব্ন আব্বাস (রা.) বলেনঃ নবী(ﷺ)--কে এই আয়াতের মাধ্যমে জানাইয়া দেওয়া হইয়াছিল যে, আপনি ইচ্ছা করিলে তাহাদের ব্যাপারে বিচার করিতে পারেন এবং ইচ্ছা করিলে নাও করিতে পারেন। কিন্তু এই নির্দেশ পরিবর্তন করিয়া পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তা'আলা নাযিল করেনঃ
وَأَنِ احْكُم بَيْنَهُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ
“কিতাব অবতীর্ণ করিয়াছি যাহাতে তুমি আল্লাহ যাহা অবতীর্ণ করিয়াছেন তদনুযায়ী। তাহাদের বিচার নিষ্পত্তি কর।'’ অর্থাৎ ইহা দ্বারা রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-কে একমাত্র কুরআন অনুযায়ী বিচার নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে।
وَ لَا تَتَّبِعۡ اَهۡوَآءَهُمۡ 'তাহাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করিও না।' অর্থাৎ তাহাদের বিধানে তাহারা নিজেদের পক্ষ হইতে যাহা সংযোজন করিয়াছে সেই অনুসারে বিচার করিয়া এবং তাহাদের খেয়াল-খুশির বশবর্তী হইয়া আল্লাহর বিধানের বরখেলাফ করিও না।
অর্থাৎ ‘অজ্ঞরা নিজেদের খেয়াল-খুশি অনুযায়ী যে বিধান তৈরি করিয়াছে, কোন কারণেই তুমি তাহা অনুসরণ করিতে গিয়া আল্লাহর নির্দেশিত বিধান হইতে বিচ্যুত হইও না।'” [66]
নবী(ﷺ) কেন সে সময়ে তাওরাত দ্বারা বিচার করেছিলেন এ ব্যাপারে ইমাম ইবন হাজার আসকালানী(র.) ‘ফাতহুল বারী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, সে সময়ে নবী(ﷺ) প্রথম মদীনায় প্রবেশ করেছেন। তিনি তখন আদিষ্ট হয়েছিলেন তাওরাত দ্বারা ইহুদিদেরকে বিচার করতে। কিন্তু পরে [... وَاللَّاتِي يَأْتِينَ الْفَاحِشَةَ مِن نِّسَائِكُمْ] অর্থাৎ সুরা নিসার ১৫ নং আয়াত দ্বারা বিষয়টি মানসুখ হয়ে যায়। [67]
এখানে এটি স্পষ্ট যে আগের বিধান রহিত করে নবী(ﷺ)কে একমাত্র কুরআন দ্বারা বিচার করার আদেশ দেয়া হয়েছে। যারা আগের আয়াতগুলো দেখিয়ে দাবি করেন যে সেসব স্থানে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের তাওরাত-ইঞ্জিল প্রতিষ্ঠার আদেশ দেয়া হয়েছে, আশা করি এই তথ্যগুলো জানার পরে তাদের সুমতি হবে।
قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَسْتُمْ عَلَىٰ شَيْءٍ حَتَّىٰ تُقِيمُوا التَّوْرَاةَ وَالْإِنجِيلَ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُمْ ۗ وَلَيَزِيدَنَّ كَثِيرًا مِّنْهُم مَّا أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ طُغْيَانًا وَكُفْرًا ۖ فَلَا تَأْسَ عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ
অর্থঃ “বল, হে গ্রন্থধারীগণ! তোমরা তাওরাত, ইঞ্জিল আর তোমাদের রবের নিকট হতে যা তোমাদের প্রতি নাযিল হয়েছে তার বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠিত না করা পর্যন্ত তোমরা কোন ভিত্তির উপরই দণ্ডায়মান নও। তোমার রবের নিকট হতে যা তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তা তাদের অনেকের সীমালঙ্ঘন আর কুফরী অবশ্য অবশ্যই বৃদ্ধি করবে। কাজেই কাফির সম্প্রদায়ের জন্য তুমি আফসোস করো না।” [68]
খ্রিষ্টান মিশনারীরা এই আয়াতটি দেখিয়েও দাবি করেন এখানে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের তাওরাত-ইঞ্জিল প্রতিষ্ঠার আদেশ দেয়া হয়েছে। অথচ এখানে তাওরাত ও ইঞ্জিলের পরে কুরআনের কথাও যে বলা হয়েছে (“তোমাদের রবের নিকট হতে যা তোমাদের প্রতি নাযিল হয়েছে”) এটা তারা বেমালুম এড়িয়ে যান!
আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসির তাবারীতে বলা হয়েছে,
“ইমাম আবু জাফর তাবারী (র.) বলেন, প্রিয় নবী(ﷺ)-এর হিজরত স্থল মদীনায় ছিল আহলে কিতাবের দুটি সম্প্রদায়-ইয়াহুদীও নাসারা। আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে এ আয়াতে তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, তিনি যেন এ দুই সম্প্রদায়ের কাছে দীনের দাওয়াত পেশ করেন। আল্লাহ পাক ঘোষণা দিয়েছেন যে, হে মুহাম্মদ! আপনি ইয়াহুদী ও নাসারাদের বলে দিন যে, হে তাওরাত ও ইনজীলে বিশ্বাসী সম্প্রদায়। তোমরা এ ধর্মাদর্শের দাবী কর, প্রকৃতপক্ষে তোমরা তাতে নেই। ইয়াহুদী জাতি প্রতিষ্ঠিত নেই মূসা (আ.) এর ধর্মে এবং নাসারারাও নেই ঈসা (আ.)-এর ধর্মে। তোমরা প্রতিষ্ঠিত থাকতে পার না সে দীনে, যতক্ষণ না তোমরা কায়েম কর তাওরাত ও ইনজীল এবং সেই কিতাব, যা তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং মুহাম্মদ(ﷺ) নিয়ে এসেছেন অর্থাৎ ফুরকান। এ ভাবে তোমাদেরকে এসব কিতাব মানতে হবে এবং এ গুলোর নির্দেশ অনুযায়ী মুহাম্মদ(ﷺ)-এর প্রতি ঈমান আনতে হবে আর স্বীকার করতে হবে যে, এর প্রত্যেকটিই আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে অবতীর্ণ। কাজেই তোমরা কোন কিছুই অস্বীকার করো না এবং আল্লাহ পাকের রাসূলদের মধ্যে পার্থক্য করে একজনকে বিশ্বাস এবং অন্যজনকে অবিশ্বাস কর না। কেননা তাদের কোন একজনকে অবিশ্বাস অর্থ অন্য সকলকেই অবিশ্বাস করা। আল্লাহ পাকের কিতাবসমূহ পরস্পরের সমর্থক। এমতাবস্থায় কেউ এর একটিকে অস্বীকার করলে সে যেন সবগুলোকেই অস্বীকার করল।
সাবাবায়ে কিরাম ও তারি’ঈদের থেকেও অনুরূপ বর্ণিত আছে। যেমনঃ
১২২৮৪. হযরত ইবন 'আব্বাস (রা.) বলেন, রাফি' ইবন হারিসা, সালাম ইবন মিশকাম, মালিক ইবন সায়ফ ও রাফি' ইবন হারীমালা হযরত রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর সাথে সাক্ষাত করে। তারা তাকে বলল, হে মুহাম্মদ(ﷺ)! আপনার কি দাবি নয় যে, আপনি হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর দীন ও তাঁর ধর্মাদর্শে প্রতিষ্ঠিত এবং আমাদের তাওরাত গ্রন্থে বিশ্বাস রাখেন ও সাক্ষ্য দেন যে, তা আল্লাহর নিকট হতে অবতীর্ণ কিতাব? প্রিয়নবী(ﷺ) বলেন, হাঁ, তবে তোমরা তাওরাতে অনেক কিছু নিজেদের পক্ষ হতে সংযোজন করেছ, আর যে সকল বিষয়ে তোমাদের থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করা হয়েছিল, তোমরা তার অনেক কিছুই অস্বীকার করছ এবং তার যে সকল বিষয় মানুষের কাছে প্রকাশ করার জন্য তোমরা আদিষ্ট ছিলে, তোমরা তা গোপন করে রেখেছ। তোমাদের এসব কর্মকাণ্ডের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। তারা বলল, আমাদের হাতে যা আছে আমরা তাই ধরে রাখব। কারণ আমরা সত্য ও হিদায়াতের উপর আছি। আমরা আপনার প্রতি ঈমান আনব না এবং আপনারা অনুসরণও করব না। তখন আল্লাহ তা'আলা قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَسْتُمْ عَلَىٰ شَيْءٍ حَتَّىٰ تُقِيمُوا التَّوْرَاةَ وَالْإِنجِيلَ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُمْ ۗ হতে فَلَا تَأْسَ عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ পর্যন্ত এ আয়াতটি নাযিল করেন।” [69]
তাফসিরে আয়াতের শানে নুজুল থেকে এই আয়াতের মর্মার্থ একদম পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। এখানে বরং ইহুদি-খ্রিষ্টানরা যে সত্য ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত নেই এই জন্য তাদেরকে সত্য ধর্মের উপর কায়েম হতে বলা হয়েছে। প্রকৃতভাবে তাওরাত-ইঞ্জিল কায়েম করলে তারা ইসলামে চলে আসবে এবং তারা এরপর কুরআন কায়েম করবে। এভাবে তাওরাত, ইঞ্জিল, কুরআন সব কিছুই প্রতিষ্ঠা করা হবে। এটা ব্যতিত তারা কোনো কিছুর উপরেই প্রতিষ্ঠিত নয়। এখানে শানে নুজুলে এটাও উল্লেখ আছে যে নবী(ﷺ) তাওরাতের উপর ঈমান রাখতেন, কিন্তু ইহুদিদের কাছে যে তাওরাত আছে, তাতে তারা সংযোজন-বিয়োজন করেছে।
খ্রিষ্টান মিশনারীরা এই আয়াত দেখিয়ে মুসলিমদের কাছে দলিল দিতে চান, আমরা তাদের কাছে তাওরাত-ইঞ্জিলের একটা বিধান প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব দিচ্ছি। আল কুরআনে উল্লেখ আছে তাওরাত-ইঞ্জিলে উম্মি নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) এর কথা আছে। [70] আপনারা নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) এর উপর ঈমান এনে তাঁর অনুসারী হয়ে এই একটা বিধান প্রতিষ্ঠা করুন অন্তত। অন্য বিধানগুলো নাহয় পরে দেখা যাবে।
২.৪। কুরআনে কি ইহুদি-খ্রিষ্টানদের হাতে থাকা কিতাবকে অবিকৃত বলে? :
আল কুরআন পূর্বের নাজিলকৃত কিতাবগুলোকে সত্যায়ন করে। খ্রিষ্টান মিশনারীরা এ থেকে দাবি করেন যে কুরআন অনুযায়ী ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ‘হাতে থাকা’ গ্রন্থগুলো অবিকৃত। এ জন্য তারা যে সব দলিল উল্লেখ করে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ
نَزَّلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ وَأَنزَلَ التَّوْرَاةَ وَالْإِنجِيلَ
অর্থঃ "তিনি তোমার উপর কিতাব নাযিল করেছেন যথাযথভাবে, এর পূর্বে যা এসেছে তার সত্যায়নকারী হিসেবে এবং নাযিল করেছেন তাওরাত ও ইনজীল।" [71]
খ্রিষ্টান মিশনারীরা এমন আরো কিছু আয়াত উল্লেখ করেন যেখানে বলা হয়েছে কুরআন পূর্বের কিতাবের সত্যায়নকারী বা আহলে কিতাবদের নিকট যে কিতাব আছে এর সত্যায়নকারী। এখানে ‘সত্যায়নকারী’ দ্বারা মূলত কী বোঝানো হয়েছে এ ব্যাপারে ইতিমধ্যেই এই প্রবন্ধের “১.৫। কুরআন পূর্বের কিতাবসমূহের সত্যায়নকারী” অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আমরা এখন আরো কিছু দলিল প্রমাণ দেখবো যা থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হবে যে আল কুরআন আর যাই হোক – ইহুদি-খ্রিষ্টানদের হাতে থাকা বর্তমান বাইবেলকে অবিকৃত বলে না।
খ্রিষ্টান মিশনারীদের দাবিমতে, কুরআন-হাদিসে নবী(ﷺ) এর সময়ের অর্থাৎ ৭ম শতাব্দীর ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থকে সত্যায়ন করা হয়েছে। আর তখনকার বাইবেল আর এখনকার বাইবেল একই। কিন্তু তাদের এই দাবি সম্পূর্ণ ভুল তা বিভিন্ন আয়াত, হাদিস ও সাহাবীদের বর্ণনা থেকে প্রমাণ হয়। সে সময়কার আহলে কিতাবদের ধর্মগ্রন্থে কী কী তথ্য ছিলো, এ প্রসঙ্গে বেশ কিছু বর্ণনা আমাদের হাতে রয়েছে। সেই বর্ণনাগুলো উল্লেখ করলেই বোঝা যাবে যে তখনকার ‘বাইবেল’ আর এখনকার বাইবেল মোটেও এক না। তর্কের খাতিরে যদি আমরা ধরেও নিই যে কুরআন-হাদিসে আহলে কিতাবদের ধর্মগ্রন্থকে অবিকৃত বলা হয়েছে, তবু এর দ্বারা খ্রিষ্টান মিশনারীদের বাইবেল গ্রন্থের পক্ষে কোনো যুক্তি প্রতিষ্ঠিত হয় না। কেননা ঐসময়কার ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থের সাথে এখনকার ইহুদি-খ্রিষ্টানদের বাইবেলে বহু জায়গায় পার্থক্য আছে।
২.৪.১। তাওরাত ও ইঞ্জিলে নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) এর নাম ও গুণাবলির স্পষ্ট উল্লেখঃ
(157) الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الْأُمِّيَّ الَّذِي يَجِدُونَهُ مَكْتُوبًا عِندَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنجِيلِ يَأْمُرُهُم بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ وَيَضَعُ عَنْهُمْ إِصْرَهُمْ وَالْأَغْلَالَ الَّتِي كَانَتْ عَلَيْهِمْ ۚ فَالَّذِينَ آمَنُوا بِهِ وَعَزَّرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَاتَّبَعُوا النُّورَ الَّذِي أُنزِلَ مَعَهُ ۙ أُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
(158) قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا الَّذِي لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۖ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ يُحْيِي وَيُمِيتُ ۖ فَآمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ النَّبِيِّ الْأُمِّيِّ الَّذِي يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَكَلِمَاتِهِ وَاتَّبِعُوهُ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ
অর্থঃ “যারা অনুসরণ করে রাসূলের, যে উম্মী নবী; যার গুণাবলী তারা নিজেদের কাছে তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পায়, যে তাদেরকে সৎ কাজের আদেশ দেয় ও বারণ করে অসৎ কাজ থেকে এবং তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করে আর অপবিত্র বস্তু হারাম করে। আর তাদের থেকে বোঝা ও শৃংখল- যা তাদের উপরে ছিল- অপসারণ করে। সুতরাং যারা তার প্রতি ঈমান আনে, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং তার সাথে যে নূর নাযিল করা হয়েছে তা অনুসরণ করে তারাই সফলকাম।
বল, ‘হে মানুষ, আমি তোমাদের সবার প্রতি আল্লাহর রাসূল, যার রয়েছে আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব। তিনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই। তিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু দেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আন ও তাঁর প্রেরিত উম্মী নবীর প্রতি, যে আল্লাহ ও তাঁর বাণীসমূহের প্রতি ঈমান রাখে। আর তোমরা তার অনুসরণ কর, আশা করা যায়, তোমরা হিদায়াত লাভ করবে।” [72]
আল কুরআনে বলা হয়েছে আহলে কিতাবরা নিজেদের কাছে রক্ষিত তাওরাত ও ইঞ্জিলে উম্মি নবী অর্থাৎ মুহাম্মাদ(ﷺ) এর গুণাবলি লিখিত পায়। খ্রিষ্টান মিশনারীরা দাবি করেন যে তাদের বাইবেলে কোথাও মুহাম্মাদ(ﷺ) এর কথা লেখা নেই। সেক্ষেত্রে তাদের নিজ দাবি অনুয়ায়ী কুরআনে উল্লেখিত আহলে কিতাবদের তাওরাত ও ইঞ্জিল এবং আজকের খ্রিষ্টানদের বাইবেল এক নয়! আর তারা যদি এরপরেও মুসলিমদেরকে বলতে চায় যে ঐসময়কার বাইবেলে আর এখনকার বাইবেল এক, তাহলে তাদেরকে এটা মেনে নিতে হবে যে এখনকার বাইবেলেও মুহাম্মাদ(ﷺ) এর গুণাবলি লিখিত আছে।
সেই যুগের ‘বাইবেলে’ মুহাম্মাদ(ﷺ) এর ব্যাপারে কী লিখিত ছিলো এ ব্যাপারে বেশ কিছু বর্ণনা রয়েছে। যেমনঃ
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا أَنَّ هَذِهِ الْآيَةَ الَّتِيْ فِي الْقُرْآنِ {يٰٓأَيُّهَا النَّبِيُّإِنَّآ أَرْسَلْنٰكَ شَاهِدًا وَّمُبَشِّرًا وَّنَذِيْرًا لا} قَالَ فِي التَّوْرَاةِ يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَحِرْزًا لِلْأُمِّيِّيْنَ أَنْتَ عَبْدِيْ وَرَسُوْلِيْ سَمَّيْتُكَ الْمُتَوَكِّلَ لَيْسَ بِفَظٍّ وَلَا غَلِيْظٍ وَلَا سَخَّابٍ بِالأَسْوَاقِ وَلَا يَدْفَعُ السَّيِّئَةَ بِالسَّيِّئَةِ وَلَكِنْ يَعْفُوْ وَيَصْفَحُ وَلَنْ يَقْبِضَهُ اللهُ حَتَّى يُقِيْمَ بِهِ الْمِلَّةَ الْعَوْجَاءَ بِأَنْ يَقُوْلُوْا لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ فَيَفْتَحَ بِهَا أَعْيُنًا عُمْيًا وَآذَانًا صُمًّا وَقُلُوْبًا غُلْفًا
অর্থঃ “‘আম্র ইব্নু আস (রা.) থেকে বর্ণিতঃ কুরআনের এ আয়াত, “আমি তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষীরূপে, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে” তাওরাতে আল্লাহ্ এভাবে বলেছেন, হে নাবী, আমি তোমাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষীরূপে, সুসংবাদদাতা ও উম্মী লোকদের মুক্তি দাতারূপে। তুমি আমার বান্দা ও রসূল। আমি তোমার নাম রেখেছি নির্ভরকারী যে রূঢ় ও কঠোরচিত্ত নয়, বাজারে শোরগোলকারী নয় এবং মন্দ মন্দ দ্বারা প্রতিহতকারীও নয়; বরং তিনি ক্ষমা করবেন এবং উপেক্ষা করবেন। বক্র জাতিকে সোজা না করা পর্যন্ত আল্লাহ্ তাঁর জান কবয করবেন না। তা এভাবে যে, তারা বলবে, আল্লাহ্ ব্যতীত ইলাহ নেই। ফলে খুলে যাবে অন্ধ চোখ, বধির কান এবং পর্দায় ঢাকা অন্তরসমূহ।” [73]
عَنْ عَطَاءِ بْنِ يَسَارٍ، قَالَ لَقِيتُ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ ـ رضى الله عنهما ـ قُلْتُ أَخْبِرْنِي عَنْ صِفَةِ، رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فِي التَّوْرَاةِ. قَالَ أَجَلْ، وَاللَّهِ إِنَّهُ لَمَوْصُوفٌ فِي التَّوْرَاةِ بِبَعْضِ صِفَتِهِ فِي الْقُرْآنِ يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا، وَحِرْزًا لِلأُمِّيِّينَ، أَنْتَ عَبْدِي وَرَسُولِي سَمَّيْتُكَ الْمُتَوَكِّلَ، لَيْسَ بِفَظٍّ وَلاَ غَلِيظٍ وَلاَ سَخَّابٍ فِي الأَسْوَاقِ، وَلاَ يَدْفَعُ بِالسَّيِّئَةِ السَّيِّئَةَ وَلَكِنْ يَعْفُو وَيَغْفِرُ، وَلَنْ يَقْبِضَهُ اللَّهُ حَتَّى يُقِيمَ بِهِ الْمِلَّةَ الْعَوْجَاءَ بِأَنْ يَقُولُوا لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ. وَيَفْتَحُ بِهَا أَعْيُنًا عُمْيًا، وَآذَانًا صُمًّا، وَقُلُوبًا غُلْفًا. تَابَعَهُ عَبْدُ الْعَزِيزِ بْنُ أَبِي سَلَمَةَ عَنْ هِلاَلٍ. وَقَالَ سَعِيدٌ عَنْ هِلاَلٍ عَنْ عَطَاءٍ عَنِ ابْنِ سَلاَمٍ. غُلْفٌ كُلُّ شَىْءٍ فِي غِلاَفٍ، سَيْفٌ أَغْلَفُ، وَقَوْسٌ غَلْفَاءُ، وَرَجُلٌ أَغْلَفُ إِذَا لَمْ يَكُنْ مَخْتُونًا.
অর্থঃ “‘‘আতা ইবনু ইয়াসার (র.) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি ‘আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনু আস (রা.)-কে বললাম, আপনি আমাদের কাছে তাওরাতে বর্ণিত আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর গুণাবলী বর্ণনা করুন। তিনি বললেন, আচ্ছা। আল্লাহর কসম! কুরআনে বর্ণিত তাঁর কিছু গুণাবলী তাওরাতেও উল্লেখ করা হয়েছেঃ “হে নবী! আমি আপনাকে সাক্ষীরূপে, সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারীরূপে প্রেরণ করেছি” এবং উম্মীদের রক্ষক হিসাবেও। আপনি আমার বান্দা ও আমার রসূল। আমি আপনার নাম মুতাওয়াক্কিল (আল্লাহর উপর ভরসাকারী) রেখেছি। তিনি বাজারে কঠোর রূঢ় ও নির্দয় স্বভাবের ছিলেন না। তিনি মন্দর প্রতিশোধ মন্দ দ্বারা নিতেন না বরং মাফ করে দিতেন, ক্ষমা করে দিতেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁকে ততক্ষণ মৃত্যু দিবেন না যতক্ষণ না তাঁর দ্বারা বিকৃত মিল্লাতকে ঠিক পথে আনেন অর্থাৎ যতক্ষণ না তারা (আরববাসীরা) ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর ঘোষণা দিবে। আর এ কালিমার মাধ্যমে অন্ধ-চক্ষু, বধির-কর্ণ ও আচ্ছাদিত হৃদয় খুলে যাবে।” [74]
عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا، أَنَّهُ سَأَلَ كَعْبَ الْأَحْبَارِ: كَيْفَ تَجِدُ نَعْتَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي التَّوْرَاةِ؟، فَقَالَ كَعْبٌ: " نَجِدْهُ مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ يُولَدُ بِمَكَّةَ، وَيُهَاجِرُ إِلَى طَابَةَ، وَيَكُونُ مُلْكُهُ بِالشَّامِ، وَلَيْسَ بِفَحَّاشٍ، وَلَا صَخَّابٍ فِي الْأَسْوَاقِ، وَلَا يُكَافِئُ بِالسَّيِّئَةِ السَّيِّئَةَ، وَلَكِنْ يَعْفُو وَيَغْفِرُ، أُمَّتُهُ الْحَمَّادُونَ، يَحْمَدُونَ اللَّهَ فِي كُلِّ سَرَّاءَ، وَضَرَّاءَ وَيُكَبِّرُونَ اللَّهَ عَلَى كُلِّ نَجْدٍ، يُوَضِّئُونَ أَطْرَافَهُمْ، وَيَأْتَزِرُونَ فِي أَوْسَاطِهِمْ، يُصَفُّونَ فِي صَلاتِهِمْ كَمَا يُصَفُّونَ فِي قِتَالِهِمْ، دَوِيُّهُمْ فِي مَسَاجِدِهِمْ كَدَوِيِّ النَّحْلِ، يُسْمَعُ مُنَادِيهِمْ فِي جَوِّ السَّمَاءِ
অর্থঃ “ইবনু আব্বাস(রা.) হতে বর্ণিত, তিনি কা’ব আল আহবারকে জিজ্ঞেস করেছিলেন: তুমি তাওরাতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর গুণাবলী কেমন পেয়েছ? কা’ব(র.), আমরা তাওরাতে পেয়েছি যে, মুহাম্মদ ইবনু আব্দুল্লাহ (ﷺ) মক্কায় জন্ম গ্রহণ করবেন, ত্ববাহ বা মদীনায় হিজরত করবেন, আর তাঁর রাজ্য শাম পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। আর অশ্লীলতার সাথে তাঁর কোন সম্পর্ক থাকবে না, তিনি হাটে-বাজারে শোরগোলকারীও হবেন না, তিনি মন্দ আচরণের প্রতিদানে মন্দ আচরণ করবেন না, বরং তিনি ক্ষমা ও মার্জনা করবেন। আর তাঁর উম্মত মহান আল্লাহ’র অধিক হামদ্ (প্রশংসা) বর্ণনাকারী, তারা সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় আল্লাহ’র প্রশংসা করবে, তারা অঙ্গসমূহ (ধুয়ে) ওযু করবে এবং প্রত্যেক উঁচু ভূমিতে (আরোহণকালে) তাকবীর (আল্লাহর বড়ত্ব/আল্লাহু আকবার ধ্বনি) উচ্চারণ করবে। তারা ‘ইযার’ বা তহবন্দ (এর নিম্নাংশ) পরিধান করবে তাদের (পায়ের গোছার) মাঝ বরাবর। তারা যেভাবে যুদ্ধে সারিবদ্ধ হবে, তারা তাদের সালাতেও তদ্রূপ সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে। তাদের মসজিদসমূহে তাদের (তিলাওয়াত ও যিকিরের) আওয়াজ হবে মৌমাছির গুণগুণ আওয়াজের মত। আর তাদের আহ্বানকারীর আহ্বান (মুয়াযযিনের আযান) দূর আকাশে শোনা যাবে।” [75]
শুধু তাওরাতেই না, ইঞ্জিলেও নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) এর অনুরূপ গুণাবলি বর্ণিত ছিলো।
" مكتوب في الإنجيل : لا فظ و لا غليظ و لا سخاب بالأسواق و لا يجزي بالسيئة مثلها ، بل يعفو و يصفح "
অর্থঃ “ইঞ্জিলে লিখিত আছে, তিনি কঠোর, রূঢ় ও নির্দয় স্বভাবে না এবং তিনি বাজারে চেঁচামেচিকারীও নন। তিনি মন্দর প্রতিশোধ একই আচরণ (মন্দ) দ্বারা নিতেন না বরং ক্ষমা করে দিতেন, মার্জনা করতেন।” [76]
৭ম শতাব্দীর আরবের তাওরাত ও ইঞ্জিলে মুহাম্মাদ(ﷺ) এর এমনই স্পষ্ট উল্লেখ ছিলো যে কিতাবধারীদের নিকট তাঁকে চেনা সেইরূপ সহজ ছিলো যেভাবে তারা নিজেদের সন্তানকে চিনতো। আল কুরআনে এইরূপ ‘তাওরাত-ইঞ্জিল’কে সত্যায়ন করা হয়েছে। এখনকার ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ‘তাওরাত-ইঞ্জিল’ কি আদৌ এমন?
الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْرِفُونَهُ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَاءَهُمْ ۖ وَإِنَّ فَرِيقًا مِّنْهُمْ لَيَكْتُمُونَ الْحَقَّ وَهُمْ يَعْلَمُونَ
অর্থঃ “যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি, তারা তাকে চিনে, যেমন চিনে তাদের সন্তানদেরকে। আর নিশ্চয় তাদের মধ্য থেকে একটি দল সত্যকে অবশ্যই গোপন করে, অথচ তারা জানে।” [77]
اَلَّذِیۡنَ اٰتَیۡنٰهُمُ الۡکِتٰبَ یَعۡرِفُوۡنَهٗ کَمَا یَعۡرِفُوۡنَ اَبۡنَآءَهُمۡ ۘ اَلَّذِیۡنَ خَسِرُوۡۤا اَنۡفُسَهُمۡ فَهُمۡ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ
অর্থঃ “যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি তারা তাকে চিনে যেরূপ চিনে তাদের ছেলে-সন্তানদেরকে। যারা নিজেদের ক্ষতি করেছে তারা ঈমান আনবে না।” [78]
আমরা দেখলাম নবী(ﷺ) এর সময়কার তাওরাত ও ইঞ্জিলে তাঁর কিছু গুণাবলি স্পষ্টভাবে লিখিত ছিলো। সেগুলো মোটেও ধোঁয়াশাপূর্ণ কোনো উল্লেখ না বরং সহজেই তাঁকে চিনতে পারা যায় এমন বর্ণনা। এই স্পষ্ট গুণাবলিগুলো এখনকার বাইবেলে আছে কি? কেউ কেউ দাবি করতে পারেন এই গুণাবলিগুলো বর্তমান বাইবেলের যিশাইয় (Isaiah) এর ৪২ নং অধ্যায়ে বর্ণিত আছে। এটা ঠিক যে যিশাইয় (Isaiah) ৪২ নং অধ্যায়ের বিবরণের সঙ্গে এই গুণাবলিগুলোর আসলেই মিল আছে। [79] কিন্তু সেখানেও এর সবগুলো গুণাবলি উল্লেখ নেই। (উপরের হাদিসগুলোতে যেসব স্থানের সাথে যিশাইয় ৪২ এর মিল নেই, সে অংশগুলো বোল্ড করে দেয়া হয়েছে) যেমনঃ “মুহাম্মদ ইবনু আব্দুল্লাহ (ﷺ) মক্কায় জন্ম গ্রহণ করবেন, ত্ববাহ বা মদীনায় হিজরত করবেন, আর তাঁর রাজ্য শাম পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। আর অশ্লীলতার সাথে তাঁর কোন সম্পর্ক থাকবে না, … তিনি মন্দ আচরণের প্রতিদানে মন্দ আচরণ করবেন না, বরং তিনি ক্ষমা ও মার্জনা করবেন। আর তাঁর উম্মত মহান আল্লাহ’র অধিক হামদ্ (প্রশংসা) বর্ণনাকারী, তারা সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় আল্লাহ’র প্রশংসা করবে, তারা অঙ্গসমূহ (ধুয়ে) ওযু করবে এবং প্রত্যেক উঁচু ভূমিতে (আরোহণকালে) তাকবীর (আল্লাহর বড়ত্ব/আল্লাহু আকবার ধ্বনি) উচ্চারণ করবে। তারা ‘ইযার’ বা তহবন্দ (এর নিম্নাংশ) পরিধান করবে তাদের (পায়ের গোছার) মাঝ বরাবর। তারা যেভাবে যুদ্ধে সারিবদ্ধ হবে, তারা তাদের সালাতেও তদ্রূপ সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে। তাদের মসজিদসমূহে তাদের (তিলাওয়াত ও যিকিরের) আওয়াজ হবে মৌমাছির গুণগুণ আওয়াজের মত। আর তাদের আহ্বানকারীর আহ্বান (মুয়াযযিনের আযান) দূর আকাশে শোনা যাবে।” – এই স্পষ্ট বিবরণগুলো যিশাইয় (Isaiah) ৪২ নং অধ্যায়ের কোথাও দেখা যায় না। আর যদি থেকে থাকে, খ্রিষ্টান মিশনারীগণ আমাদের নিকট তা পেশ করুন। কিন্তু তা পেশ করতে পারলেও তাদের জন্য কর্তব্য হবে মুহাম্মাদ(ﷺ)কে নবী হিসেবে মেনে নেয়া! তারা যিশাইয় ৪২ এর গুণাবলিগুলো যিশুখ্রিষ্টের উপর প্রয়োগ করার চেষ্টা করেন। এটিও তাদেরকে বাদ দিতে হবে। নিজেদের যুক্তিতেই তারা খণ্ডন হয়ে যাবেন।
আমরা যদি ধরেও নিই যে ৭ম শতাব্দীর ইহুদি-খ্রিষ্টানদের সেই ‘বাইবেল’ অবিকৃত ছিলো, তাহলেও বলতে হবে এখনকার বাইবেল থেকে এই অংশগুলো মুছে ফেলা হয়েছে। যিশাইয়কে তবুও বৃহত্তর অর্থে ‘তাওরাত’ এর মাঝে ফেলা যায় [এই প্রবন্ধের “১.৬। ‘তাওরাত’, ‘ইঞ্জিল’ ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার” অনুচ্ছেদ দ্বষ্টব্য], কিন্তু কিন্তু ৭ম শতাব্দীর আরবের ইঞ্জিলে নবী(ﷺ) এর গুণাবলির যে উল্লেখ রয়েছে, তা এখনকার মথি, মার্ক, লুক ও যোহনের সুসমাচারের কোথাও দেখা যায় না। এর মানে, ঐসময়কার ‘ইঞ্জিল’ যদি অবিকৃতও হয়ে থাকে, এখনকার ‘ইঞ্জিল’ থেকে এই অংশগুলো বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে। এর দ্বারাও বাইবেলের বিকৃতিই প্রমাণ হয়। কাজেই খ্রিষ্টান মিশনারীরা কুরআন-হাদিস থেকে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ অবিকৃত থাকার যে তত্ত্ব দাঁড় করাতে চান, এর দ্বারা আখেরে তাদের কোনো লাভ নেই। বরং তারা তা প্রমাণ করতে পারলেও তাদের জন্য মুহাম্মাদ(ﷺ)কে নবী হিসেবে মেনে নেয়া এবং ইসলাম গ্রহণ করা জরুরী হয়ে যাবে। তারা কি সেটি করবেন?
২.৪.২। তাওরাত ও ইঞ্জিলে নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) এর সহচরদের গুণাবলির উল্লেখঃ
مُّحَمَّدٌ رَّسُولُ اللَّهِ ۚ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ ۖ تَرَاهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِّنَ اللَّهِ وَرِضْوَانًا ۖ سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِم مِّنْ أَثَرِ السُّجُودِ ۚ ذَٰلِكَ مَثَلُهُمْ فِي التَّوْرَاةِ ۚ وَمَثَلُهُمْ فِي الْإِنجِيلِ كَزَرْعٍ أَخْرَجَ شَطْأَهُ فَآزَرَهُ فَاسْتَغْلَظَ فَاسْتَوَىٰ عَلَىٰ سُوقِهِ يُعْجِبُ الزُّرَّاعَ لِيَغِيظَ بِهِمُ الْكُفَّارَ ۗ وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ مِنْهُم مَّغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا
অর্থঃ “মুহাম্মাদ আল্লাহর রসূল; আর তার সহচরগণ অবিশ্বাসীদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল; তুমি তাদেরকে রুকু ও সিজদায় অবনত অবস্থায় আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করতে দেখবে। তাদের মুখমন্ডলে সিজদার চিহ্ন থাকবে, তাওরাতে তাদের বর্ণনা এরূপই এবং ইঞ্জীলেও। তাদের দৃষ্টান্ত একটি চারা গাছ, যা নির্গত করে কিশলয়, অতঃপর তাকে শক্ত করে এবং তা পুষ্ট হয় ও দৃঢ়ভাবে কান্ডের উপর দাঁড়িয়ে যায়; যা চাষীদেরকে মুগ্ধ করে। এভাবে (আল্লাহ বিশ্বাসীদের সমৃদ্ধি দ্বারা) অবিশ্বাসীদের অন্তর্জ্বালা সৃষ্টি করেন। ওদের মধ্যে যারা বিশ্বাস করে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ক্ষমা ও মহা পুরস্কারের।” [80]
এখানে দেখা যাচ্ছে তাওরাত ও ইঞ্জিলে মুহাম্মাদ(ﷺ) এর সহচরদের কিছু বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ। ইহুদি-খ্রিষ্টানদের এখনকার বাইবেলের ‘তাওরাত’ অংশে হুবহু এমন কিছুই দেখা যায় না। কারো কারো মতে বাইবেলের নতুন নিয়মের লুক লিখিত সুসমাচারের ১৩ : ১৯ পদে এই আয়াতের উল্লেখ আছে। সেই অংশের সাথে সুরা ফাতহের এই আয়াতের সামান্য মিল থাকলেও তা মোটেও একভাবে নেই। বরং সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে আছে। [81] এটা যদি কুরআনে উল্লেখিত ইঞ্জিলের কিছু অংশের উল্লেখ হয়েও থাকে, তবেও এর দ্বারা প্রমাণ হবে যে এখনকার ‘ইঞ্জিল’ তথা বাইবেলের লুক লিখিত সুসমাচারের ঐ স্থানে বিকৃতি ঘটেছে।
২.৪.৩। তাওরাতে আল কুরআনের উল্লেখঃ
عَنْ كَعْبٍ قَالَ عَلَيْكُمْ بِالْقُرْآنِ فَإِنَّهُ فَهْمُ الْعَقْلِ وَنُورُ الْحِكْمَةِ وَيَنَابِيعُ الْعِلْمِ وَأَحْدَثُ الْكُتُبِ بِالرَّحْمَنِ عَهْدًا وَقَالَ فِي التَّوْرَاةِ يَا مُحَمَّدُ إِنِّي مُنَزِّلٌ عَلَيْكَ تَوْرَاةً حَدِيثَةً تَفْتَحُ فِيهَا أَعْيُنًا عُمْيًا وَآذَانًا صُمًّا وَقُلُوبًا غُلْفًا
অর্থঃ “কা’ব হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, তোমরা কুরআনকে আঁকড়ে ধরো। কেননা, মনের উপলব্ধি, প্রজ্ঞার আলোকবর্তিকা, ইলমের ঝরণা, কালের বিবেচনায় আল্লাহর কিতাবসমূহের মধ্যে সবচেয়ে নবতর কিতাব। তিনি বলেন, তাওরাত কিতাবে আছে, হে মুহাম্মদ! আমি আপনার প্রতি নবতর তাওরাত নাযিল করেছি, যা অন্ধ দৃষ্টিকে, বধির কানকে এবং অনুভুতিহীন আবদ্ধ হৃদয়কে উন্মুক্ত করে দেবে।” [82]
( 192 ) وَإِنَّهُ لَتَنزِيلُ رَبِّ الْعَالَمِينَ
( 193 ) نَزَلَ بِهِ الرُّوحُ الْأَمِينُ
( 194 ) عَلَىٰ قَلْبِكَ لِتَكُونَ مِنَ الْمُنذِرِينَ
( 195 ) بِلِسَانٍ عَرَبِيٍّ مُّبِينٍ
( 196 ) وَإِنَّهُ لَفِي زُبُرِ الْأَوَّلِينَ
অর্থঃ "আর নিশ্চয় এটা (আল-কুরআন) সৃষ্টিকুলের রব হতে নাযিলকৃত। বিশ্বস্ত রূহ (জিবরীল) তা নিয়ে নাযিল হয়েছেন। আপনার হৃদয়ে, যাতে আপনি সতর্ককারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন। সুস্পষ্ট আরবী ভাষায়। আর পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে অবশ্যই এর উল্লেখ আছে।" [83]
আল কুরআনের ব্যাপারে পূর্বের কিতাবে উল্লেখ ছিলো। কা’ব(র.) সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন কুরআনের কেমন উল্লেখ সে সময়কার তাওরাতে ছিলো। সে সময়কার প্রসিদ্ধ ইহুদি পণ্ডিত কা’ব(র.) তাওরাতে এসব বিবরণ দেখেই ইহুদি ধর্ম থেকে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। আজকের দিনের বাইবেলের ‘তাওরাত’ অংশের মধ্যে এমন কিছুই দেখা যায় না। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে সাহাবীদের যুগের তাওরাতের এই অংশগুলো এখনকার ‘তাওরাত’ থেকে মুছে দেয়া হয়েছে।
২.৪.৩। তাওরাতের বিভিন্ন বিধি-বিধানের উল্লেখঃ
إِنَّ هَٰذَا الْقُرْآنَ يَقُصُّ عَلَىٰ بَنِي إِسْرَائِيلَ أَكْثَرَ الَّذِي هُمْ فِيهِ يَخْتَلِفُونَ
অর্থঃ "বনী ইসরাঈল যে সব বিষয়ে মতভেদ করে, নিশ্চয় এ কুরআন তার অধিকাংশ তাদের কাছে বিবৃত করে।" [84]
مِنْ أَجْلِ ذَٰلِكَ كَتَبْنَا عَلَىٰ بَنِي إِسْرَائِيلَ أَنَّهُ مَن قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا ۚ وَلَقَدْ جَاءَتْهُمْ رُسُلُنَا بِالْبَيِّنَاتِ ثُمَّ إِنَّ كَثِيرًا مِّنْهُم بَعْدَ ذَٰلِكَ فِي الْأَرْضِ لَمُسْرِفُونَ
অর্থঃ "এ কারণেই আমি বনী-ইসরাঈলের প্রতি লিখে দিয়েছি যে, যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করা ছাড়া কাউকে হত্যা করে সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করে। এবং যে কারও জীবন রক্ষা করে, সে যেন সবার জীবন রক্ষা করে। তাদের কাছে আমার পয়গম্বরগণ প্রকাশ্য নিদর্শনাবলী নিয়ে এসেছেন। বস্তুতঃ এরপরও তাদের অনেক লোক পৃথিবীতে সীমাতিক্রম করে।" [85]
কুরআনে বনী ইস্রাঈলের প্রতি যে বিধানটি লিখে দেবার কথা উল্লেখ আছে, সেটি পাওয়া যায় ইহুদিদের তালমুদে, Mishnah Sanhedrin 4:5 এ।[সেটাও আবার বিভিন্ন ভার্সনে বিভিন্নভাবে।]
“… if one destroys a single life, it’s as if he destroyed an entire world, while if one saves a single life, it’s as if he saved an entire world. …” [86]
“…he who destroys one soul of a human being, the Scripture considers him as if he should destroy a whole world, and him who saves one soul of Israel, the Scripture considers him as if he should save a whole world.” [87]
“…anyone who destroys one soul from the Jewish people, i.e., kills one Jew, the verse ascribes him blame as if he destroyed an entire world, as Adam was one person, from whom the population of an entire world came forth. And conversely, anyone who sustains one soul from the Jewish people, the verse ascribes him credit as if he sustained an entire world. …” [88]
কিন্তু খ্রিষ্টানরা ইহুদিদের তালমুদকে তাওরাত কিংবা ঈশ্বরের অনুপ্রাণিত বাণী বলে মানে না। কাজেই বলা যায় কুরআনে উল্লেখিত বনী ইস্রাঈলকে লিখে দেয়া এই বিধান তথা তাওরাতের বিধানটি এখনকার খ্রিষ্টীয় বাইবেলের তাওরাত অংশে নেই।
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ، قَالَ جَاءَتِ الْيَهُودُ بِرَجُلٍ وَامْرَأَةٍ مِنْهُمْ زَنَيَا فَقَالَ ائْتُونِي بِأَعْلَمِ رَجُلَيْنِ مِنْكُمْ فَأَتَوْهُ بِابْنَىْ صُورِيَا فَنَشَدَهُمَا " كَيْفَ تَجِدَانِ أَمْرَ هَذَيْنِ فِي التَّوْرَاةِ " . قَالاَ نَجِدُ فِي التَّوْرَاةِ إِذَا شَهِدَ أَرْبَعَةٌ أَنَّهُمْ رَأَوْا ذَكَرَهُ فِي فَرْجِهَا مِثْلَ الْمِيلِ فِي الْمُكْحُلَةِ رُجِمَا
অর্থঃ “জাবির ইবন আবদুল্লাহ(রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ একদা ইয়াহূদীরা দু'জন যিনাকার নারী-পুরষকে (নবী (ﷺ) -এর নিকট) নিয়ে আসে। তখন তিনি তাদের বলেনঃ তোমরা তোমাদের দু'জন আলিমকে আনো। তখন তারা বিখ্যাত ইয়াহূদী আলিম সুরিয়ার দু'পুত্রকে নিয়ে আসে। তখন তিনি তাদেরকে আল্লাহ্র শপথ দিয়ে জিজ্ঞাসা করেনঃ তোমরা দু'জন এ দুই ব্যক্তি সম্পর্কে তাওরাতে কিরূপ নির্দেশ পেয়েছে? তারা বলেঃ আমরা তাওরাতে এরূপ নির্দেশ পেয়েছি যে, যখন চার ব্যক্তি এরূপ সাক্ষ্য দিবে আমরা পুরুষের পুরুষাংগটি স্ত্রীলোকের যোনীতে এরূপ প্রবেশ করতে দেখেছি, যেরূপ যেরূপ সুরমাদানীর মধ্যে এর শলাকা প্রবেশ করে। এরূপ সাক্ষ্য পাওয়ার পর তাদের রজম করা হয়। …” [89]
৭ম শতাব্দীতে নবী(ﷺ) এর যুগের ইহুদিদের তাওরাতে ব্যভিচারীকে রজম (পাথর ছুড়ে মৃত্যুদণ্ড) শাস্তি দেবার জন্য ৪ জন সাক্ষীর উল্লেখ ছিলো। এখনকার ইহুদি-খ্রিষ্টানদের বাইবেলীয় তাওরাতে রজমের শাস্তির উল্লেখ আছে দ্বিতীয় বিবরণ (Deuteronomy) ২২ নং অধ্যায়ে। [90] কিন্তু কোথাও ৪ জন সাক্ষীর উল্লেখ নেই। ৭ম শতাব্দীর আরবের ইহুদিদের তাওরাতে ৪ জন সাক্ষীর যে উল্লেখ ছিলো তা এখনকার তাওরাত থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: خَرَجْتُ إِلَى الطُّورِ فَلَقِيتُ كَعْبَ الْأَحْبَارِ فَجَلَسْتُ مَعَهُ فَحَدَّثَنِي عَنِ التَّوْرَاةِ وَحَدَّثْتُهُ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَكَانَ فِيمَا حَدَّثْتُهُ أَنْ قُلْتُ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: خَيْرُ يَوْمٍ طَلَعَتْ عَلَيْهِ الشَّمْسُ يَوْمُ الْجُمُعَةِ فِيهِ خُلِقَ آدَمُ وَفِيهِ أُهْبِطَ وَفَيْهِ تِيبَ عَلَيْهِ وَفِيهِ مَاتَ وَفِيهِ تَقُومُ السَّاعَةُ وَمَا من دَابَّة إِلَّا وَهِي مسيخة يَوْمَ الْجُمُعَةِ مِنْ حِينِ تُصْبِحُ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ شَفَقًا مِنَ السَّاعَةِ إِلَّا الْجِنَّ وَالْإِنْسَ وفيهَا سَاعَةٌ لَا يُصَادِفُهَا عَبْدٌ مُسْلِمٌ وَهُوَ يُصَلِّي يسْأَل الله شَيْئا إِلَّا أعطَاهُ إِيَّاهَا. قَالَ كَعْبٌ: ذَلِكَ فِي كُلِّ سَنَةٍ يَوْمٌ. فَقلت: بل فِي كل جُمُعَة قَالَ فَقَرَأَ كَعْبٌ التَّوْرَاةَ. فَقَالَ: صَدَقَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.
অর্থঃ “আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি তূর (বর্তমান ফিলিস্তীনের সিনাই) পর্বতের দিকে গেলাম। সেখানে কা‘ব আহবার-এর সঙ্গে আমার দেখা হলো। আমি তার কাছে বসে গেলাম। তিনি আমাকে তাওরাতের কিছু কথা বলতে লাগলেন। আমি তার সামনে রসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর কিছু হাদীস বর্ণনা করলাম। আমি যেসব হাদীস বর্ণনা করলাম তার একটি হলো, আমি তাঁকে বললাম, রসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেনঃ যেসব দিনে সূর্য উদিত হয় তার মধ্যে সর্বোত্তম দিন হলো জুমু‘আর দিন। জুমু‘আর দিনে আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে। ওই দিন তাঁকে জান্নাত থেকে জমিনে বের করা হয়েছে। এ দিনেই তাঁর তওবা্ কবূল করা হয়। এ দিনেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। এ দিনেই ক্বিয়ামাত (কিয়ামত) হবে।
আর জিন্ ইনসান ছাড়া এমন কোন চতুষ্পদ জন্তু নেই যারা এ জুমু‘আর দিনে সূর্য উদয় হতে অস্ত পর্যন্ত ক্বিয়ামাত (কিয়ামত) হবার মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা না করে। জুমু‘আর দিন এমন একটি মুহূর্ত আছে, যে সময় যদি কোন মুসলিম সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আদায় করে এবং আল্লাহর নিকট কিছু চায়, আল্লাহ তাকে অবশ্যই তা দান করেন। কা‘ব আহবার এ কথা শুনে বললেন, এ রকম দিন বা সময় বছরে একবার আসে। আমি বললাম, বরং প্রতিটি জুমু‘আর দিনে আসে। তখন কা‘ব তাওরাত পাঠ করতে লাগলেন, এরপর বললেন, ‘‘রসূলুল্লাহ(ﷺ) সত্য বলেছেন।… …” [91]
জুমু’আর দিন সম্পর্কে এই তথ্য এখনকার বাইবেলের কোথাও নেই যা কা’ব আল আহবার(র.) এর তাওরাতে ছিলো।
এরপরেও খ্রিষ্টান প্রচারকগণ যদি এই সম্পুর্ণ প্রবন্ধটি খণ্ডন করেন এবং অলৌকিক কোনো উপায়ে প্রমাণ করে ফেলেন যে কুরআনে –হাদিসে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থকে অবিকৃত বলা হয়েছে, ৭ম শতাব্দীর সেই ‘বাইবেল’ এবং আজকের বাইবেল হুবহু এক – তাহলে এর দ্বারা প্রমাণ হবে কুরআনে-হাদিসের সত্যায়ন করা ৭ম শতাব্দীর ‘বাইবেলে’ মুহাম্মাদ(ﷺ) এর নাম ও গুণাবলি, তাঁর সহচরদের গুণাবলি এবং আল কুরআনের কথা যেভাবে স্পষ্টভাবে লিখিত ছিলো, আজকের বাইবেলেও তা হুবহু সেভাবেই লিখিত আছে। খ্রিষ্টান মিশনারীদের তাহলে এই ২১ শতকে এমন কোনো ‘বাইবেল’ খুঁজে এনে মুসলিমদেরকে দেখাতে হবে। এর দ্বারা ইসলামের সত্যতা আরো বেশি করে প্রমাণ হবে এবং খ্রিষ্টানদেরই ইসলাম গ্রহণ করা জরুরী হয়ে যাবে। আমরা আশা করছি খ্রিষ্টান প্রচারকগণ বিষয়টি অনুধাবন করবেন এবং কুরআন-হাদিসকে অপব্যাখ্যা করার ধারা থেকে বেরিয়ে আসবেন। সত্যকে গ্রহণ করবেন। যাবতীয় সাফল্য এবং নাজাত একমাত্র সত্যের মাঝেই নিহীত আছে।
৩। বাইবেল নিজেই সাক্ষ্য দেয় এর মাঝে অবিকৃত তাওরাত নেই, এর অনেক পুস্তক হারিয়ে গেছেঃ
খ্রিষ্টান প্রচারকগণ কুরআন থেকে বাইবেলের অবিকৃতি ও বিশুদ্ধতার ব্যাপারে প্রমাণ উপস্থাপনের (বৃথা) চেষ্টা করেন অথচ বাইবেল নিজেই নিজের বিকৃতির সাক্ষ্য বহন করে।
বাইবেলের একজন ভাববাদী (নবী) হচ্ছেন যিরমিয় (Jeremiah)। বাইবেলের যিরমিয় ভাববাদীর পুস্তকে উল্লেখ আছে, তিনি ইহুদিদেরকে বলছেন, তাদের তাওরাতকে এর লিপিকাররা মিথ্যাভাবে লিখেছে। এর মাঝে মিথ্যা ঢুকে গেছে। এই একই তথ্য কুরআন-হাদিস এবং সালাফে সলিহীনদের বক্তব্য থেকে এসেছে যা নিয়ে এই প্রবন্ধে ইতিমধ্যেই দীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে।
বাইবেলের বিভিন্ন অনুবাদ থেকে ভাববাদী যিরমিয়র উক্তিটি উল্লেখ করা হলোঃ
“ ‘তোমরা কীভাবে বলো, “আমরা জ্ঞানবান, কারণ আমাদের কাছে আছে সদাপ্রভুর বিধান,” যখন শাস্ত্রবিদদের মিথ্যা লেখনী, তা মিথ্যা করে লিখেছে?” (BCV) [92]
“কি করে তারা নিজেদের জ্ঞানবান বলে থাকে? কি করে বলে যে তারা আমার বিধান জানে? দেখ, অবিশ্বস্ত নকলনবিশদের দ্বারা বিধান পরিবর্তিত হয়েছে।” (BENGALCL-BSI) [93]
“‘তোমরা বলে চলেছো, “আমরা প্রভুর শিক্ষায় জ্ঞানী হয়ে উঠেছি!” কিন্তু তা সত্যি নয়। কারণ শাস্ত্রবিদরা মিথ্যা লিখেছিলেন।” (BERV) [94]
“তোমরা কেমন করে বলতে পার, আমরা জ্ঞানী এবং আমাদের কাছে মাবুদের শরীয়ত আছে? দেখ, আলেমদের মিথ্যা-লেখনী তা মিথ্যা করে ফেলেছে।” (কিতাবুল মোকাদ্দস) [95]
““How can you say, ‘We are wise, and the law of the Lord is with us’? But behold, the false pen of the scribes has made it into a lie.” (RSV) [96]
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, এখানে তো সরাসরি তাওরাত (Torah) শব্দটি দেখা যাচ্ছে না!
এখানেই এক শুভঙ্করের ফাঁকি আছে।
এখানে বিভিন্ন অনুবাদে বিধান, শরিয়ত, Law of the Lord এইসব শব্দ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু প্রিয় পাঠক কি জানেন যে এখানে মূল হিব্রুতে কী শব্দ ছিলো?
উত্তর হচ্ছেঃ এখানে মূল হিব্রুতে ছিলো “תוֹרַ֥ת” (হিব্রু উচ্চারণঃ তোওরাত) শব্দটি।
অনুবাদকরা যদি ‘তাওরাত’ বা ‘Torah’ শব্দ দিয়ে অনুবাদ করেন, তাহলে মহা সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। মানুষ বলা শুরু করতে পারেঃ “তাওরাত তাহলে মিথ্যাভাবে লেখা হয়েছে?!” সম্ভবত এই কারণেই অনুবাদগুলোর এ অবস্থা। কিন্তু মূল হিব্রুতে এখনো জ্বল জ্বল করে “תוֹרַ֥ת” (তোওরাত) শব্দটি দেখা যায়।যা সাক্ষ্য দিচ্ছে ইহুদিদের তাওরাতের লিখিত রূপ আর পুরোপুরি সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নেই। লিপিকাররা একে মিথ্যাভাবে লিখেছেন। বাইবেল নিজেই এর সাক্ষ্য দিচ্ছে।
যিরমিয় (Jeremiah) ৮ : ৮ এর মূল হিব্রু পাঠ নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
সূত্রঃ https://biblehub.com/interlinear/jeremiah/8-8.htm
শুধু তাই না, বর্তমান বাইবেলের বিভিন্ন পুস্তকের মধ্যে আরো অনেক পুস্তকের নামের উল্লেখ দেখা যায় যে পুস্তকগুলো এখন আর বাইবেলের মধ্যে নেই। যেমনঃ
(১) ‘সদাপ্রভুর যুদ্ধপুস্তক’ (গণনা পুস্তক ২১/১৪),
(২) ‘যাশের পুস্তক (যিহোশূয় ১০ : ১৩),
(৩) শমূয়েল ভাববাদীর রাজতন্ত্রের পুস্তক (১ শমুয়েল ১০ : ২৫),
(৪) শমূয়েল দর্শকের পুস্তক, (৫) নাথন ভাববাদীর পুস্তক, (৬) গাদ দর্শকের পুস্তক (১ বংশাবলি ২৯ : ২৯),
(৭) শময়িয় ভাববাদীর পুস্তক, (৮) ইদ্দো দর্শকের পুস্তক (২ বংশাবলি ১২ : ১৫),
(৯) শীলোনীয় অহীয়ের ভাববাণী, (১০) ইদ্দো দর্শকের দর্শন (২ বংশাবলি ৯ : ২৯),
(১১) হনানির পুত্র যেহুর পুস্তক (২ বংশাবলি ২০ : ৩৪),
(১২) যিশাইয় ভাববাদী রচিত উষিয় রাজার আদ্যোপান্ত ইতিহাস (২ বংশাবলি ২৬ : ২২),
(১৩) যিশাইয় ভাববাদীর দর্শন-পুস্তক হিষ্কিয় রাজার ইতিহাস সম্বলিত (২ বংশাবলি ৩২ : ৩২),
(১৪) যিরমিয় ভাববাদী রচিত যোশিয় রাজার বিলাপগীত (২ বংশাবলি ৩৫ : ২৫),
(১৫) বংশাবলি পুস্তক (নহিমিয় ১২ : ২৩),
(১৬) মোশির ‘নিয়মপুস্তক’ (যাত্রাপুস্তক ২৪ : ৭)
(১৭) শলোমনের বৃত্তান্ত-পুস্তক (১ রাজাবলি ১১ : ৪১)। [97]
বাইবেল অনুযায়ী শাস্ত্রের সকল পুস্তকই গুরুত্বপূর্ণ। ২ তিমথীয় ৩ : ১৬-১৭ [98] অনুসারে খ্রিষ্টানগণ বিশ্বাস করেন শাস্ত্রের সকল পুস্তকই ঈশ্বরের দ্বারা অনুপ্রাণিত। সেক্ষেত্রে বাইবেলের মধ্যে উল্লেখিত উপরের তালিকার পুস্তকগুলোও ঈশ্বরের অনুপ্রাণিত এবং ঈশ্বরের বাণী বলে গণ্য হবার কথা। কিন্তু এই পুস্তকগুলো আর বাইবেলের মাঝে নেই। এর সব পুস্তকের হদিশও পাওয়া যায় না।তাদের বাইবেল থেকেই যখন এই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাহলে কিসের ভিত্তিতে খ্রিষ্টান মিশনারীগণ আবার কুরআন-হাদিস ব্যবহার করে নিজ ধর্মগ্রন্থের অবিকৃত থাকার কথা বলেন?
৪। উপসংহারঃ
সমগ্র আলোচনার সারাংশ উল্লেখ করে উপসংহার টানছি।
ক) ইসলামের অবস্থান হচ্ছে পূর্বের সকল আসমানী কিতাবের উপর ঈমান রাখতে হবে। কিন্তু ইহুদি-খ্রিষ্টানদের বাইবেল আর পূর্বের আসমানী কিতাব এক জিনিস নয়।
খ) কুরআন, হাদিস, সালাফে সলিহীনদের বক্তব্য, পূর্বযুগের আলেমদের বক্তব্য সকল কিছু সাক্ষ্য দেয় ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ বিকৃত।
গ) ‘তাহরিফ’ কথাটি দ্বারা ব্যাখ্যা বদলে দেয়া এবং লিখিত রূপে পরিবর্তন করা উভয়ই বোঝায়। ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থে উভয়টিই হয়েছে।
ঘ) কুরআন পূর্বের ধর্মগ্রন্থকে সত্যায়ন করে। এগুলোর মাঝে যা সত্য ও সঠিক তথ্য, কুরআন সেগুলোকে সমর্থন করে, আর বিকৃত/ভুল তথ্যগুলোকে নাকচ করে। কুরআন এগুলোর উপর তদারককারী, সত্য-মিথ্যার মানদণ্ড।
ঙ) ‘আল্লাহর বাণীর পরিবর্তনকারী নেই’ এই কথা দ্বারা আল্লাহর বাণীর লিখিত রূপ কিতাবের অবিকৃত থাকার নিশ্চয়তা বোঝায় না।
চ) আহলে কিতাবদের কাছে জিজ্ঞেস করার আয়াত দ্বারা মোটেও বাইবেলের অবিকৃত থাকা বোঝায় না। প্রসঙ্গ দেখলে বোঝা যায় আলোচ্য আয়াতে কুরআনের উপরে সন্দেহ পোষণ করতে নিষেধ করা হয়েছে অর্থাৎ আহলে কিতাবের উপর নির্ভর করার কোনো ব্যাপার নেই।
ছ) তাওরাত-ইঞ্জিলের অবিকৃত অংশ প্রতিষ্ঠা করলে ইহুদি-খ্রিষ্টানরা শেষ নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) এর উপর ঈমান আনা তথা ইসলামের দিকে আসবে।
জ) কুরআন-হাদিস ও সাহাবীদের থেকে প্রাপ্ত বর্ণনা থেকে এটি স্পষ্ট যে নবী(ﷺ) এর সময়কার অর্থাৎ ৭ম শতাব্দীর ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ আর আজকের বাইবেল এক নয়। এগুলোর মাঝে বিস্তর ফারাক আছে।
ঝ) বাইবেল নিজেই নিজ বিকৃতির ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয়।
তথ্যসূত্রঃ
[1] আল কুরআন, নিসা ৪ : ১৩৬
[2] আল কুরআন, বাকারাহ ২ : ৭৭-৭৯
[3] তাফসির তাবারী, ২য় খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ) সুরা বাকারাহর ৭৯ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ১২৩-১২৪
[4] সহীহ বুখারী, হাদিস নং : ৭৩৬৩
[5] সহীহ বুখারী, হাদিস নং : ২৫০৬
[7] আল কুরআন, মায়িদাহ ৫ : ১২-১৩
[8] তাফসির তাবারী, ৮ম খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ) সুরা মায়িদাহর ১৩ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ৩৫১-৩৫২
[9] আল কুরআন, মায়িদাহ ৫ : ১৪
[10] তাফসির তাবারী, ৮ম খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ) সুরা মায়িদাহর ১৪ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ৩৫৫
[11] সুনান নাসাঈ, হাদিস নং : ৫৩৯৯ (সহীহ)
[12] ■ Biblical canon - New World Encyclopedia
https://www.newworldencyclopedia.org/entry/Biblical_canon#Christian_canons
■ biblical literature - The process of canonization _ Britannica
https://www.britannica.com/topic/biblical-literature/The-process-of-canonization
[13] Theodosius Issued an Edict - 301-600 Church History Timeline
[14] List of people burned as heretics - The Art and Popular Culture Encyclopedia
http://www.artandpopularculture.com/List_of_people_burned_as_heretics
[15] Desert Monasticism and the Later Fourth-Century Psalmodic Movement on JSTOR
[16] মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/৩১২, বর্ণনাকারীগণ সহীহ।
https://dorar.net/h/2eb363b8cdfa7811aa914720ee1188f6
আরো দেখুনঃ
তারগীব ওয়াত তারহীব হা/১৯৩৯; মুসনাদ আহমদ হা/১৯৪০৩; তাবরানী মুজামুল কাবীর (হা/৫০৮৪; ৫/২০০); সিলসিলা সহীহা (৭/১০৯৮)
ইমাম হাইসামী(র.) সহীহ্ বলেছেন, ইমাম মুনজীরি(র.) সহীহ্ বলেছেন, ইমাম আলবানী(র.) হাসান বলেছেন, ইমাম শুয়াইব আরনাঊত(র.) মতে সনদ সহীহ্।
[17] তাফসির ইবন কাসির, ১০ম খণ্ড, (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), সুরা হাদিদের ১৬ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ৭০১; বর্ণনাটিকে শায়খ আলবানী(র.) তাঁর সিলসিলা সহীহাহতে রেখেছেন। দেখুনঃ সিলসিলা সহীহাহ ২৬৯৪
[18] সুনান তিরমিযি, হাদিস নং : ২৬৪১ (হাসান)
[19] 'Arabic English Lexicon' By Edward William Lane , Page 549
http://lexicon.quranic-research.net/pdf/Page_0549.pdf
অথবাঃ http://arabiclexicon.hawramani.com/search/تحريف?cat=50
[20] আকিদাতুল হামাওয়িয়্যাহ - শাইখুল ইসলাম ইবন ইবন তাইমিয়া (ইংরেজি অনুবাদ), পৃষ্ঠা ৬
[21] https://islamweb.net/ar/library/index.php?page=bookcontents&idfrom=13832&idto=13835&bk_no=52&ID=4083 অথবাঃ https://tinyurl.com/4z827sy3
[22] সহীহ বুখারী (আধুনিক প্রকাশনী), অনুচ্ছেদ ৫৫; ৭০৩৩ নং হাদিসের পূর্বে তা’লিকাত, পৃষ্ঠা ৪৬০
[23] ফাতহুল বারী – ইমাম ইবন হাজার আসকালানী
https://islamweb.net/ar/library/index.php?page=bookcontents&idfrom=13832&idto=13835&bk_no=52&ID=4083
[24] এখানে শমরিয়/সামেরি বা Samaritanদের তাওরাতের কথা বলা হচ্ছে। Samaritanরা বনী ইস্রাঈল থেকেই উদ্ভুত আরেকটি ধর্মালম্বী গোষ্ঠী। তারাও বনী ইস্রাঈলের মানুষ তবে তারা নিজেদের 'ইহুদি' ধর্মের অনুসারী বলে না। তাদের দাবিমতে তারাই বনী ইস্রাঈলের আসল ধর্মাদর্শের অনুসারী এবং তাদের কাছেই 'আসল' তাওরাত আছে। ইহুদি ও শমরিয়রা একে অন্যকে তাওরাত বিকৃতির জন্য অভিযুক্ত করে। ইহুদিদের সাথে শমরিয়দের তাওরাতে অনেক জায়গায় পার্থক্য দেখা যায়। যেমন, ইহুদি ও প্রোটেস্টান্ট খ্রিষ্টানদের অনুসৃত Masoretic text এর বাইবেলে দ্বিতীয় বিবরণ (Deuteronomy) ২৭ : ৪ এ Mount Ebal এর কথা আছে, শমরিয়দের কিতাবে দ্বিতীয় বিবরণ (Deuteronomy) ২৭ : ৪ এ সে স্থলে Aargaareezeem বা Mount Gerizim (আরবিতে তূর পর্বত) এর কথা আছে। এর উপর ভিত্তি করে শমরিয়রা জেরুজালেমের বাইতুল মুকাদ্দাসের বদলে Mount Gerizim বা তূর পর্বতকে তাদের ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবে নির্ধারণ করে। [ক্যাথোলিক ও অর্থোডক্স খ্রিষ্টানরা Septuagint নামে আরেকটি পাঠ থেকে তাদের বাইবেলের পুরাতন নিয়ম বা Old Testament এ অতিরিক্ত আরো কিছু পুস্তক অন্তর্ভুক্ত করে। এই অতিরিক্ত পুস্তকগুলোকেও তারা “ঈশ্বরের বাণী” মনে করে।]
বাইবেলে দ্বিতীয় বিবরণ (Deuteronomy) ২৭ : ৪ এর শমরিয় (Samaritan) পাঠঃ
“And it shall be when you cross the Yaardaan, you shall set up on Aargaareezem these stones, which I am commanding you today. And you shall coat them with lime.”
বাইবেলে দ্বিতীয় বিবরণ (Deuteronomy) ২৭ : ৪ এর Masoretic পাঠ (ইহুদি ও প্রোটেস্টান্ট খ্রিষ্টানদের অনুসৃত):
“And it shall be when ye are passed over the Jordan, that ye shall set up thcsc stones, which I command you this day, in mount Ebal, and thou shalt plaster them with plaster.”
সূত্রঃ “The Israelite Samaritan Version of the Torah: First English Translation Compared with the Masoretic Version” by Benyamim Tsedaka; Page 467
এ প্রসঙ্গে CSB Apologetics Study Bible এ বলা হয়েছেঃ
“The Samaritan Pentateuch (version of the Torah used by the Samaritan sect) reads Gerizim rather than Ebal, and thereby locates the monument at the place where the Samaritans eventually built a temple. It was there when Jesus spoke to the woman at the well, and it was to Gerizim that the woman pointed when she spoke of her place of worship (Jn 4:20). The Hebrew text preserves the original reading, which the Samaritans altered to justify their practice. Jesus pointed beyond both geographical locations, the Samaritan Gerizim and the Jewish Jerusalem, to the true worship of the Father (Jn 4:21-24).”
https://www.biblestudytools.com/commentaries/csb-apologetics/deuteronomy-27-footnotes.html
[25] আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া - ইবন কাসির, ২য় খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), পৃষ্ঠা ২৯২-২৯৩
[26] আল কুরআন, বাকারাহ ২ : ৪১
[27] আল কুরআন, মায়িদাহ ৫ : ৪৮
[28] তাফসির তাবারী, ৯ম খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ) সুরা মায়িদাহর ৪৮ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ২৯
[29] তাফসির ইবন কাসির, ৩য় খণ্ড, (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), সুরা মায়িদাহর ৪৮ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ৫৬৪
[30] তাফসির তাবারী, ১ম খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ) সুরা বাকারাহর ৪২ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ৩৮২
[31] The Holy Quran English Translation of The Meanings and Commentary – Abdullah Yusuf Ali [King Fahd Printing Complex] Page 300, Footnote: 759
[32] সহীহ বুখারী, হাদিস নং : ৭৫৪২
[33] আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া - ইবন কাসির, ২য় খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), পৃষ্ঠা ২৮৬-২৮৭
[34] নাসরুল বারী শরহে বুখারী, ৯ম খণ্ড (শিবলী প্রকাশনী), পৃষ্ঠা ৯৬
[35] তাফসির তাবারী, ৯ম খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ) সুরা বাকারাহর ৬৪ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ৮৬; ড. আবদুল্লাহ বিন নাসির আশ শাক্বারি বলেছেন, এই বর্ণনার সনদের সকল ব্যক্তি (বর্ণনাকারী) বিশ্বস্ত। [ اليهود في السنة المطهرة ٥١٨/٢]
সূত্রঃ টিকা নং ১: https://tinyurl.com/3ua5znph অথবা https://is.gd/dzFNCo
[36] “The word "Torah" is a tricky one, because it can mean different things in different contexts. In its most limited sense, "Torah" refers to the Five Books of Moses: Genesis, Exodus, Leviticus, Numbers and Deuteronomy. But the word "torah" can also be used to refer to the entire Jewish bible (the body of scripture known to non-Jews as the Old Testament and to Jews as the Tanakh or Written Torah), or in its broadest sense, to the whole body of Jewish law and teachings.”
বিস্তারিত দেখুনঃ “Judaism 101 Torah”
[37] আল কুরআন, আন’আম ৬ : ৩৪
[38] আল কুরআন, আন’আম ৬ : ১১৫
[39] আল কুরআন, কাহফ ১৮ : ২৭
[40] তাফসির ইবন কাসির, ৩য় খণ্ড, (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), সুরা আন’আমের ৩৪ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ৭৫২-৭৫৩
[41] তাফসির মাআরিফুল কুরআন, ৫ম খণ্ড, (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), সুরা কাহফের ২৭নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ৫৮৩
[42] 'কিতাবুল মোকাদ্দস, ইঞ্জিল শরীফ ও ঈসায়ী ধর্ম' - ড. খোন্দকার আ.ন.ম. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, পৃষ্ঠা ৪৪
[43] আল কুরআন, হিজর ১৫ : ৯
[44] তাফসির ইবন কাসির, ৬ষ্ঠ খণ্ড, (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), সুরা হিজরের ৯ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ২৫
[45] তাফসির যাকারিয়া, সুরা হিজরের ৯ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ২৫
[46] আল কুরআন, নাহল ১৬ : ৪৩
[47] আল কুরআন, আম্বিয়া ২১ : ৭
[48] তাফসির ইবন কাসির, ৬ষ্ঠ খণ্ড, (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), সুরা নাহলের ৪৩নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ১০৮
[49] তাফসির মাআরিফুল কুরআন, ৫ম খণ্ড, (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), সুরা নাহলের ৪৩নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ৩৩৫-৩৩৬
[50] আল কুরআন, ইউনুস ১০ : ৯৩-৯৫
[51] তাফসির ইবন কাসির, ৫ম খণ্ড, (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), সুরা ইউনুসের ৯৪ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ২০৩
[52] আল কুরআন, মায়িদাহ ৫ : ৪৩
[53] সুনান তিরমিজী, হাদিস নং : ২৬৫৪ (সহীহ)
[54] সুনান আবু দাউদ, হাদিস নং : ৪৪৪৯ (হাসান - আলবানী)
[55] English Translation of Sunan Abu Dawud, Ahadith edited & referenced by: Hafiz Abu Tahir Zubair 'All Za'I; Volume 5, Page 72
[58] الفصل في الملل - ابن حزم 1/157
[59] فتح الباري شرح صحيح البخاري » كتاب الحدود » باب أحكام أهل الذمة وإحصانهم إذا زنوا ورفعوا إلى الإمام
[60] তাফসির তাবারী, ৯ম খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ) সুরা বাকারাহর ৬৪ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ৮৬; ড. আবদুল্লাহ বিন নাসির আশ শাক্বারি বলেছেন, এই বর্ণনার সনদের সকল ব্যক্তি (বর্ণনাকারী) বিশ্বস্ত। [ اليهود في السنة المطهرة ٥١٨/٢]
সূত্রঃ টিকা নং ১: https://tinyurl.com/3ua5znph অথবা https://is.gd/dzFNCo
[61] আল কুরআন, মায়িদাহ ৫ : ৪৪
[62] তাফসির তাবারী, ৯ম খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ) সুরা মায়িদাহর ৪৪ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ৯-১০
[63] আল কুরআন, মায়িদাহ ৫ : ৪৭
[64] তাফসির তাবারী, ৯ম খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ) সুরা মায়িদাহর ৪৭ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ২৬-২৭
[65] আল কুরআন, মায়িদাহ ৫ : ৪৮
[66] তাফসির ইবন কাসির, ৩য় খণ্ড, (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), সুরা মায়িদাহর ৪৮ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ৫৬৩-৫৬৬
[67] “…وأجابوا عن حديث الباب بأنه - صلى الله عليه وسلم - إنما رجمهما بحكم التوراة وليس هو من حكم الإسلام في شيء ، وإنما هو من باب تنفيذ الحكم عليهم بما في كتابهم ؛ فإن في التوراة الرجم على المحصن وغير المحصن ، قالوا وكان [ ص: 177 ] ذلك أول دخول النبي - صلى الله عليه وسلم - المدينة ، وكان مأمورا باتباع حكم التوراة والعمل بها حتى ينسخ ذلك في شرعه ، فرجم اليهوديين على ذلك الحكم ، ثم نسخ ذلك بقوله تعالى : واللاتي يأتين الفاحشة من نسائكم فاستشهدوا عليهن أربعة منكم إلى قوله : أو يجعل الله لهن سبيلا ثم نسخ ذلك بالتفرقة بين من أحصن ومن لم يحصن كما تقدم ، انتهى”
فتح الباري شرح صحيح البخاري » كتاب الحدود » باب أحكام أهل الذمة وإحصانهم إذا زنوا ورفعوا إلى الإمام
[68] আল কুরআন, মায়িদাহ ৫ : ৬৮
[69] তাফসির তাবারী, ৯ম খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ) সুরা মায়িদাহর ৬৮ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ৮৬
[70] আল কুরআন, আ’রাফ ৭ : ১৫৭ ও সফ ৬১ : ৬
[71] আল কুরআন, আলি ইমরান ৩ : ৩
[72] আল কুরআন, আ’রাফ ৭ : ১৫৭-১৫৮
[73] সহীহ বুখারী, হাদিস নং : ৪৮৩৮
[74] সহীহ বুখারী, হাদিস নং : ২১২৫
[75] সুনান দারিমি হাদিস নং : ৮ (সহীহ)
[76] সিলসিলা সহীহাহ. হাদিস নং : ২৪৫৮
[77] আল কুরআন, বাকারাহ ২ : ১৪৬
[78] আল কুরআন, আন’আম ৬ : ২০
[79] দেখুন, যিশাইয় ৪২ নং অধ্যায়
[80] আল কুরআন, ফাতহ ৪৮ : ২৯
[81] "18এরপর যীশু প্রশ্ন করলেন, “ঈশ্বরের রাজ্য কীসের মতো? কার সঙ্গে আমি এর তুলনা দেব? 19এ হল এক সর্ষে বীজের মতো যা এক ব্যক্তি সেটাকে তার বাগানে রোপণ করল। তারপর সেটি বেড়ে উঠে গাছে পরিণত হল, আর আকাশের পাখিরা এসে তার শাখায় আশ্রয় নিল।”"
(বাইবেল, লুক (Luke) ১৩ : ১৮-১৯)
[82] সুনান দারিমি হাদিস নং : ৩৩৬৬ (হাসান)
[83] আল কুরআন, শু’আরা ২৬ : ১৯২-১৯৬
[84] আল কুরআন, নামল ২৭ : ৭৬
[85] আল কুরআন, মায়িদাহ ৫ : ৩২
[86] Sanhedrin 4_4-5 - Mishna Yomit - OU Torah
[87] Babylonian Talmud, Book 8, tr. Rodkinson_ Tract Sanhedrin_ Chapter IV
[88] Mishnah Sanhedrin 4_5 (Sefaria)
https://www.sefaria.org/Mishnah_Sanhedrin.4.5
আরো দেখুনঃ পৃষ্ঠা ১৫৫-১৫৬, টীকা নং ৩৯
[89] সুনান আবু দাউদ, হাদিস নং : ৪৩৯৫ (সহীহ)
[90] "20কিন্তু, সেই অভিযোগ যদি সত্যি হয় এবং মেয়েটির কুমারী অবস্থার কোনও প্রমাণ পাওয়া না যায়, 21তবে মেয়েটিকে তার বাবার বাড়ির দরজার কাছে নিয়ে যেতে হবে আর তার নগরের পুরুষেরা সেখানে তাকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলবে। বাবার বাড়িতে থাকবার সময় ব্যভিচার করে ইস্রায়েলীদের মধ্যে মর্যাদাহানিকর কাজ করেছে। তোমরা তোমাদের মধ্য থেকে এরকম দুষ্টতা শেষ করে দেবে। 22কোনো লোককে যদি অন্য লোকের স্ত্রীর সঙ্গে শুতে দেখা যায়, তবে যে তার সঙ্গে শুয়েছে সেই পুরুষ ও সেই স্ত্রীলোক দুজনকেই মেরে ফেলবে। তোমরা তোমাদের মধ্য থেকে এরকম দুষ্টতা শেষ করে দেবে। 23বিয়ে ঠিক হয়ে আছে এমন কোনও কুমারী মেয়েকে নগরের মধ্যে পেয়ে যদি কেউ তার সঙ্গে শোয়, 24তোমরা দুজনকেই নগরের দ্বারের কাছে নিয়ে গিয়ে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলবে—মেয়েটিকে মেরে ফেলবে কারণ নগরের মধ্যে থেকেও সে সাহায্যের জন্য চিৎকার করেনি, আর পুরুষটিকে মেরে ফেলতে হবে কারণ সে অন্যের স্ত্রীকে নষ্ট করেছে। তোমরা তোমাদের মধ্য থেকে এরকম দুষ্টতা শেষ করে দেবে।"
(বাইবেল, দ্বিতীয় বিবরণ (Deuteronomy) ২২ : ২০-২৪)
[91] মিশকাত, হাদিস নং : ১৩৫৯ (সহীহ)
[97] পুস্তকগুলোর নামের তালিকার জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ 'কিতাবুল মোকাদ্দস, ইঞ্জিল শরীফ ও ঈসায়ী ধর্ম' - ড. খোন্দকার আ.ন.ম. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, পৃষ্ঠা ৪৫-৪৬
[98] “16সমস্ত শাস্ত্রলিপি ঈশ্বর-নিশ্বসিত এবং শিক্ষা, তিরস্কার, সংশোধন ও ধার্মিকতায় প্রশিক্ষণের জন্য উপযোগী, 17যেন ঈশ্বরের লোক পরিপক্ব ও সমস্ত সৎকর্মের জন্য সুসজ্জিত হয়।” (বাইবেল, ২ তিমথীয় (2 Timothy) ৩ : ১৬-১৭)