আমরা সবাই কম-বেশি ওয়ারাকা বিন নাওফাল নামটির সাথে পরিচিত। তিনি ছিলেন খাদিজা(রা.) এর চাচাতো ভাই। সত্য সন্ধানী এই মানুষটি জাহিলিয়াতের যুগে ঈসায়ী ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন প্রাচীন আসমানী কিতাব সম্পর্কে একজন জ্ঞানী মানুষ। রাসুল(ﷺ) এর প্রথম ওহী পাবার ঘটনার প্রেক্ষিতে খাদিজা(রা.) তাঁকে ওয়ারাকা বিন নাওফালের কাছে নিয়ে যান। রাসুল(ﷺ) তাঁকে হেরা গুহায় জিব্রাঈল(আ.) কর্তৃক ওহী[সুরা আলাকের প্রথম ৫ আয়াত] নিয়ে আসার বিবরণ শোনালে ওয়ারাকা মন্তব্য করেছিলেন - রাসুল(ﷺ) এর নিকট সেই দূত এসেছে যেই দূত মুসা(আ.) এর নিকটেও আসতেন। অর্থাৎ জিব্রাঈল(আ.)। সহীহ বুখারীর ভাষ্য অনুযায়ীঃ---
“... এ আয়াত নিয়ে রাসুলুল্লাহ(ﷺ) ফিরে এলেন। তাঁর অন্তর তখন কাঁপছিল। তিনি খাদীজা বিন্ত খুওয়ালিদের কাছে এসে বললেন, আমাকে চাঁদর দিয়ে ঢেকে দাও, আমাকে চাঁদর দিয়ে ঢেকে দাও। ’ তাঁরা তাঁকে চাঁদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। অবশেষে তাঁর ভয় দূর হল। তখন তিনি খাদীজা(রা.) এর কাছে সকল ঘটনা জানিয়ে তাঁকে বললেন, আমি নিজের উপর আশংকা বোধ করছি। খাদীজা (রা.) বললেন, আল্লাহ্র কসম, কক্ষনো না। আল্লাহ্ আপনাকে কক্ষনো অপমানিত করবেন না। আপনিতো আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করেন, অসহায় দুর্বলের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সাহায্য করেন, মেহমানের মেহমানদারী করেন এবং দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন। এরপর তাঁকে নিয়ে খাদীজা (রা.) তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনু নাওফিল(অথবা নাওফাল) ইবনু আবদুল আসা’দ ইবনু আবদুল উযযার কাছে গেলেন, যিনি জাহিলী যুগে ঈসায়ী ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ইবরানী(হিব্রু) ভাষা লিখতে জানতেন এবং আল্লাহ্র তওফীক অনুযায়ী ইবরানী ভাষায় ইঞ্জিল থেকে অনুবাদ করতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বয়োবৃদ্ধ এবং অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। খাদীজা (রা.) তাঁকে বললেন, হে চাচাতো ভাই! আপনার ভাতিজার কথা শুনুন। ’ ওয়ারাকা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাতিজা! তুমি কী দেখ?’ রাসুলুল্লাহ(ﷺ) যা দেখেছিলেন, সবই খুলে বললেন।
তখন ওয়ারাকা তাঁকে বললেন, ইনি সে দূত যাঁকে আল্লাহ্ মূসা(আ.) এর কাছে পাঠিয়েছিলেন। আফসোস! আমি যদি সেদিন যুবক থাকতাম। আফসোস! আমি যদি সেদিন জীবিত থাকতাম, যেদিন তোমার কাওম তোমাকে বের করে দেবে। ’ রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বললেনঃ তাঁরা কি আমাকে বের করে দিবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, অতীতে যিনিই তোমার মত কিছু নিয়ে এসেছেন তাঁর সঙ্গেই শত্রুতা করা হয়েছে। সেদিন যদি আমি থাকি, তবে তোমাকে প্রবলভাবে সাহায্য করব। ’ এর কিছুদিন পর ওয়ারাকা(রা.) ইন্তেকাল করেন। …” [1]
খ্রিষ্টান মিশনারীরা আলোচ্য ঘটনার ব্যাপারে বেশ কিছু অভিযোগ করে। ইসলামকে অপমান করবার মানসে নাস্তিক-মুক্তমনাদেরকেও তাদের পালে হাওয়া দিতে দেখা যায়। অভিযোগগুলো হচ্ছে---
১।
বাইবেলে পুরাতন নিয়মে(Old testament) তাওরাত অংশে [১ম ৫টি বই/Pentateuch] মুসা(আ.) এর কাহিনীর কোথাও জিব্রাঈল(আ.) এর কথা উল্লেখ নেই। বাইবেলে জিব্রাঈল(আ.) এর সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় তাওরাতের শত শত বছর পর লিখিত দানিয়েল(Daniel) পুস্তকে। {দেখুন দানিয়েল ৮:১৫-১৯ এবং দানিয়েল ৯:২১-২৩}। অথচ ওয়ারাকা বিন নাওফাল দাবি করেছিলেন যে মুহাম্মাদ(ﷺ) এর নিকট সেই নামুস বা দূত এসেছিল যিনি মুসা(আ.) এর নিকটেও আসতেন। ইসলাম বিরোধীদের দাবি হচ্ছে—ওয়ারাকা বিন নাওফাল ভুল-ভাল তথ্য দিয়ে নিজ অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। অর্থাৎ নবী(ﷺ)কে প্রথম নবুয়তের সুসংবাদদানকারী ব্যক্তি ভুল তথ্য দিয়ে তাঁকে আশ্বস্ত করেছেন (নাউযুবিল্লাহ)।
২।
তাদের আরেকটি অভিযোগ হচ্ছে-- ওয়ারাকা বিন নাওফাল যেহেতু প্রাচীন কিতাব সম্পর্কে জানতেন, কাজেই তিনিই মুহাম্মাদ(ﷺ)কে শিক্ষা দিতেন এবং এরই আলোকে মুহাম্মাদ(ﷺ) কুরআন ‘লিখতেন’ (নাউযুবিল্লাহ)।
১ নং অভিযোগের জবাবঃ
ওয়ারাকা বিন নাওফাল সম্পর্কে যতটুকু তথ্য জানা যায়, তা থেকে আমরা বলতে পারি যে তিনি Ebionite কিংবা এই জাতীয় কোন খ্রিষ্টান চার্চের অনুসারী ছিলেন।
শুরুতেই আমরা Ebioniteদের ব্যাপারে জেনে নিই। সেই যুগে আরব উপদ্বীপে যে সকল খ্রিষ্টান ফির্কা বা দল(denomination) ছিল, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এই Ebionite দলটি। [2] তৎকালিন শাম অঞ্চল অর্থাৎ বর্তমান বৃহত্তর সিরিয়া-ফিলিস্তিন অঞ্চলে ছিল এদের আধিক্য। [3] তাদের নিজস্ব ইঞ্জিল(Gospel) ছিল যা Ebionite Gospel নামে পরিচিত। এর সাথে অন্য খ্রিষ্টানদের ইঞ্জিলের মিল ছিল না। তারা একে হিব্রু বা ইব্রানী ইঞ্জিল বলত কারণ তা ছিল হিব্রু ভাষায় লিখিত। [4] এই ইঞ্জিলের হদিস বর্তমানে আর পাওয়া যায় না। [5] খ্রিষ্টীয় ১ম শতাব্দী থেকেই এই দলটির অস্তিত্ব ছিল; তারা এক আল্লাহতে বিশ্বাস করত, ঈসা(আ.)কে আল্লাহর শরিক সাব্যস্ত না করে আল্লাহর নবী বলে মানত, ত্রিত্ববাদকে অস্বীকার করত, সাধু পল(Paul)কে ধর্মত্যাগী ও বিশ্বাসঘাতক মনে করত। অন্য খ্রিষ্টানরা যেমন ঈসা(আ.) এর তথাকথিত ক্রুশবিদ্ধ হওয়াকে নাজাতের উপায় হিসাবে মানত সেখানে Ebioniteরা কঠোরভাবে ইহুদিদের আইন-কানুন বা তাওরাতের আইনকে মেনে চলত এবং ঈসা(আ.) এর মৃত্যুকে পাপ থেকে নাজাতের(atonement for sin) উপায় মানতে অস্বীকার করত। [6] পরবর্তীতে এই খ্রিষ্টান দলটির সদস্যরা মুহাম্মাদ(ﷺ)কে সত্য নবী হিসাবে মেনে নেয় এবং ইসলাম গ্রহণ করে। [7]
শুরুতে বুখারীর যে হাদিসটি উল্লেখ করা হয়েছে তাতে বলা আছে যে, “... তিনি(ওয়ারাকা) ইবরানী(হিব্রু) ভাষা লিখতে জানতেন এবং আল্লাহ্র তওফীক অনুযায়ী ইবরানী ভাষায় ইঞ্জিল থেকে অনুবাদ করতেন।“ আমরা উপরে দেখেছি যে Ebionite খ্রিষ্টানদের ইঞ্জিল ছিল হিব্রু বা ইবরানী ভাষায়। Ebionite খ্রিষ্টানরা ছিল একত্ববাদী। সিরাত ইবন হিশামে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ওয়ারাকা বিন নাওফাল ছিলেন চারজন সত্য ধর্ম অনুসন্ধানকারীর একজন যাঁরা সমকালিন আরব পৌত্তলিকদের মূর্তিপুজার বিরোধিতা করতেন। তারা সেই পৌত্তলিক ও বহুঈশ্বরবাদী ধর্ম ত্যাগ করে একত্ববাদী ইব্রাহিমী ধর্মবিশ্বাস অনুসন্ধান করছিলেন। এভাবে অনুসন্ধান করে তিনি ঈসা(আ.) এর দ্বীন গ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন বইপুস্তক অধ্যায়ন করতে থাকেন। [8] কাজেই আমরা বলতে পারি যে ওয়ারাকা বিন নাওফাল Ebionite ছিলেন কিংবা এমন ফির্কার খ্রিষ্টান ছিলেন যারা ছিল একত্ববাদী। [9]
আমরা দেখেছি যে Ebionite খ্রিষ্টানরা কঠোরভাবে তাওরাত অনুসারী ছিল। যেহেতু তারা তাওরাতের আইন মেনে চলত কাজেই স্বাভাবিকভাবেই তাদের প্রয়োজন হত ইহুদিদের পূর্ণ তাওরাত সম্পর্কে জ্ঞান লাভের। ইহুদিদের বিশ্বাস হচ্ছেঃ-- ঈশ্বর মুসা(আ.)কে তাওরাত দান করেছেন। এই তাওরাতের ২টি রূপ আছে; লিখিত ও মৌখিক। ইহুদিদের ‘তানাখ’{খ্রিষ্টানরাও এই কিতাবগুলোতে বিশ্বাস রাখে এবং এগুলো Old Testament হিসাবে বাইবেলে আছে} এর প্রথম ৫টি বই হচ্ছে ‘লিখিত তাওরাত’(written Torah)। আর মুসা(আ.)কে ঈশ্বর যে মৌখিক শিক্ষা দিয়েছেন তা হচ্ছে ‘মৌখিক তাওরাত’(oral Torah)। এই ‘মৌখিক তাওরাত’কে পরবর্তীতে লিপিবদ্ধ করা হয়, যা ‘মিশনাহ’(Mishnah) নামে পরিচিত। অর্থাৎ ‘মৌখিক তাওরাত’ এর লিখিত রূপ হিচ্ছে মিশনাহ। ইহুদি পণ্ডিতগণ মিশনাহ এর বেশ কিছু ব্যাখ্যা লেখেন যা ‘গেমারা’(Gemara) নামে পরিচিত। মিশনাহ ও গেমারাকে একত্রে বলে ‘তালমুদ’(Talmud)। [10]
মূল ধারার খ্রিষ্টানরা তাওরাতের আইন মানেন না এবং তারা ইহুদিদের মৌখিক তাওরাতকে বাইবেলে অন্তর্ভুক্ত করেননি। কিন্তু ওয়ারাকা বিন নাওফালের পক্ষে অবশ্যই মৌখিক তাওরাতের জ্ঞান থাকা সম্ভব ছিল অথবা বলা যায় প্রয়োজন ছিল। কেননা তিনি ছিলেন Ebionite ধারার খ্রিষ্টান। মৌখিক তাওরাতে মুসা(আ.) এবং জিব্রাঈল(আ.) এর ব্যাপারে কী তথ্য আছে? চলুন দেখি।
ইহুদিদের মৌখিক তাওরাতের বিবরণ অনুযায়ী--- নবী মুসা(আ.) এর জীবনে সব থেকে বেশি প্রভাব যাঁদের ছিল তাঁদের একজন হচ্ছেন ফেরেশতা জিব্রাঈল(আ.)। মৌখিক তাওরাতের বিবরণ অনুযায়ী মুসা(আ.) শিশুকাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে জিব্রাঈল(আ.) এর সংস্পর্শে এসেছেন। মুসা(আ.) কে তাঁর মা নীল নদে ভাসিয়ে দিলে সেটি ভাসতে ভাসতে ফিরআউনের প্রাসাদের কাছে চলে আসে। মৌখিক তাওরাত বলছে যে, সে সময় জিব্রাঈল(আ.) শিশু মুসা(আ.)কে খোঁচা দেন যার দরুণ তিনি কেঁদে ওঠেন। আর সেই কান্নার কারণেই ফিরআউনের কন্যার [11] মনে শিশু মুসা(আ.) এর প্রতি দয়ার উদ্রেক ঘটে। [12] এবং তিনি মুসা(আ.)কে তুলে নিয়ে লালনপালন করেন। পরবর্তীতে ফিরআউন শিশু মুসা(আ.) এর বিভিন্ন কর্মকাণ্ড দেখে সন্দেহগ্রস্ত হয়ে পড়ে যে এ কোন অসাধারণ শিশু। জ্যোতিষী তাকে জানায় যে এ হচ্ছে সেই শিশু যে বড় হয়ে তার সাম্রাজ্যের ধ্বংসের কারণ হবে। ফিরআউনের একজন উপদেষ্টা(Balaam) পরামর্শ দেয় শিশু মুসা(আ.)কে হত্যা করতে। এ অবস্থায় তাঁর প্রাণরক্ষার ব্যাবস্থা করেন জিব্রাঈল(আ.)। ফেরেশতা জিব্রাঈল(আ.) ফিরআউনের একজন উপদেষ্টার(Jethro ) ছদ্মবেশ নিয়ে ফিরআউনকে পরামর্শ দেন যে, পরীক্ষা করে দেখা হোক এ আসলেই কোন অসাধারণ শিশু কিনা। সকলেই এ পরামর্শে একমত হয়।
তখন পরীক্ষা করার জন্য একটি অতি উজ্জ্বল স্বর্ণের খণ্ড এবং একটি জ্বলন্ত কয়লার টুকরাকে পাশাপাশি একটা থালায় রেখে মুসা(আ.) এর নিকট আনা হয়। উদ্যেশ্য ছিল এটা দেখা যে শিশুটি কোন জিনিসটা তুলে নেয়। যদি সে অবুঝ শিশু হয় তাহলে অপেক্ষাকৃত বেশি উজ্জ্বল কয়লার টুকরা তুলে নেবে। আর যদি অসাধারণ কোন শিশু হয়, তাহলে বুঝেশুনে স্বর্ণের টুকরাটা তুলে নেবে। এমনটি করলে তাঁকে হত্যা করা হবে।
জিব্রাঈল শিশু মুসা(আ.) এর হাতকে জ্বলন্ত কয়লার টুকরাটির দিকে চালিত করলেন। ফলে তিনি কয়লার টুকরাটি তুলে নেন এবং মুখে দেন। ফলে তাঁর জিহ্বা পুড়ে যায়। এর ফলশ্রুতিতেই তিনি পরবর্তীতে তোতলা হয়ে যান। [13] এতে তিনি আহত হয়েছিলেন, কিন্তু প্রাণ রক্ষা পেয়েছিল। [14]
মৌখিক তাওরাতের অন্যত্র বলা আছে যে, মুসা(আ.) নবুয়ত পাবার পর হারুন(আ.)কে নিয়ে যখন ফিরআউনের নিকট যাচ্ছিলেন, সেখানকার প্রাসাদের প্রতিটি দরজায় প্রহরী ছিল। জিব্রাঈল(আ.) তাঁদেরকে অদৃশ্য হয়ে প্রাসাদের ভেতর প্রবেশ করিয়ে দেন। [15]
মৌখিক তাওরাতের বিবরণ অনুযায়ী মৃত্যুর সময় মুসা(আ.) এর জান কবজ করতে আসেন যেসব ফেরেশতা, তাঁদের মধ্যে জিব্রাঈল(আ.)ও ছিলেন। তিনি সে সময়ে মুসা(আ.) এর বিছানা ঠিক করে দেন। [16]
মুসা(আ.) ও জিব্রাঈল(আ.) সম্পর্কে মৌখিক তাওরাতের সকল বিবরণ ও রেফারেন্স নেওয়া হয়েছে Jewish Encyclopedia থেকে। [17]
আমরা দেখলাম যে ইহুদিদের আইন সংক্রান্ত কিতাবাদীতে বেশ কয়েক জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে যে মুসা(আ.) এর নিকট জিব্রাঈল(আ.) আসতেন। কাজেই ওয়ারাকা বিন নাওফালের এই উক্তিঃ “...ইনি সে দূত [জিব্রাঈল(আ.)] যাঁকে আল্লাহ্ মূসা(আ.) এর কাছে পাঠিয়েছিলেন” সম্পূর্ণ সঠিক একটি উক্তি এবং এর মাঝে ভুলের কিছুই নেই। নিঃসন্দেহে আসমানী কিতাবে অভিজ্ঞ ব্যক্তি ওয়ারাকা বিন নাওফালের পক্ষে মৌখিক তাওরাত এবং মিদরাসে উল্লেখিত মুসা(আ.) ও জিব্রাঈল(আ.) এর ঘটনাগুলো জানা থাকার কথা, Ebonite খ্রিষ্টান পণ্ডিতদের পক্ষে এগুলো জানা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। বরং যে সব খ্রিষ্টান মিশনারীরা এখান থেকে ভুল ধরতে যায়, তাদেরই অজ্ঞতা এর দ্বারা প্রকাশ পাচ্ছে। কেননা ইহুদিদের আইন সংক্রান্ত কিতাবাদীতে মুসা(আ.) এর নিকট জিব্রাঈল(আ.) এর আসার ঘটনাগুলো জানেন না বলেই তারা এমন অভিযোগ করেছেন। না জেনেই তারা দাবি করেন যে দানিয়েলের পুস্তকের আগে কোথাও মুসা(আ.) এর নিকট জিব্রাঈল(আ.) এর আসার উল্লেখ নেই। অথবা এটাও হতে পারে যে খ্রিষ্টান মিশনারীরা এই ঘটনাগুলো জেনেশুনেই ইসলামের প্রতি শত্রুতাবশত এমন অভিযোগ করেন। আল্লাহ তাদেরকে জ্ঞান ও হেদায়েত দান করুন।
২ নং অভিযোগের জবাবঃ
খ্রিষ্টান মিশনারীরা বলতে চায় যে ওয়ারাকা বিন নাওফাল যেহেতু প্রাচীন আসমানী কিতাবে অভিজ্ঞ ছিলেন, কাজেই তিনিই মুহাম্মাদ (ﷺ)কে শিখিয়ে দিতেন যা দ্বারা মুহাম্মাদ (ﷺ) কুরআন ‘রচনা’ করতেন (নাউযুবিল্লাহ)। তাদের সাথে নাস্তিক-মুক্তমনাদেরকেও তাল মেলাতে দেখা যায়।
এটি এমনই একটি মূর্খতাপ্রসূত অভিযোগ যা খুব সহজেই খণ্ডন করা যায়। তাছাড়া এই অভিযোগটি একটি স্ববিরোধী অভিযোগ। এরাই দাবি করে যে ওয়ারাকা বিন নাওফাল মুসা(আ.) এর নিকট জিব্রাঈল(আ.) এর আসবার ব্যাপারে ‘ভুল’(!) তথ্য দিয়ে নিজ অজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন। তারা যখন প্রয়োজন হয় তখন ওয়ারাকা বিন নাওফালকে ‘অজ্ঞ’ প্রমাণ করেন, আবার যখন প্রয়োজন হয় তখন সেই ওয়ারাকা বিন নাওফালকেই আসমানী কিতাবে জ্ঞানী প্রমাণ করতে চা্ন যাতে বলা যায় যে তিনি কুরআন ‘রচনায়’ মুহাম্মাদ(ﷺ)কে সাহায্য করতেন। সত্যিই বড় বিচিত্র কর্মপ্রচেষ্টা ইসলাম বিরোধী এই মানুষগুলোর।
লেখার শুরুতেই মুহাম্মাদ(ﷺ) এর সঙ্গে ওয়ারাকার সাক্ষাতের ঘটনা নিয়ে একটি হাদিস উল্লেখ করা হয়েছিল যার শেষাংশে বলা হয়েছে – “... এর কিছুদিন পর ওয়ারাকা(রা.) ইন্তেকাল করেন। …” [18]
অর্থাৎ মুহাম্মাদ(ﷺ) প্রথম ওহী{সুরা আলাকের ১ম ৫টি আয়াত} লাভের কিছুদিনের মাঝেই ওয়ারাকা ইন্তেকাল করেন। অথচ মুহাম্মাদ(ﷺ) এর নিকট এরপরেও টানা ২৩ বছর কুরআন নাজিল হতে থাকে। ওয়ারাকা তাহলে কী করে মুহাম্মাদ(ﷺ)কে “কুরআন শিক্ষা” দিতেন? মৃত মানুষ কি কাউকে কিছু শেখাতে পারে? !!
আমরা জানি যে বিভিন্ন অবস্থা ও ঘটনার প্রেক্ষিতে কুরআনের আয়াত নাজিল হত। এছাড়াও মুহাম্মাদ(ﷺ) এর নিকট অনেক সময়েই আহলে কিতাব ইহুদিরা বিভিন্ন প্রশ্ন ছুড়ে দিত। ইহুদিরা নিজেরাই বলত যে, সেগুলো এমন প্রশ্ন ছিল যার জবাব একজন নবী ছাড়া কেউ দিতে পারে না।
এমন কিছু ঘটনা নিচে উল্লেখ করছি।
ঘটনা ১:
ইহুদিরা পরীক্ষার্থে রাসুলুল্লাহ(ﷺ)কে বলেছিলঃ যদি আপনি সত্যিই আল্লাহর নবী হন, তবে বলুন ইয়াকুব পরিবার শাম থেকে মিসরে কেন স্থানান্তরিত হয়েছিল এবং ইউসুফ(আ.) এর ঘটনা কী ছিল? প্রত্যুত্তরে ওহীর(সুরা ইউসুফ) মাধ্যমে পূর্ণ কাহিনী অবতারণ করা হয়।...তিনি ছিলেন নিরক্ষর এবং জীবনের প্রথম থেকেই মক্কায় বসবাসকারী।তিনি কারো কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেননি এবং কোন গ্রন্থও পাঠ করেননি।এতদসত্ত্বেও তাওরাতে বর্ণিত আদ্যোপান্ত ঘটনাটি বিশুদ্ধরূপে বর্ণণা করে দেন।বরং এমন কিছু বিষয়ও তিনি বর্ণণা করেন যেগুলো তাওরাতে উল্লেখ ছিল না। [19]
ঘটনা ২:
“...এরপর ইহুদি(আলেম) বলল, আমি আপনাকে (কয়েকটি কথা) জিজ্ঞেস করতে এসেছি। রাসূলুল্লাহ(ﷺ) তাকে বললেন, তোমার কী লাভ হবে, যদি আমি তোমাকে কিছু বলি?
সে বলল, আমি আমার কান পেতে শুনব।
এরপর রাসূলুল্লাহ(ﷺ) তাঁর কাছে যে খড়িটি ছিল তা দিয়ে মাটিতে আঁকাঝোকা দাগ কাটছিলেন। তারপর বললেন, জিজ্ঞেস কর।
ইহুদি বলল, যেদিন এ জমিন ও আকাশমণ্ডলী পাল্টে গিয়ে অন্য জমিন ও আকাশমণ্ডলীতে পরিণত হবে (অর্থাৎ কিয়ামাত হবে) সেদিন লোকজন কোথায় থাকবে?
রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বললেন, তারা সেদিন পুলসিরাতের কাছে অন্ধকারে থাকবে।
সে[ইহুদি আলেম] বলল, কে সর্বপ্রথম (তা পার হবার) অনুমতি লাভ করবে?
তিনি[রাসূলুল্লাহ(ﷺ)] বললেন, দরিদ্র মুহাজিরগণ।
ইহুদি বলল, জান্নাতে যখন তারা প্রবেশ করবে তখন তাদের তোহফা কি হবে?
তিনি বললেন, মাছের কলিজার টুকরা।
সে বলল, এরপর তাদের দুপুরের খাদ্য কি হবে?
তিনি বললেন, তাদের জন্য জান্নাতের ষাঁড় জবাই করা হবে যা জান্নাতের আশেপাশে চড়ে বেড়ায়। সে বলল, এরপরে তাদের পানীয় কি হবে? তিনি বললেন, সেখানকার একটি ঝর্ণার পানি যার নাম সালসাবীল।
সে বলল, আপনি ঠিক বলেছেন।
সে আরো বলল যে, আমি আপনার কাছে এমন একটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে এসেছি যা নবী ছাড়া পৃথিবীর কোন অধিবাসী জানে না অথবা একজন কি দু'জন লোক ছাড়া।
তিনি বললেন, আমি যদি তোমাকে তা বলে দেই তবে তোমার কি কোন উপকার হবে?
সে বলল, আমি আমার কান পেতে শুনব। সে বলল, আমি আপনাকে সন্তান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে এসেছি।
তিনি বললেন, পুরুষের বীর্য সাদা এবং মেয়েলোকের বীর্য হলুদ। যখন উভয়টি একত্রিত হয়ে যায় এবং পুরুষের বীর্য মেয়েলোকের বীর্যের উপর প্রাধান্য লাভ করে তখন আল্লাহর হুকুমে পুত্র সন্তান হয়। আর যখন মেয়েলোকের বীর্য পুরুষের বীর্যের ওপর প্রধান্য লাভ করে তখন আল্লাহর হুকুমে কন্যা সন্তান হয়।
ইহুদি বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন এবং নিশ্চয়ই আপনি একজন নবী।
এরপর সে চলে গেল।
তখন রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বললেন, এ লোক আমার কাছে যা জিজ্ঞেস করেছে, ইতোপূর্বে আমার সে সম্পর্কে কোন জ্ঞানই ছিল না। আল্লাহ তা'আলা এক্ষণে আমাকে তা জানিয়ে দিলেন। [20]
এ রকম আরই অনেক ঘটনা আছে যখন অন্য ধর্মের পণ্ডিতরা নবী(ﷺ)কে বিভিন্ন প্রশ্ন করত এবং তিনি তাৎক্ষণিকভাবে তার সঠিক উত্তর দিতেন। ওয়ারাকা বিন নাওফালই যদি তাঁকে শিখিয়ে দিয়ে থাকতেন (নাউযুবিল্লাহ), তাহলে কী করে মুহাম্মাদ(ﷺ) তাৎক্ষণিকভাবে সেগুলোর উত্তর দিতেন?
সব থেকে বড় কথা এসব ঘটনার বহু আগেই ওয়ারাকা বিন নাওফাল মারা গিয়েছিলেন। কাজেই মুহাম্মাদ(ﷺ)কে সকল কিছু ওয়ারাকা বিন নাওফাল শিখিয়ে দিতেন—এ অভিযোগের আদৌ কোন ভিত্তি নেই।
লেখাটি শেষ করছি ইসলামে ওয়ারাকা বিন নাওফালের মর্যাদা কী তা উল্লেখ করে।
সহীহ হাদিসে উল্লেখ আছে যে ওয়ারাকা বিন নাওফাল একজন জান্নাতী।
আয়িশা(রা.) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেনঃ “তোমরা ওয়ারাকা বিন নাওফালকে মন্দ বলো না কেননা আমি দেখেছি যে তিনি জান্নাতে ১টি বা ২টি উদ্যান লাভ করবেন।” [21]
খাদিজা(রা.) রাসূলুল্লাহ(ﷺ)কে ওয়ারাকা বিন নাওফালের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে নবী(ﷺ) বলেন,
“আমি তাঁকে স্বপ্নে সাদা জামা পরিহিত অবস্থায় দেখেছি। তাঁর জন্য যদি জাহান্নাম নির্ধারিত হত, তাহলে আমি তাঁকে সাদা জামা পরা অবসস্থায় দেখতাম না।” [22]
প্রাচীন আলিমদের মধ্যে ইমাম তাবারী(র.), বাগাওয়ী(র.), ইবন কানী(র.), ইবন সাকান(র.) এবং আরো অনেকের মতে ওয়ারাকা বিন নাওফাল ছিলেন একজন সাহাবী।
বর্তমান যুগের আলিমদের মধ্যে শাইখ মুহাম্মাদ ইবন সালিহ আল উসাইমিন(র.), সালিহ আল ফাওযান(হাফিজাহুল্লাহ) এর মতেও ওয়ারাকা বিন নাওফাল ছিলেন একজন সাহাবী এবং তাঁর নামের শেষে ‘রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু’{আল্লাহ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হোন} পড়া যেতে পারে।
আবার ইবন কাসির(র.), ইমাম যাহাবী(র.), ইবন হাজার(র.) প্রমুখের মতে ওয়ারাকা বিন নাওফাল সাহাবী ছিলেন না। [23]
আল্লাহ আমাদের ওয়ারাকা বিন নাওফালের(রা.) মত সত্য সন্ধানী হবার তৌফিক দিন এবং আমাদের সবাইকে জান্নাতে একত্রিত করুন।
তথ্যসূত্রঃ
[1]. সহীহ বুখারী (ই.ফা.); অধ্যায়ঃ ১ - ওহীর সূচনা; হাদিস নং : ৩
[2]. ▪ “Ebionites - New World Encyclopedia”
http://www.newworldencyclopedia.org/entry/Ebionites#Influence
▪ “Ebionites - Wikipedia▪”””
https://en.wikipedia.org/wiki/Ebionites#Last_days_of_the_Ebionite_sect
[3]. “Ebionites - Dictionary definition of Ebionites _ Encyclopedia.com_ FREE online dictionary”
http://www.encyclopedia.com/environment/encyclopedias-almanacs-transcripts-and-maps/ebionites
[4]. ▪ “Gospel of the Ebionites – Wikipedia”
https://en.wikipedia.org/wiki/Gospel_of_the_Ebionites
▪ “The Gospel of the Ebionites and the Hebrew Gospel - Bible Study - BibleWise”
http://www.biblewise.com/bible_study/apocrypha/gospel-ebionites.php
[5]. “Ebionites - Dictionary definition of Ebionites _ Encyclopedia.com_ FREE online dictionary”
http://www.encyclopedia.com/environment/encyclopedias-almanacs-transcripts-and-maps/ebionites
[6]. ▪ “Ebionite _ religious sect _ Britannica.com”
https://www.britannica.com/topic/Ebionites
▪ “Ebionites - New World Encyclopedia”
http://www.newworldencyclopedia.org/entry/Ebionites#Beliefs_and_practices
[7]. “The Ebionites: True followers of Jesus who converted to Islam”
[8]. ▪ সীরাতুন নবী(সা.) – ইবন হিশাম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০৪-২০৫
▪ The Life of Muhammad By Muḥammad Ḥusayn Haykal; Page – 75
[9]. The Prophet Muhammad: A Role Model for Muslim Minorities By Muhammad Yasin Mazhar Siddiqi Page – 18
[10]. ▪ “Judaism 101_ Torah”
http://www.jewfaq.org/torah.htm
▪ “What is the _Oral Torah__ - Questions & Answers”
http://www.chabad.org/library/article_cdo/aid/812102/jewish/What-is-the-Oral-Torah.htm
▪ “The Oral Law -Talmud & Mishna”
http://www.jewishvirtuallibrary.org/the-oral-law-talmud-and-mishna
▪ আরো দেখুন, ইজহারুল হক - রহমাতুল্লাহ কিরানবী, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩০-১৩৬
[11]. আল কুরআনের বিবরণ অনুযায়ী ফিরআউনের স্ত্রী; সুরা কাসাস ২৮ : ৮-৯ দ্রষ্টব্য
[12]. Ex. R. i. 28
[13]. comp. Ex. iv. 10
[14]. "M. W." l.c.; "D. Y." l.c.; "S. Y." l.c.; Ex. R. i. 31
[15]. Yalḳ., Shemot, 175
[16]. Midr. Peṭirat Mosheh, l.c.; Yalḳ., Deut. 940; Deut. R. xi. 6
[17]. “MOSES - JewishEncyclopedia.com”
http://www.jewishencyclopedia.com/articles/11049-moses
[18]. সহীহ বুখারী (ই.ফা.); অধ্যায়ঃ ১ - ওহীর সূচনা; হাদিস নং : ৩
[19]. তাফসিরে মা’আরিফুল কুরআন, ৫ম খণ্ড, সুরা ইউসুফের তাফসিরের সার-সংক্ষেপ অংশ, পৃষ্ঠা ৩-৪
[20]. সহীহ মুসলিম; ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৬০৭, ইসলামিক সেন্টারঃ ৬২৩
[21]. মুসতাদরাক হাকিম, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৬০৯; ইমাম হাকিম(র.) এর মতে সনদ সহীহ
[22]. ▪ মুসনাদ আহমাদ, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ৬৫;
হাফিজ ইবন কাসির(র.) এর মতে বর্ণনার সনদ হাসান। {আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া; খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ১৯৭}
▪ ওয়ারাকা(রা.) সংক্রান্ত হাদিসগুলো এখান থেকে নেওয়া হয়েছেঃ
“Is Waraqah bin Nawfal considered as one of the Sahabah_ - IslamQA(Hanafi)”
http://islamqa.org/hanafi/askimam/102980
[23]. “Is Waraqah ibn Nawfal (may Allah have mercy on him) regarded as one of the Sahaabah_ - islamqa (Shaykh Muhammad Saalih al-Munajjid)”