আল কুরআনে মহান আল্লাহ কেবল একজন নারীর নাম সরাসরি উল্লেখ করেছেন। তিনি হচ্ছেন মরিয়ম (আ.)। অশ্লীলতা ও ব্যভিচারে পরিপূর্ণ সমাজে থেকেও যিনি পবিত্রতার সাথে বেঁচে থাকতেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁকে পুরষ্কৃত করেছিলেন। কোন পুরুষের স্পর্শ ছাড়াই তিনি জন্ম দিয়েছিলেন ঈসা (আ.)কে। অলৌকিক উপায়ে ঈসা (আ.) এর এই জন্মকে মহান আল্লাহ পুরো মানবজাতির কাছে একটি নিদর্শন হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। [1]
কিন্তু শুধু নারীর মাধ্যমে সৃষ্টির ব্যাপারটা তো মানুষ সহজে মেনে নিতে পারে না। তাই মরিয়ম(আ.) এর উপর অপবাদ দেয়া শুরু হলো।
কুরআনুল কারিমে বলা হয়েছেঃ
অর্থঃ তারপর সে[মরিয়ম(আ.)] তাঁকে[ঈসা(আ.)] কোলে নিয়ে নিজ সম্প্রদায়ের নিকট এলো। তারা বলল, “হে মরিয়ম! তুমি তো এক অদ্ভুত কাণ্ড করেছো! হে হারুনের বোন! তোমার বাবা তো খারাপ লোক ছিল না। আর তোমার মা-ও ছিল না ব্যভিচারিণী’। ” [2]
খ্রিষ্টান মিশনারী ও নাস্তিক-মুক্তমনারা অভিযোগ করে যে—কুরআনে বর্ণিত ঐতিহাসিক তথ্যগুলোতে ভুল আছে[নাউযুবিল্লাহ]। তাদের দাবিঃ সুরা মারইয়ামের ২৮নং আয়াতে ঈসা(আ.) এর মা মরিয়ম(আ.)কে “হে হারুনের বোন” বলে সম্বোধন করা হয়েছে। বাইবেলে বর্ণিত আছে যে মুসা(আ.) ও হারুন(আ.) এর বোনের নামও মরিয়ম।[3] কাজেই কুরআনে এই দুই মরিয়মকে মিলিয়ে ফেলা হয়েছে এবং ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে[নাউযুবিল্লাহ]।
এই প্রশ্ন নবী(ﷺ) এর যুগের খ্রিষ্টানরাও তুলতো। এবং স্বয়ং নবী(ﷺ) এর উত্তর দিয়ে গেছেন।
“মুগীরা বিন শুবা (রা) থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ(ﷺ) আমাকে নাজরানের দিকে পাঠান। তারা আমাকে বলল, ‘তোমরা কি কুরআনে এ বাক্য পড় না— يَاأُخْتَ هَارُونَ [“হে হারুনের বোন”; সুরা মারইয়ামের ২৮নং আয়াত] ?
অথচ মুসা ও ঈসার মাঝে কত কালের ব্যবধান ?’
আমি তাদের এ প্রশ্নের কী উত্তর দেব জানতাম না। তাই নবী(ﷺ)-এর কাছে ফিরে এসে তাঁকে এ কথা জানালাম।
তিনি বললেনঃ ‘তুমি কি তাদেরকে এ সংবাদ দিতে পারলে না যে, তারা পূর্ববর্তী নবী ও পূণ্যবান লোকদের নামে তাদের নাম রাখত।‘ ” [4]
অর্থাৎ মরিয়ম(আ.)কে “হারুনের বোন” বলার অর্থ এই নয় যে তিনি মুসা(আ.) এর সময়কার মানুষ হারুন(আ.) এর বোন। সে যুগে বনী ইস্রাঈলের লোকজন নবী-রাসুল ও পূণ্যবান মানুষের নামে সন্তানদের নামকরণ করত। কাজেই হারুন নামে অনেক মানুষ ছিল।
এরপরেও যদি খ্রিষ্টান মিশনারীরা তাদের এই ভ্রান্ত যুক্তি দেখানো চালিয়ে যেতে চায়, তাহলে আমরা বলব— বাইবেলে বর্ণিত হয়েছে যে মরিয়মের স্বামীর [5] নাম ইউসুফ(Joseph)।[6] এই ইউসুফের বাবার নাম ইয়াকুব।[7] আবার, নবী ইউসুফ(আ.) [prophet Joseph] এর বাবার নামও ছিল ইয়াকুব(আ.) [prophet Jacob]। [8] অথচ নবী ইউসুফ(আ.) বাস করতেন মরিয়মের হাজার বছর পূর্বে। নবী ইউসুফ(আ.) ছিলেন ইয়াকুব(আ.)[ইস্রাঈল] এর ১২ পুত্রের একজন; যেই ১২ পুত্রের বংশধররা বনী ইস্রাঈলের ১২ জাতি। মরিয়ম(আ.) ও তাঁর পরিবারবর্গ সবাই এই বনী ইস্রাঈল বংশের মানুষ।
এখানে দেখা যাচ্ছে যে, হাজার বছর সময়কালের ব্যবধানে বাস করা ২ জন আলাদা মানুষের নাম ইউসুফ, আবার উভয়েরই বাবার নাম ইয়াকুব।
বাইবেল লেখকেরা কি তাহলে মরিয়মের স্বামীর সাথে নবী ইউসুফ(আ.)কে মিলিয়ে ফেলেছে?
খ্রিষ্টান মিশনারীরা এর জবাবে অবশ্যই বলবেন—আরে এই ইউসুফ তো সেই ইউসুফ না। সেকালে বনী ইস্রাঈলের লোকজন নবীদের নামে নিজেদের নাম রাখত। মাতা মেরী বা মরিয়মের স্বামীর নাম নবী ইউসুফের নামানুসারে রাখা হয়েছে ... ইত্যাদি ইত্যাদি। [নাস্তিক-মুক্তমনারাও কোনকালে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না।]
এ কথা বলা ছাড়া আসলে তাদের আর কোন উপায় নেই।
খ্রিষ্টান প্রচারক ও নাস্তিক-মুক্তমনাদের তাই বলি— দ্বিমুখী নীতি পরিহার করুন।
সেই সাথে মুসলিমদেরও উচিত এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া এবং এমন প্রশ্নের সম্মুখিন হলে দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া। যিনি আসমান ও জমীনের প্রভু, তিনি মানবজাতির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছুর ব্যাপারেই সম্যক অবহিত। তাঁর কিতাবে অবশ্যই কোন ঐতিহাসিক ভুল থাকতে পারে না। যে কোন ভুল থেকে মহান আল্লাহ তা’আলা ঊর্ধ্বে।
“তারা যা বলে তা হতে আল্লাহ পবিত্র, মহান।”[9]
তথ্যসূত্রঃ
[2]আল কুরআন, মারইয়াম ১৯:২৭-২৮
[3]বাইবেল, যাত্রাপুস্তক(Exodus) ১৫:২০ দ্রষ্টব্য
[4]তিরমিযী, অধ্যায় ৪৭(কুরআন তাফসির অধ্যায়), হাদিস ৩১৫৫; সহীহ(দারুস সালাম); সহীহ মুসলিমেও অনুরূপ হাদিস বর্ণিত আছে
[5]আল কুরআনে মরিয়মের(আ.) কোন স্বামীর কথা বলা নেই
[6]বাইবেল, মথি(Matthew) ১:১৬ ও লুক(Luke) ২:৫ দ্রষ্টব্য
[7]বাইবেল, মথি ১:১৫-১৬ দ্রষ্টব্য
[8]বাইবেল, আদিপুস্তক(পয়দায়েশ/Genesis) ৩৭:২; ১ বংশাবলী(১ খান্দাননামা/1 Chronicles) ২:২ দ্রষ্টব্য
[9]আল কুরআন, আস-সাফফাত ৩৭:১৫৯