Pray for the world economy

কুষ্ঠরোগ ও ধবল কি বুধবার দিনে বা রাতেই শুরু হয়?

 

ইবনু উমার (রা) হতে হিজামাহর ব্যাপারে একটি হাদিস বর্ণিত আছে, উক্ত হাদিসে বলা হয়েছে যে কুষ্ঠরোগ ও ধবল বুধবার দিনে বা রাতেই শুরু হয়।

 

হাদিসটি নিম্নরূপ,

 

ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হে নাফে! আমার রক্তে উচ্ছাস দেখা দিয়েছে (রক্তচাপ বেড়েছে)। অতএব আমার জন্য একজন রক্তমোক্ষণকারী খুঁজে আনো, আর সম্ভব হলে সদাশয় কাউকে আনবে। বৃদ্ধ বা বালককে আনবে না। কারণ, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছিঃ বাসি মুখে রক্তমোক্ষণ করালে তাতে নিরাময় ও বরকত লাভ হয় এবং তাতে জ্ঞান ও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়। অতএব আল্লাহর বরকত লাভে ধন্য হতে তোমরা বৃহস্পতিবার রক্তমোক্ষণ করাও, কিন্তু বুধ, শুক্র, শনি ও রবিবারকে রক্তমোক্ষণ করানোর জন্য বেছে নেয়া থেকে বিরত থাকো। সোম ও মঙ্গলবারে রক্তমোক্ষণ করাও, কেননা এ দিনই আল্লাহ আইউব (আ) -কে রোগমুক্তি দান করেন এবং বুধবার তাকে রোগাক্রান্ত করেন। আর কুষ্ঠরোগ ও ধবল বুধবার দিনে বা রাতেই শুরু হয়।

[সুনান ইবনু মাজাহ ৩৪৮৭]

[ https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=44451 ]

 

অনেক ইসলামবিরোধী এই হাদিসকে দেখিয়ে দাবি করতে চায় কুষ্ঠ ও ধবল রোগ বুধবার শুধুমাত্র বুধবার দিন ও রাতে শুরু হবার কথাটির মাঝে বৈজ্ঞানিক ভুল আছে। কেননা আধুনিক বিজ্ঞান বলে ছোঁয়াচে রোগ সপ্তাহের যে কোনো দিনে হতে পারে।  

 

হাদিসের সনদ বিশ্লেষণঃ

 

এই হাদিসটি অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে। এবং হাদিসটির মতনেরও অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন কমবেশি পার্থক্যবিশিষ্ট সংস্করণ বা রূপ আছে। রেওয়ায়েতভেদে এই হাদিসটির সনদে এবং মতনে কম বা বেশি পার্থক্য বিদ্যমান। আমি এখানে শুধুমাত্র একটা রেওয়ায়েত উল্লেখ করেছি সুনানু ইবনে মাজাহ থেকে।

 

ইমাম মালিক, ইবনু মাহদী, আবু যুরয়াহ, ইমাম আল-বোখারী, আবু হাতিম আর-রাযী, আল-উকাইলী, আন-নববী, ইবনুল যাওযি, আয-যাহাবী, ইবনু হাজার, আল-আরনাওত, আল-আযামী সহ অধিকাংশ উলামাদের দৃষ্টিতেই আলোচ্য হাদিসটি যইফ।

 

নিম্নে অতি সংক্ষিপ্তভাবে হাদিসটির তাহকিক উপস্থাপন করা হলো,

 

ইবনু উমার (রা) হতে হাদিসটির মোট দুইটি চুড়ান্ত সুত্র রয়েছে। একটি হচ্ছে নাফির সুত্র এবং অপরটি হচ্ছে আবু কিলাবাহর সুত্র।

 

নাফির সুত্রটির আবার অনেকগুলো উপসুত্র রয়েছে। সেগুলো নিম্নে বর্ণনা করা হলো।

 

এক.

আব্দুল্লাহ বিন সালিহ আল-মাসরী এর সুত্রে আত্তাফ বিন খালিদ হতে, তিনি নাফি হতে।

 

দুই.

মুহাম্মদ বিন জুহাদাহ এর সুত্রে সরাসরি নাফি হতে। এই দ্বিতীয় উপসুত্রটির আবার মোট তিনটি উপ-উপসুত্র রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে,

 

(ক) গাযযাল বা আযযাল বিন মুহাম্মদ এর সুত্রে মুহাম্মদ বিন জুহাদাহ হতে।

(খ) উসমান বিন মাতার এর সুত্র ধরে আল-হাসান বিন আবি-জাফর হতে, তিনি মুহাম্মদ বিন জুহাদাহ হতে।

(গ) আব্দুল মালিক বিন আব্দু রাব্বিহ এর সুত্র ধরে আবু আলি উসমান বিন জাফার হতে, তিনি মুহাম্মদ বিন জুহাদাহ হতে।

 

তিন.

উসমান বিন আব্দুর রহমান এর সুত্রে আব্দুল্লাহ বিন উসমাহ হতে, তিনি সাইদ বিন মাইমুন হতে, তিনি নাফি হতে।

 

চার.

আব্দুল্লাহ বিন হিশাম আদ-দাস্তাওয়াই এর সুত্রে তার পিতা হিশাম হতে, তিনি আইয়ুব আস-সাখতিয়ানি হতে, তিনি নাফে হতে।

 

পাঁচ.

যাকারিয়া বিন ইয়াহইয়া আল-ওয়াক্কার এর সুত্রে মুহাম্মদ বিন ইসমাইল আল-মুরাদী হতে, তিনি ইসমাইল আল-মুরাদী হতে, তিনি নাফি হতে।

 

পক্ষান্তরে আবু কিলাবাহর সুত্রটির জন্য কোনো উপসুত্র নেই। আবু কিলাবাহর সুত্রটি নিম্নরূপ,

 

আবু আব্দুর রহমান আব্দুল্লাহ বিন ইয়াযিদ আল-মুকরী এর সুত্রে ইসমাইল বিন ইব্রাহিম হতে, তিনি আল-মুছান্না বিন উমার হতে, তিনি আবু সিনান হতে, তিনি আবু কিলাবাহ হতে, তিনি ইবনু উমার (রা) হতে।

 

এবার এইসব সুত্রের দুর্বলতা বর্ণনা করা যাক,

 

জুমহুর উলামাদের মতে আব্দুল্লাহ বিন সালিহ একজন যইফ রাবি। আত্তাফ বিন খালিদের ব্যাপারে মতভেদ আছে, যদি ধরে নেই যে আত্তাফ নির্ভরযোগ্য তবুও এক্ষেত্রে সমস্যা থেকেই যায়, কেননা ইবনু হিব্বান বলেছেন যে নাফি হতে হাদিস বর্ণনা করার ক্ষেত্রে আত্তাফের স্মরণশক্তি বাজে ছিলো। সুতরাং নাফির সুত্রের প্রথম উপসুত্রটি যইফ।

 

গাযযাল বা আযযাল বিন মুহাম্মদের ব্যাপারে আস-সুলাইমানী বলেছেন যে সে হাদিস জাল করে, অন্যান্য মুহাদ্দিসরা তাকে মাজহুল বলেছেন। তা ছাড়া আয-যাহাবির একটি বক্তব্য হতে স্পষ্ট হয় যে গাযযাল/আযযাল সাধারণভাবে মাজহুল হলেও নির্দিষ্টভাবে শুধুমাত্র আলোচ্য হাদিসটির ক্ষেত্রে সে মুনকারুল হাদিস।

 

উসমান বিন মাতার এর ব্যাপারে আল-হাকিম, আল-উকাইলী, আবু হাতিম এবং আল-বোখারী বলেছেন যে সে মুনকারুল হাদিস। ইবনু হিব্বান বলেছেন যে সে নির্ভরযোগ্যদের থেকে জাল হাদিস বর্ণনা করে। ইবনুল মাদিনী বলেছেন যে সে যইফুন জিদ্দান। সালিহ জাযরাহ বলেছেন যে তার হাদিস লেখা যাবে না, এবং ইবনু মুয়াইন বলেছেন যে সে প্রচণ্ড যইফ ও তার হাদিস লেখা যাবে না। এবং বাকি মুহাদ্দিসরা তাকে যইফুল হাদিস বলেছেন। [1] আল-হাসান বিন আবি জাফার এর ব্যাপারে আবু-নুয়াইম, আস-সাজী, আল-ফালাস এবং আল-বোখারী বলেছেন যে তিনি মুনকারুল হাদিস। আন-নাসাঈ বলেছেন যে তিনি মাতরুকুল হাদিস। এবং ইবনু মুয়াইন বলেছেন যে তিনি কিছুই না। এবং বাকিরা তাকে যইফ বলেছেন। [2]

 

উসমান বিন জাফর রাবি হিসেবে মাজহুল। এবং আব্দুল মালিক বিন আব্দু রাব্বিহ এর ব্যাপারে আয-যাহাবী বলেছেন যে সে মুনকারুল হাদিস।

 

সুতরাং নাফির সুত্রের দ্বিতীয় উপসুত্রের সবগুলো উপ-উপসুত্রই যইফুন জিদ্দান। যার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, নাফির সুত্রের দ্বিতীয় উপসুত্রটি নিজেও যইফুন জিদ্দান।

 

উসমান বিন আব্দুর রহমান, আব্দুল্লাহ বিন উসমাহ এবং সাঈদ বিন মাইমুন, এই তিনজনের প্রত্যেকেই রাবি হিসেবে মাজহুল। সুতরাং নাফির সুত্রের তৃতীয় উপসুত্রটি যইফুন জিদ্দান।

 

আব্দুল্লাহ বিন হিশাম এর ব্যাপারে আবু হাতিম আর-রাযী এবং আয-যাহাবী বলেছেন যে সে মাতরুকুল হাদিস। সুতরাং নাফির সুত্রের চতুর্থ উপসুত্রটি যইফুন জিদ্দান।

 

মুহাম্মদ বিন ইসমাইল আল-মুরাদী ও তার পিতা ইসমাইল আল-মুরাদী, এনাদের উভয়েই রাবি হিসেবে মাজহুল ; অপরদিকে যাকারিয়া আল-ওয়াক্কার একজন হাদিস জালকারী মিথ্যুক। সুতরাং নাফির সুত্রের পঞ্চম সনদটি বাতিল।

 

আল-মুছান্না বিন উমার এবং ইসমাঈল বিন ইব্রাহিম রাবি হিসেবে মাজহুল, আবু সিনান হতে আল-মুছান্নার বর্ণিত বর্ণনাগুলো নির্ভরযোগ্য নয়। এবং আবু কিলাবাহর সুত্রে বর্ণিত হওয়া রেওয়ায়েতটি সম্পর্কে আবু হাতিম আর-রাযি বলেছেন যে "এই হাদিসটি কিছুই না", যার অর্থ হচ্ছে এই যে আবু কিলাবাহর সুত্রে বর্ণিত আলোচ্য হাদিসটি প্রচণ্ড মাত্রায় যইফ।

 

আমি এখানে তথ্যসুত্র ও দলিল-প্রমাণ উল্লেখ্য না করেই অতি সংক্ষেপে আলোচ্য হাদিসটির সংক্ষিপ্ত তাহকিক উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি। কেউ যদি উক্ত হাদিসটির যইফ হওয়ার ব্যাপারে আরো বিস্তারিতভাবে, আরো সুবিন্যাস্তভাবে, আরো সুস্পষ্টভাবে এবং দলিল-প্রমাণ সহ জানতে ইচ্ছুক হয়ে থাকেন, তাহলে নিম্নে উল্লেখিত এই রেফারেন্সগুলো দেখে নিন,

 

১. আশ-শায়খ আল-আরনাওত কর্তৃক তাহকিককৃত "সুনানু ইবনে মাজাহ" গ্রন্থের ৪র্থ খণ্ডের পৃষ্ঠা নম্বর 530 এর টিকা নং 1 এবং পৃষ্ঠা নম্বর 531 এর টিকা নং 1।

 

২.  আশ-শায়খ নাবিল বিন মানসুর আল-কুয়েতী কর্তৃক রচিত গ্রন্থ "আনিসুস সারি" এর ১১তম খণ্ডের পৃষ্ঠা নম্বর 1215 থেকে 1218 পর্যন্ত।

 

৩.  ডক্টর সামির বিন সুলাইমান আল-ইমরান কর্তৃক তাহকিককৃত ইবনু হাজার (রহ) এর গ্রন্থ "আল-মাতালিবুল আলিয়াহ" এর ১১তম খণ্ডের পৃষ্ঠা নম্বর 253 থেকে 258 পর্যন্ত।

 

৪.  ডক্টর দ্বিয়াউর রহমান আল-আ'যামী কর্তৃক রচিত গ্রন্থ "আল-জামিউল কামিল" এর ৯ম খণ্ডের পৃষ্ঠা নম্বর 785 থেকে 786 পর্যন্ত।

 

৫.  আশ-শায়খ মুহাম্মদ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ এর এই লেখাটি,

"শিঙ্গা লাগানোর সময় নির্ধারণ সংক্রান্ত কোন হাদিস সহিহ নয়"

https://islamqa.info/bn/128170

অথবা https://archive.is/wip/Km0eM (আর্কাইভকৃত)

 

৬.  ইসলামওয়েব এর এই লেখাটি

শিরোনাম : "لا تخصيص للحجامة بيوم معين"

https://www.islamweb.net/ar/fatwa/46772

অথবা https://archive.is/wip/mdxH6 (আর্কাইভকৃত)

 

কাজেই উপসংহারে বলতে পারি,  যদিও কোনো কোনো উলামা একে হাসান বলেছেন, কিন্তু সঠিক কথা হচ্ছে এই সংক্রান্ত হাদিস মূলত প্রচণ্ড মাত্রায় যঈফ (দুর্বল)। তা দলিলযোগ্য নয়। অতএব এমন সনদের হাদিসের তথ্য নবী() এর বক্তব্য হিসেবে বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়।

 

উলামাগণের ব্যাখ্যাঃ

 

আমরা যদি তর্কের খাতিরে আলোচ্য হাদিসকে সহীহ হিসেবেও ধরে নিই, তাহলেও ইসলামবিরোধীদের অভিযোগ প্রমাণিত হয় না, আলোচ্য হাদিস থেকে ‘বৈজ্ঞানিক ভুল’ পাওয়া যায় না। আলোচ্য হাদিসটির "কুষ্ঠরোগ ও ধবল  বুধবার দিনে বা রাতেই শুরু হয় " অংশটিকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করারও সুযোগ আছে।

 

যেমন,

 

শায়খ মুহাম্মদ আল-আমিন আল-হারারী আলোচ্য হাদিসের উক্ত অংশটির ব্যাখ্যায় বলেছেন যেঃ এখানে সাধারণত যা হয় সেটা বলা হয়েছে। [3] অর্থাৎ হাদিসটিতে বোঝানো হচ্ছে যে "সাধারণত" কুষ্ঠরোগ ও ধবল বুধবার দিনে বা রাতেই শুরু হয়। এর মানে এই না যে, বুধবার ব্যাতিত অন্য কোনোদিন কুষ্ঠরোগ ও ধবল শুরু হতে পারে না ; বরং কুষ্ঠরোগ ও ধবল বুধবার ব্যাতিত অন্য কোনো দিনেও শুরু হতে পারে, কিন্ত সাধারণত এমনটা হয় না, সাধারণত তা বুধবার দিনে বা রাতেই শুরু হয়।

 

আমরা জানি যে সর্দি-কাশিজাতীয় ঠাণ্ডাজনিত অসুস্থতাগুলো সাধারণত শীতকালে হয়ে থাকে, তবে এর মানে এই না যে তা অন্য কোনো কালে হতে পারে না, বরং তা অন্য কোনো কালেও হতে পারে। এক্ষেত্রে ব্যাপারটা অনেকটা এমনই।

 

অপরদিকে, আল-আমির মুহাম্মদ বিন ইসমাঈল আস-সানয়ানী আলোচ্য হাদিসের উক্ত অংশটির ব্যাখ্যায় বলেছেন যেঃ  এখানে শুরু হওয়া বলতে দেহে অবতীর্ণ হওয়া উদ্দেশ্য। [4] অর্থাৎ বুধবার দিনে বা রাত্রেই একজনের দেহে কুষ্ঠরোগ বা ধবল এর আগমন ঘটে। এখন কুষ্ঠরোগ বা ধবল দেহে আসার সাথে সাথেই এদের লক্ষণ প্রকাশিত হয়ে যাবে, এমন কোনো কথা নেই। বরং এমনটাও হতে পারে যে একজনের দেহে বুধবার দিনে বা রাত্রে কুষ্ঠরোগ বা ধবল এর আগমন ঘটল, অতপর বুধবার ব্যাতিত অন্য কোনো দিনে লক্ষণ প্রকাশিত হলো এবং তার কুষ্ঠরোগ বা ধবল ধরা পড়ল।

 

 

 

তথ্যসূত্রঃ


[3] আল-হারারী, মুরশিদু যাওইল হাজা ওয়াল হাজাহ (20/315)

[4] আস-সানয়ানী, আত-তানওইর শারহুল জামিইস সাগির (5/402-403)