Pray for the world economy

নবী ﷺ কি কোলের শিশুর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাকে বিয়ে করার আশা প্রকাশ করেছিলেন?

 

ইসলামবিরোধীরা দাবি করে, যে রাসুল () এক কোলের শিশুকে দেখে উক্ত শিশুর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, ও তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। নাস্তিকদের জনপ্রিয় একটি ব্লগে দাবি করা হয়েছেঃ

 

হামাগুড়ি দেয়া কচি শিশু দেখেও মুহাম্মদের তাকে বিবাহ করার ইচ্ছা হয়েছিল। মানে, হামাগুড়ি দেয়া শিশু দেখলেও উনার মনে বিবাহের ইচ্ছা জাগতো। যার রেফারেন্স পাওয়া যায় ইবনে ইসহাকের গ্রন্থে।

 

তাদের এই দাবির পক্ষে তারা ইবনু ইসহাক্ব হতে একটি বর্ণনা উল্লেখ করে থাকে, অনেকসময় তারা Alfred Guillaume কর্তৃক রচিত ইবনু হিশামের সিরাতগ্রন্থের ইংরেজী অনুবাদগ্রন্থ "The Life Of Muhammad" থেকে বর্ণনাটি উল্লেখ করে।

 

তারা যেই বর্ণনাটির উপর ভিত্তি করে এমনটা দাবি করে, সেই বর্ণনাটি নিম্নরূপ,

 

عن عبد اللّٰه بن عباس عن أم الفضل بنت الحارث أن رسول اللٌّه صلی اللّٰه عليه وسلم رأی أم حبيب بنت عباس و هي فوق الفطيم ، قالت فقال "لئن بلغت بنية العباس هذه و أنا حي ، لأتزوجنها " [1]

 

অর্থঃ "আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস উম্মে ফজল বিনতে হারেস থেকে বর্ণনা করেন : রাসূলুল্লাহ() আব্বাসের ‘দুগ্ধপোষ্য (বা হামাগুড়ি দেয় এমন) শিশুকে দেখে বলেন, যদি আব্বাসের মেয়ে বালেগা (প্রাপ্তবয়স্ক) হয় আর আমি ততদিন বেঁচে থাকি তাহলে অবশ্যই আমি তাকে বিয়ে করব।"

 

প্রথমতঃ

এই বর্ণনায় দেখা যাচ্ছে নবী() মোটেও কোনো কোলের শিশুকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন না বরং সে বড় হবার পর তাকে বিয়ে করতে চেয়েছেন। যারা এই বর্ণনা দেখিয়ে দাবি করতে চায় নবী() “হামাগুড়ি দেয়া কচি শিশু বিয়ে করতে চাইতেন” – তারা সত্যের অপলাপ করে।

 

দ্বিতীয়তঃ

এই বর্ণনাটি অপ্রামাণ্য, অনির্ভরযোগ্য, যইফ। এই বর্ণনাটি প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।

 

কেন ও কিভাবে যইফ, এবার সেই আলোচনায় আসছি।

 

এই বর্ণনাটির চুড়ান্ত সুত্রের একজন রাবী হলেন,

 

"আবু আব্দুল্লাহ আলহুসাইন বিন আব্দুল্লাহ বিন উবাইদুল্লাহ ইবনুল আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব আল-মাদানী আল-ক্বুরেশী আল-হাশিমী।"

 

উপর্যুক্ত এই রাবীটির ব্যাপারে মুহাদ্দিসদের অবস্থান নিম্নে উল্লেখ করা হল। [2]

 

আলোচ্য রাবী আবু আব্দুল্লাহ আল-হুসাইন সম্পর্কে,

 

১. আবু আহমদ আল-হাকিম বলেছেন যে সে মুহাদ্দিসদের নিকট শক্তিশালী নয়।

২. আবু বাশার আদ-দাওলাবী বলেছেন যে তার হাদিসগুলো অত্যন্ত মুনকার কাজেই তা লেখা যাবে না।

৩. আবু বকর আল-বায়হাক্বী বলেছেন যে সে যইফ।

৪. আবু জাফর আল-উক্বাইলী বলেছেন যে তার হাদিস হাদিসই নয় এবং তার দ্বারা মুতাবায়াত করা যাবে না।

৫. আবু হাতিম আর-রাযী বলেছেন যে সে যইফুল হাদিস, তার হাদিস লেখা হবে, কিন্ত তার বর্ণনা দ্বারা ইহতিজাজ (প্রমাণ উপস্থাপন) করা যাবে না।

৬. ইবনু হিব্বান আল-বুস্তী বলেছেন যে সে সনদগুলো বিকৃত করে ফেলে এবং মুরসালসমূহকে মারফু বানিয়ে ফেলে।

৭. আবু যুরয়াহ আর-রাযী বলেছেন যে সে শক্তিশালী নয়।

৮. আহমাদ বিন হাম্বল তাকে ত্যাগ করেছেন এবং বলেছেন যে তার মধ্যে বহু মুনকার বিষয় রয়েছে।

৯. আহমদ বিন শুয়াঈব আন-নাসাঈ বলেছেন যে সে মাতরুকুল হাদিস।

১০. ইব্রাহিম বিন ইয়াকুব আজ-জাওযজানী বলেছেন যে তার হাদিস দ্বারা কিছু করা যাবে না।

১১. ইবনু হাজার আল-আসক্বালানী বলেছেন যে সে যইফ।

১২. আয-যাহাবী বলেছেন যে মুহাদ্দিসগণ তাকে যইফ সাব্যস্ত করেছেন।

১৩. সালিহ বিন আলি আন-নওফেলী বলেছেন যে সে যিন্দিক হওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত ছিল।

১৪. আলি ইবনুল মাদিনী বলেছেন যে সে যইফ, কিছুই না, আমি তার হাদিস ত্যাগ করেছি।

১৫. আবু হাফস উমার ইবনু শাহিন তাকে যইফ হিসেবে গণ্য করেছেন। [3]

১৬. আব্দুল আযিম আল-মুনযিরী বলেছেন যে তার হাদিস দ্বারা ইহতিজাজ করা যাবে না। [4]

১৭. ইবনু কাইয়িমিল যাওযিয়াহ বলেছেন যে সে যইফ। [5]

১৮. নুরুদ্দিন আল-হাইছামী বলেছেন যে সে মাতরুক। [6]

১৯. আবুল ফারাজ ইবনুল যাওযি তাকে যইফ হিসেবে গণ্য করেছেন। [7]

২০. আবুল আব্বাস শিহাবুদ্দিন আল-বাওসিরী তাকে যইফ হিসেবে গণ্য করেছেন। [8]

২১. আবুল ফাদ্বাল ইবনুল ক্বাইসারানী বলেছেন যে সে খুবই যইফ। [9]

২২. আদ্ব-দ্বারাক্বুত্বনী বলেছেন যে সে শক্তিশালী নয়। [10]

২৩. মুহাম্মদ বিন ইসমাঈল আল-বুখারী তাকে যইফ হিসেবে গণ্য করেছেন। [11]

২৪. আবুল খাত্তাব ইবনু দাহিয়াহ আল-কালবী তাকে যইফ হিসেবে গণ্য করেছেন। [12]

২৫. বদরুদ্দিন আল-আঈনী বলেছেন যে এই হুসাইনের হাদিস দ্বারা ইহতিজাজ করা যাবে না। [13]

২৬. সিরাজুদ্দিন ইবনুল মুলাক্কিন বলেছেন যে সে মাতরুক। [14]

২৭. আব্দুল হুক্ব ইবনুল খাররাত্ব আল-ইশবিলী বলেছেন যে সে যইফ। [15]

২৮. নুরুদ্দিন আবুল-হাসান মুহাম্মদ বিন আব্দুল হাদী আস-সিনদী আলোচ্য রাবীটিকে যইফ হিসেবে গণ্য করেছেন। [16]

২৯. আবু উমার ইউসুফ ইবনু আব্দিল বার বলেছেন যে সে যইফ মাতরুক। [17]

৩০. মুহাম্মদ বিন আলী আশ-শাওক্বানী আলোচ্য রাবীটিকে যইফ হিসেবে গণ্য করেছেন । [18]

৩১. আবু বকর আল-বায়হাক্বী বলেছেন যে : অধিকাংশ মুহাদ্দিসরাই 'আবু আব্দুল্লাহ আল হুসাইন বিন আব্দুল্লাহ আল-হাশিমী 'কে "যইফ" সাব্যস্ত করেছেন। [19]

 

সুতরাং রাবী 'আবু আব্দুল্লাহ আলহুসাইন বিন আব্দুল্লাহ বিন উবাইদুল্লাহ ইবনুল আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব আল-মাদানী আল-হাশিমী' হাদিস বর্ণনা করার ক্ষেত্রে "যইফ।" আলোচ্য হাদিসটির জন্য এমন কোনো সনদ নেই যেই সনদে আলোচিত রাবী আবু আব্দুল্লাহ আলহুসাইন রাবী হিসেবে বিদ্যমান নেই, আলোচ্য হাদিসটির সবগুলো সনদ এসে আলোচিত রাবী আবু আব্দুল্লাহ আলহুসাইন পর্যন্ত মিলিত হয়েছে।

 

অর্থাৎ উপর্যুক্ত আলোচ্য হাদিসটি সনদ এবং মতন উভয় দিক দিয়েই "যইফ।"

 

আর এটা তো একদম জানা কথা যে যইফ হাদিস প্রমাণ বা নির্ভরযোগ্য কিছু হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য নয়। কাজেই এই হাদিসটির উপর ভিত্তি করে কোনো কিছু দাবি করা যাবে না।

 

তাছারা বহু মুহাক্কিকও আলোচ্য হাদিসটির সনদকে সনদে রাবী হিসেবে বিদ্যমান থাকা আলোচিত রাবী 'আবু আব্দুল্লাহ আল হুসাইন বিন আব্দুল্লাহ বিন উবাইদুল্লাহ ইবনুল আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব আল-হাশিমী আল-মাদানী' এর কারণে "যইফ" বলেছেন।

 

উদাহরণস্বরূপ :

 

আলোচ্য হাদিসটি সম্পর্কে,

 

শুয়াঈব আল-আরনাওত, মুহাম্মদ নুয়াঈম আল-ঈরক্বসুসী, ইব্রাহিম আয-যাইবাক্ব এবং মুহাম্মদ আনাস আলখান সম্মিলিতভাবে বলেছেন যে

 

إسناده ضعيف ، حسين بن عبد الله ضعيف [20]

অর্থ: “হাদিসটির সনদ যইফ, হুসাইন বিন আব্দুল্লাহ যইফ।

 

মুহাম্মদ বিন সাঈদ আস-সানারী বলেছেন যে – “হাদিসটি "মুনকার"”[21]

 

হুসাইন সালিম আসাদ বলেছেন যে

إسناده ضعيف جدا [22]

অর্থ : “হাদিসটির সনদ যইফুন জিদ্দান (অত্যন্ত যইফ)।

 

আহমদ বিন আব্দুর রহমান আস-সায়াতী বলেছেন যে

وفى اسناده حسين بن عبد الله بن عبيد الله بن عباس ضعيف [23]

অর্থ : “হাদিসটির সনদে হুসাইন বিন আব্দুল্লাহ বিন উবাইদুল্লাহ বিন আব্বাস আছে যে কিনা যইফ।

 

নুরুদ্দিন আল-হাইছামী বলেছেন যে,

وفي إسنادهما الحسين بن عبد الله بن عباس، وهو متروك [24]

অর্থ :  এ দু’টি হাদিসের (আলোচ্য হাদিস এবং অপর একটি হাদিস এর) সনদে আছে আল-হুসাইন বিন আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস এবং সে হচ্ছে মাতরুক।

 

বাশশার আওয়াদ মারুফ, আবুল মুয়াতী আননুরী, মুহাম্মদ মাহদী আলমুসলিমী, আহমাদ আব্দুর রাজ্জাক ঈদ, আইমান ইব্রাহিম আয-যামিলী এবং মাহমুদ মুহাম্মদ খালিল সম্মিলিতভাবে বলেছেন যে

 

قلنا: إسناده ضعيف؛ الحسين بن عبد الله بن عبيد الله بن عباس, متروك الحديث [25]

অর্থ : “আমরা বলব যে হাদিসটির সনদ যইফ, আল-হুসাইন বিন আব্দুল্লাহ বিন উবাইদুল্লাহ বিন আব্বাস হচ্ছেন মাতরুকুল হাদিস।

 

 

তথ্যসূত্রঃ


[1] দেখুন: মুসনাদু আহমাদ (44/441), আল-মুসনাদুল মুসান্নাফুল মুয়াল্লাল (40/103), মুসনাদু আবি ইয়ালা (হা/7075), মারেফাতুস সাহাবাহ লি আবিনুয়াইম (6/3484), সিরাতু ইবনে ইসহাক্ব (পৃ/268) … ইত্যাদি ইত্যাদি।

[3] ইবনু শাহিন,তারিখু আসমাইয যুয়াফা ওয়াল কাজ্জাবিন (পৃ/72)

[4] আল-মুনযিরী, মুখতাসারু সুনানে আবি দাউদ (1/345)

[5] ইবনুল কাইয়িম, তাহযিবু সুনানে আবি দাউদ (3/39)

[6] আল-হাইছামী, মাজমায়ুয যাওয়াইদ (4/276)

[7] ইবনুল যাওযি, আদ্বুয়াফা ওয়াল মাতরুকুন (1/214)

[8] আল-বাওসিরী, মিসবাহুয যাজাজাহ (3/97)

[9] ইবনুল ক্বাইসারানী, মারেফাতুত তাযকিরাহ (পৃ/185)

[10] নাসিরুদ্দিন ইবনু যুরাইক্ব, মান তাকাল্লামা ফিহি আদ্ব-দ্বারাকুত্বনী (1/41)

[11] আল-বুখারী, আদ্বুয়াফাউস সাগির (পৃ/33)

[12] ইবনু দাহিয়াহ আল-কালবী, আদায়ু মা ওয়াজাবা মিন বায়ানি ওয়াদ্বঈল ওয়াদ্বদ্বাঈন ফি রজব (পৃ/150)

[13] আল-আঈনী, শারহু সুনানে আবি দাউদ (5/73)

[14] ইবনুল মুলাক্কিন, আত-তাওদ্বিহ লিশারহিল জামিঈস সাগির (16/183)

[15] ইবনুল খাররাত্ব, আল-আহকামুল উসত্বা (4/23)

[16] হাশিয়াতুস সিনদী আলা সুনানে ইবনে মাজাহ (2/104)

[17] ইবনু আব্দিল বার, আল-ইস্তিযকার (7/331)

[18] আশ-শাওক্বানী, নাইলুল আওতার (3/255)

[19] আল-বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা (10/579)

[20] দেখুন : আর-রিসালাহ প্রকাশনী হতে প্রকাশিত আল-আরনাওত সহ মুহাক্কিকদের একটি জামায়াত কর্তৃক তাহকিকৃত "মুসনাদু আহমাদ" গ্রন্থের খন্ড নং 44 এর পৃষ্ঠা নং 441 এর টিকা নং 1।

[21] দেখুন : আস-সানারী কর্তৃক তাহকিককৃত "মুসনাদু আবি ইয়ালা" গ্রন্থের খন্ড নং 9 এর পৃষ্ঠা নম্বর 472 এর হাদিস নং 7075 এর টীকা।

[22] দেখুন : হুসাইন সালিম আসাদ কর্তৃক তাহকিককৃত "মুসনাদু আবি ইয়ালা" গ্রন্থের খন্ড নং 12 এর পৃষ্ঠা নম্বর 502 এর হাদিস নং 7075 এর টীকা।

[23] আস-সায়াতী, আল-ফাতহুর রুব্বানী (22/147, টিকা 3)

[24] আল-হাইছামী, মাজমায়ুয যাওয়াইদ (4/276)

[25] আল-মুসনাদুল মুসান্নাফুল মুয়াল্লাল (40/103)